বর্তমানে বিশ্বে চারটি প্রধান প্রযুক্তি কোম্পানি রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে গুগল, ফেসবুক, অ্যামাজন এবং অ্যাপল। এত বড় বড় কোম্পানির পেছনে যেসব সাফল্যের গল্প রয়েছে, তা অনুপ্রেরণা যোগায় ঠিকই। কিন্তু সফলতা অর্জনের তাগিদে বা অতিরিক্ত বিস্তার লাভের চেষ্টা এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে আবার বিভিন্ন তর্ক-বিতর্ক এবং ক্ষোভের জন্ম দেয়। যেমন- অ্যামাজনের কথাই ধরা যাক। বর্তমান বিশ্বে অ্যামাজনকে নতুন করে পরিচয় করে দেওয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। অ্যামাজন কোম্পানি হিসেবে হোক, বা এর প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের জন্য হোক না কেন; এটি সকলের নিকটই পরিচিতি লাভ করেছে। সম্প্রতি অ্যামাজন উন্নতির একেবারে শিখরে চলে গিয়েছে। অনেকের মতে, মনোপলি হওয়ার তাগিদেই কাজ করছে কোম্পানিটি। এখনই অ্যামাজনকে মনোপলি বলা চলে। আবার অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, অ্যামাজনকে এখনই মনোপলি বলা ভুল হবে৷ অবশ্য অ্যামাজন এসব ধারণা যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করে বারবার প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে কোম্পানিটিকে কোনোভাবেই মনোপলি বলা চলে না। অন্তত অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। মনোপলি হোক বা না হোক, এটি যে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি কোম্পানি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর শক্তিশালী হতে গিয়ে কোম্পানিটি যেভাবে নিজের ভোক্তা, প্রতিযোগী এবং কর্মচারীদের সাথে ব্যবহার করছে, তা নিতান্তই অসন্তোষজনক।
কোনো কোম্পানি কখন মনোপলি হয়?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, যখন অনেকজন ক্রেতা থাকলেও বিক্রেতা মাত্র একজন থাকে, তখন সেই বাজার ব্যবস্থাকে মনোপলি বা একচেটিয়া ব্যবসা বলে। অর্থাৎ বাজারে বিক্রেতার কোনো প্রতিযোগীই থাকবে না। একজন মনোপলিস্ট বা একচেটিয়া ব্যবসায়ী বাজারে তার প্রতিযোগীদের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, যাতে করে তারা বাজারে ঢুকতেই না পারে। আর ঢুকলেও বাজার ছাড়তে বাধ্য হতে হয়। প্রতিযোগিতার এই যুগে অনেকসময় মনোপলি বা একচেটিয়া বাজার ব্যবস্থায় অনেকজন ক্রেতা এবং দুই থেকে তিনজন বিক্রেতা থাকে। একে অবশ্য ‘বিশুদ্ধ মনোপলি’ বলা চলে না। কারণ ‘বিশুদ্ধ মনোপলি’ হওয়ার পূর্ব শর্তই হলো বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা বা মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা একজন বিক্রেতা বা একটি ফার্ম বা কোম্পানির হাতেই ন্যস্ত থাকবে। এটি একাই সব ক্রেতাকে কোনো দ্রব্য বা সেবার জন্য নিজের পছন্দমতো মূল্য পরিশোধ করতে বাধ্য করে। বাজারে অনেক বেশি ক্রেতার মাঝে একদম হাতেগোনা কয়েকজন বিক্রেতা থাকলে সেই ব্যবস্থা অলিগোপলি এবং মাত্র দু’জন বিক্রেতা থাকলে তা ডুয়োপলি বাজার ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়ায়। ডুয়োপলির উদাহরণ হিসেবে বলা যায় পেপসি এবং কোকা-কোলা, ফানটা এবং ক্রাশ বা স্প্রাইট এবং সেভেন আপের মধ্যকার প্রতিযোগিতা। কোম্পানিগুলো সর্বদাই সর্বোচ্চ ক্ষমতা অধিকারের চেষ্টা করতে থাকে।
অ্যামাজন এককভাবে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করছে। একচেটিয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠা এবং সকল বাজার শক্তি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতেও উঠে পড়ে লেগেছে। তাই অনেকে এখনই অ্যামাজনকে মনোপলি বলছে।
বইয়ের বাজার নিয়ন্ত্রণ
