প্রাণিজগতে মানুষ সভ্যতার শুরু থেকে টিকে আছে দুইটি শক্তিকে ব্যবহার করে, শারীরিক সক্ষমতা ও মানসিক দক্ষতা। মানসিক দক্ষতার ক্ষেত্রে মানুষ শুরু থেকেই প্রাণিজগতের অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেও, শারীরিক সক্ষমতায় মানুষ অনেক প্রাণীর চেয়েই পিছিয়ে ছিল। এখনো পিছিয়ে আছে অধিকাংশ প্রাণীর চেয়ে। নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে মানুষ সভ্যতার শুরু থেকেই তাই মানসিক দক্ষতাকে ব্যবহার করে শারীরিক সক্ষমতার অপ্রতুলতাকে ছাপিয়ে যেতে চেয়েছে। বন্য পশুকে পোষ মানানো, কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি আবিষ্কার, অস্ত্র তৈরি এই প্রক্রিয়ারই অংশ। পাশাপাশি, মানুষের শারীরিক পরিশ্রম কমানোর নিয়ত প্রচেষ্টাও ভূমিকা রেখেছে এই প্রক্রিয়ায়।
শিল্প বিপ্লবের সূচনা
সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষের শারীরিক পরিশ্রম কমিয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনের ধারা বজায় থাকলেও, এই ধারাটি বৈপ্লবিক রূপ ধারণ করে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে, স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতগতিতে উদ্ভাবিত হতে থাকে নতুন নতুন প্রযুক্তি। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল জায়গা হিসেবে কৃষি জমির জায়গা দখল করে নেয় শিল্প-কারখানাগুলো, গ্রামকে ছাপিয়ে কর্মসংস্থানের প্রধান ক্ষেত্র হয়ে উঠে শহরগুলো।
মানবসভ্যতার মৌলিক পরিবর্তনগুলো শুরু হয় ইংল্যান্ড থেকে, পরবর্তীতে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব ছড়িয়ে যায় পুরো ইউরোপজুড়ে, শিল্পের বিকাশ ঘটে আমেরিকাতেও। সভ্যতার শুরু থেকে মানুষ দুইভাবে অর্থ উপার্জন করেছে। জমির মালিকেরা কৃষিপণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করেছে, কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বাজারের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গায় সরবারহ করে অর্থ উপার্জন করেছে ব্যবসায়ী শ্রেণি।
শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে, মানুষের শারীরিক পরিশ্রমের প্রয়োজনীয়তা কমার পাশাপাশি মানুষের অর্থ উপার্জনের নতুন একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়, শিল্প-কারখানা। অর্থনীতিতে সামন্ত, কৃষক, মধ্যসত্ত্বভোগী, ব্যবসায়ীর পাশাপাশি নতুন কিছু প্রভাবকও যুক্ত হয়, শিল্পের শ্রমিক, শিল্পপতিরা আবির্ভূত হয় মূল প্রভাবকরূপে। শিল্প-কারখানাগুলোতে শুরু হয় বৃহৎ পরিসরে উৎপাদন, তুলনামূলকভাবে অল্প সংখ্যক শ্রমিক দিয়েই সম্ভব হয়ে উঠে কলকারখানা পরিচালনা করা। আবার, একই জায়গায় বড় সংখ্যক শ্রমিক নিয়ে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ পরিচালনার সুযোগও হয় এই সময়ে এসেই।
প্রাচীন গ্রিসে ফ্যাক্টরির উপস্থিতি দেখা গেছে, ফ্যাক্টরির উপস্থিতি দেখা গেছে প্রাচীন মিসরেও। তবে, গ্রিসে চেয়ে বেশ আগেই ফ্যাক্টরির ধারণা বিকাশ ঘটে প্রাচীন মিসরে। গ্রিসে মূলত অস্ত্র উৎপাদনকে কেন্দ্র করলেও, মিসরে ফ্যাক্টরির ধারণা বিকাশ ঘটে কাপড় উৎপাদনের জন্য। তবে, প্রাচীনকালের এই ফ্যাক্টরিগুলোতে সর্বোচ্চ ৫০ জন শ্রমিকের উপস্থিতি দেখা গেছে।
শিল্প বিপ্লবের ফলে সবচেয়ে উপকারভোগী হয়েছে শিল্পপতিরা। সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত যাদের হাতে কাছে পুঁজি ছিল, তারা সেই পুঁজিকে কাজে লাগিয়ে অর্থের বৃদ্ধি ঘটাতো পাইকারি ব্যবসার মাধ্যমে, ঘর বাড়ি বা ঘোড়া ভাড়া দেওয়ার মাধ্যমে, বড় সামন্তের অধীনে থেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে। পুঁজিপতিদের কেউই উৎপাদনের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতো না। শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে এই বাস্তবতার পরিবর্তন ঘটে, পুঁজিপতিরা তাদের পুঁজির বিনিয়োগ করতে থাকে শিল্প-কারখানা তৈরি আর পরিচালনায়, শিল্পপণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে সুযোগ হয় অর্থবৃদ্ধির।
শিল্প বিপ্লব কেন ইংল্যান্ডে হয়?