বইয়ের বাজারে অ্যামাজনের কৃতিত্ব শুরু হয় ১৯৯৫ সালে। সেই বছর জেফ বেজোস ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বই বিক্রি করা শুরু করে, যা ছিল অত্যন্ত অভিনব একটি ব্যবসায়িক পরিকল্পনা। খুব দ্রুতই এই অনলাইন ব্যবসা জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলে যায়। ১৯৯৮ সালের মধ্যেই যুক্তরাজ্য এবং জার্মানিতে জেফ বেজোস নিজের ব্যবসা বিস্তৃত করে। ২০১৭ সালের একটি পরিসংখ্যান অনুসারে অনলাইনে বিক্রি হওয়া ৭৫% বইয়ের বিক্রেতা অ্যামাজন। তাছাড়া ৬৫% ই-বুক, ৪০% এর বেশি নতুন বইয়ের বিক্রেতাও এই কোম্পানিটি। অ্যামাজন নিজেও বই প্রকাশ করে, যার প্রায় শতকরা ৮৫ ভাগের বিক্রেতাও এই অ্যামাজন। ক্রেতাদের কাছে অন্তত ১১টি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এই সেবা পৌঁছে দিচ্ছে। ভোক্তারা যেন অ্যামাজন ব্যবহারেই অভ্যস্ত হয়ে যায় বা পরবর্তীতে চাইলেও যেন অন্য ওয়েবসাইট ব্যবহার করতে না পারে, তাই তারা বিভিন্ন পদক্ষেপও গ্রহণ করছে। ২০০২ সালের আগস্টের দিকে কোম্পানিটি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য ‘সুপার সেভিং শিপিং অফার’ দেওয়া শুরু করে। শিপিং চার্জ ১০০ থেকে মাত্র ২৫ ডলারে নিয়ে আসে। স্বভাবতই ক্রেতারা যেখানে কম খরচ করতে হয়, সেদিকেই বেশি আকৃষ্ট হয়। ফলে অ্যামাজনের দিকেই ক্রেতারা ঝুঁকে পড়ে। যারা ৩৫ ডলার বা এর বেশি ক্রয় করে তাদেরকে ফ্রি ডেলিভারিও দেওয়া হয়। ভোক্তাদের আকৃষ্ট করার আরেকটি অভিনব উপায় তথা ‘প্রাইম সার্ভিস’ শুরু করে ২০০৫ সালের দিকে। এই সেবায় যারা বার্ষিক ফি পরিশোধ করে, তারা দু’দিনের ফ্রি সার্ভিস পায়।
খাদ্য বাজার নিয়ন্ত্রণ
শুধুমাত্র বইয়ের অনলাইন শপ হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও অ্যামাজন এখন খাদ্যদ্রব্যের বাজারও নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করতে যাচ্ছে। তবে কাজটা সহজ হবে না। কারণ এই প্রতিযোগিতার দৌড়ে অ্যামাজনের সাথে রয়েছে ওয়ালমার্ট, ক্রোগার, কস্টকো, টার্গেট ইত্যাদি। ২০১৭ সালে অ্যামাজন ১৩.৭ বিলিয়ন ডলার দিয়ে আমেরিকার ‘হোল ফুডস মার্কেট’ কিনে নেয়, যাতে করে আমেরিকার খাদ্য বাজারকে আয়ত্ত্বে আনার কাজ আরম্ভ করতে পারে। এটি আমেরিকার ষষ্ঠ বৃহত্তম গ্রোসারি স্টোর।
এটি ক্রয় করার পেছনে যুক্তি হলো, আমেরিকানদের মধ্যে খুব মানুষই আছেন যারা অনলাইনে দৈনন্দিন প্রয়োজনের খাদ্যদ্রব্য অর্ডার করে থাকেন। সাধারণত নিজেরাই, বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে গিয়ে নিজেরাই সুপারশপ থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য কিনতে পছন্দ করেন। তাই এই ব্যবসা অনলাইনের চেয়ে অফলাইনেই যে বেশি লাভজনক হবে, তা আন্দাজ করতে পেরেছিল অ্যামাজন। বর্তমানে অ্যামাজন এবং হোল ফুডস মার্কেট মিলে আমেরিকার খাদ্য বাজারের শতকরা ৪ ভাগকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এত কম সময়ে এতটুকু আয়ত্ত্বে আনা সহজ কোনো বিষয় নয়। অ্যামাজন সুদূর ভবিষ্যতে অন্যান্য সেক্টরের মতো খাদ্য বাজারকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়। কোম্পানিটির সাবেক এক্সিকিউটিভ এবং বর্তমানের সাপ্লাই-চেইন কনসালটেন্ট ব্রিটেন ল্যাডের মতে, অ্যামাজন আমেরিকার ৮৪০ বিলিয়ন ডলারের খাদ্যশিল্পের শুধুমাত্র একটি অংশ আয়ত্ত্বে আনতে চায় না, বরং ভোক্তাদের চাহিদা পূরণে শীর্ষস্থান দখল করতে চায়।
অন্যান্য বাজারে আধিপত্য বিস্তার
বিভিন্ন খাতে আধিপত্য বিস্তারের জন্য অ্যামাজন সেসব খাতের শক্তিশালী ও প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো কিনে বিস্তার লাভের চেষ্টা করে। অনেকাংশে সফলতাও অর্জন করে। ২০০৯ সালে সবচাইতে বড় অনলাইন জুতার দোকান ‘জ্যাপস’, ২০১০ সালে বৃহত্তম অনলাইন ডায়াপার স্টোর ‘ডায়াপার.কম’ এবং ২০১৪ সালে বৃহত্তম অনলাইন কমিক্স স্টোর ‘কমিক্সোলজি’ কিনে নেয়। আমেরিকার খুচরো বিক্রিগুলোর প্রায় শতকরা ৩০ ভাগই অ্যামাজন করে থাকে। লাইভ স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম টুইচ ডট কমকেও ক্রয় করে নেয় এই কোম্পানি। এর সবকিছুর উপরে রয়েছে ‘অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস’। ১২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের এই ব্যবসা সার্ভার, ব্যান্ডউইথ এবং কম্পিউটিং পাওয়ার অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি, যেমন- স্ল্যাক, নেটফ্লিক্স, ড্রপবক্স, টাম্বলার, পিন্টারেস্টকে ভাড়ায় দিয়ে থাকে। এমনকি সরকারও অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস ব্যবহার করে থাকে। এতগুলো ক্ষমতাবান কোম্পানি যখন এই সেবার উপর নির্ভরশীল, তখন এটা সহজেই বোধগম্য যে এ থেকে অ্যামাজন মোটা অংকের আয়ের সাথে সাথে ক্ষমতাও অর্জন করছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এসব কোম্পানিকে ভোক্তাদের সেবা প্রদানের জন্য অ্যামাজনের উপরই নির্ভর করতে হচ্ছে।
বাজার শক্তির দরুন প্রতিযোগিতা কমিয়ে দেওয়া
মনোপলির অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে মনোপলিস্ট বা একচেটিয়া ব্যবসায়ী এমন পরিবেশের সৃষ্টি করে, যেন বাকি প্রতিযোগীরা বাজার ছাড়তে বাধ্য হয় বা থাকলেও বাজারে কোনো প্রভাব ফেলতে না পারে। অ্যামাজন অনেকসময় কিছু কিছু দ্রব্য তৈরিতে বা সেবা দেওয়ার জন্য যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয় তার সমপরিমাণ বা এর কমে দ্রব্য বা সেবাটি প্রদান করে। এর পেছনে দু’টি সুবিধা রয়েছে। এক, সুপ্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো ক্ষতির শিকার হবে এবং প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে যাবে। দুই, ক্রেতাদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারবে। পরবর্তীতে এই বিশ্বাস এবং অ্যামাজন ব্যবহারের অভ্যাসকে পুঁজি করে মুনাফা অর্জন করে অ্যামাজন। আবার দেখা যায় যে, অ্যামাজন অনেক সময় বড় বড় অনলাইন শপগুলোকে অ্যামাজন ও ভোক্তাদের মাঝে শুধুমাত্র একটি মাধ্যম হতে বাধ্য করে। যার ফলে মূল অর্জন হয় অ্যামাজনেরই। অর্থাৎ এটি এমন একটি খোলা বাজারের ব্যবস্থা করে, যেখানে সকল নিয়ম নির্ধারণ করছে অ্যামাজন। চাইলে অন্যান্য প্রতিযোগীরাও এসব নিয়ম মেনে এই বাজারে আসতে পারবে। কিন্তু এসব কোম্পানির মুনাফার উপর এত বেশি কর আরোপ করা হয় যে মূল মুনাফা অর্জনকারী শুধুমাত্র অ্যামাজনই থাকে।
অ্যামাজন ভোক্তাদের পছন্দ বা তারা কী কিনে বা কিনতে চায়, সেই তথ্যকে মাথায় রেখে মূল্য নির্ধারণ করে। যেসব জিনিস বেশি প্রয়োজন, সেসব জিনিসের মূল্যও বাড়িয়ে দেয়। যারা আবার ‘অ্যামাজন প্রাইম’-এর অন্তর্ভুক্ত নন, তাদের জন্য মূল্য অন্যদের চেয়ে বেশি রাখা হয়। তাদেরকে ডেলিভারি দিতেও দেরি করে কিংবা কিছু প্রোডাক্ট কেনার প্রবেশাধিকারও দেয় না। এভাবে পদে পদে অ্যামাজন বাজারশক্তি ব্যবহার করে যাচ্ছে।
লেখার প্রথমেই কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানিকে কখন মনোপলি বলা যাবে, তা বলা হয়েছে। প্রচলিত সংজ্ঞার সাথে মিল রেখে বলতে গেলে অ্যামাজনকে মনোপলি বলা চলে না। ব্রিটেন ল্যাডও এই মত পোষণ করেন। তবে অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, মনোপলি বা একচেটিয়া ব্যবসা শুধুমাত্র মূল্য বা বিক্রেতার সংখ্যার উপর নির্ভর করে না। মনোপলি এমন একটি বাজার ব্যবস্থা, যেখানে নতুন ব্যবসাকে সবসময়ই দমিয়ে রাখার চেষ্টা চালানো হয়। অ্যামাজন প্রতিনিয়ত অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বা প্রতিযোগীর আয় করার ক্ষমতা নষ্ট করে দিচ্ছে। এই কোম্পানি চাকরির ব্যবস্থাও যেমন কমিয়ে দিচ্ছে, তেমনি আয়ের ক্ষেত্রেও বৈষম্য সৃষ্টি করছে। এসব বিষয় নিয়ে বিবেচনা করলে অ্যামাজনকে মনোপলি বলা নিতান্তই ভুল হবে না।