মানবসভ্যতাকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করে দেওয়ার মতো যতোগুলো ঘটনা রয়েছে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লব তার একটি। শিল্প বিপ্লবের শুরু হয় ইংল্যান্ডে, দ্রুতই এই প্রভাব ছড়িয়ে যায় ইউরোপসহ পুরো পৃথিবীজুড়ে। কিন্তু কেন শিল্প বিপ্লব পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে না হয়ে ইংল্যান্ডে হলো? কেন প্রযুক্তিগত দিক থেকে মানবসভ্যতার একটা দীর্ঘ সময় ধরে এগিয়ে থাকা চীন আর মিসরের মতো দেশগুলো এই প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দিতে পারেনি?
বিস্তৃত ভোক্তা শ্রেণি
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ড পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর একটি ছিল। ইংল্যান্ডের রাজতন্ত্র তখন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করেছে, ইংল্যান্ডের বণিকেরা পৃথিবীর সব প্রান্তে ছড়িয়ে গিয়েছিল ব্যবসার কাজে। ইংল্যান্ডের অভিজাতরা বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করেছিল দাস ব্যবসার মাধ্যমে। যুদ্ধও তখনকার সময়ের ইংল্যান্ডের জন্য অর্থ উপার্জনের অন্যতম একটি ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল।
অর্থ উপার্জনের এই প্রক্রিয়াগুলোর মাধ্যমেই ইংল্যান্ডে একটি অভিজাত শ্রেণি তৈরি হয়, যারা অর্থনৈতিকভাবে বেশ স্বচ্ছল। একই ধরনের অভিজাত শ্রেণি ইউরোপের অন্যান্য প্রান্তে এবং এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ছিল। তবে, ইংল্যান্ডের অভিজাত শ্রেণি ছিল বিস্তৃত। তাদের মাধ্যমে আবার আরেকটি স্বচ্ছল শ্রেণির তৈরি হয়েছিল, যাদেরকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক সক্ষমতার সাথে তুলনা করা যায়।
এই বিস্তৃত অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম শ্রেণি বাজারের বিপুল বিভিন্ন পণ্যের বিপুল চাহিদা তৈরি করে, যেই চাহিদা কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি পূরণ করতে পারছিল না। ফলে, স্বল্প সময়ে, স্বল্প জায়গায় বিপুল পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করা যাবে, এমন একটি প্রক্রিয়ার প্রয়োজন ছিল সেই সময়ের ইংল্যান্ডে। পণ্যের চাহিদাই ইংল্যান্ডকে শিল্প বিপ্লবের প্রারম্ভিক দেশ হিসেব প্রতিষ্ঠিত করে।
অভিজাতদের অভিযোজন
ইংল্যান্ডের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো অত্যন্ত প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী হচ্ছে সামন্তরা। সামন্তদের অধীনে বিপুল পরিমাণ জমি থাকতো, থাকতো লাঠিয়াল বাহিনীও। সামন্তদের অধীনেই সাধারণত কৃষিকাজ পরিচালিত হতো, সামন্তরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোতেও। শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে সামন্তদেরকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল নিয়ামকের জায়গা থেকে সরিয়ে দেয়, কৃষিভিত্তিক ইংল্যান্ডকে পরিণত করে শিল্পভিত্তিক ইংল্যান্ডে।
ইংল্যান্ডের এই রূপান্তরে সামন্তরা প্রতিরোধ করেনি, বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং, সামন্তরা এই প্রক্রিয়ার সাথে মানিয়ে নিয়েছেন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নতুন বাস্তবতায় নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখতে পরিবর্তনগুলোকে গ্রহণ করেছেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক প্রভাব যেভাবে ক্রমাগত সামন্তদের হাত থেকে শিল্পপতিদের দিকে গিয়েছে, ইংল্যান্ডের সামন্তরা ক্রমাগত নিজেদেরকে পরিবর্তন করেছেন, সুগম করেছেন শিল্প বিপ্লবের প্রসারের পথ।
এই প্রভাবকটি অনুপস্থিত থাকায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশই প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে থাকার পরেও, নিজেদের উদ্ভাবনী ক্ষমতাগুলোকে কাজে লাগাতে পারেনি, বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার জায়গায় নিজেদের নিতে পারেনি। এই রাজনৈতিক প্রভাবকটি বর্তমান সময়েও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আছে।
প্রযুক্তি আর উদ্ভাবনের প্রতি জাতীয় উন্মাদনা
ইউরোপীয় রেনেসাঁর প্রভাবে ইংল্যান্ডেও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার জোয়ার লেগেছিল, ইংল্যান্ডে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো খুব দ্রুত বিকাশ ঘটতে থাকে। ১৬৬০ সালে ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হয় বিখ্যাত ‘রয়েল সোসাইটি’, যেটির প্রথম দিককার প্রেসিডেন্ট ছিলেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। অধিকাংশ বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের বিকাশ ইংল্যান্ডে এখান থেকেই ঘটে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জন্য আরো কিছু সোসাইটি তৈরি হয়, শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বিকাশের সাথে সাথে ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন আসে।
সবকিছু মিলিয়ে, ইংল্যান্ডে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে নিয়ে জাতীয় উন্মাদনা তৈরি হয়, এই উন্মাদনাকে আরো বৃদ্ধি করে ‘জেন্টলম্যানস ম্যাগাজিন’ নামের একটি ম্যাগাজিন। ইংল্যান্ডের মানুষেরা সেসময় নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের খবরের অপেক্ষায় থাকতেন, নতুন প্রযুক্তির প্রদর্শনীগুলোতে থাকতো মানুষের উপচে পড়া ভিড়।
মানুষের এই বিপুল আগ্রহের পাশাপাশি যুক্ত হয় ইংল্যান্ডের সামন্তদের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের আগ্রহ, প্রচুর বিনিয়োগও হচ্ছিল নতুন নতুন যন্ত্রের মাধ্যমে কৃষিকাজ পরিচালনার চেষ্টাতে। ফলে, কৃষিকাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার দেখা যাচ্ছিল সেসময়, কৃষিকাজকে পুরোপুরি যন্ত্র নিয়ন্ত্রিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয় সেই সময় থেকেই।
বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির প্রতি জাতীয় এই উন্মাদনাই ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করে, মসৃণ করে শিল্প বিপ্লবের বিকাশ ও বিস্তারের পথকে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কমে যায় মানুষের শারীরিক পরিশ্রমের প্রয়োজনীয়তা, তৈরি হয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি, স্থায়ীভাবে বদলে যায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো। পরবর্তীতে, অষ্টাদশ শতাব্দী ও উনবিংশ শতাব্দীর এই শিল্প বিপ্লব পরিচিত হয়েছে প্রথম শিল্প বিপ্লব নামে, পুরো প্রক্রিয়া জুড়ে যার নেতৃত্বে ছিল ইংল্যান্ড।