ফিনল্যান্ড, ৫৪ লক্ষ মানুষের একটি ছোট্ট দেশ। প্রাকৃতিক সম্পদ নেই খুব বেশি। ভৌগলিক অবস্থান বিবেচনায় মোটেও আহামরি গুরুত্বপূর্ণ নয়। তার উপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশটির অর্থনীতির মেরুদন্ড একদম ভেঙ্গে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফিনল্যান্ডের অবস্থান ছিল জার্মানি অর্থাৎ অক্ষশক্তির পক্ষে। বিখ্যাত লেলিনগ্রাড যুদ্ধে অক্ষশক্তির পক্ষে অংশ নিয়েছিল ৬০ হাজার ফিনিশ সৈন্য। সেই দেশটিই এখন বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোর একটি। নোকিয়ার মত টেক জায়ান্টের জন্ম এখানেই।
২০০১ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ফিনল্যান্ড PISA ranking (Programme for International Student Assessment) এক টানা ৯ বছর শীর্ষ স্থানে ছিল। বিভিন্ন দেশের শিক্ষার মান যাচাইয়ে PISA খুব জনপ্রিয় একটি মূল্যায়ন পদ্ধতি। গণিত, বিজ্ঞান ও পঠন অভ্যাসের উপর সরাসরি পরীক্ষার মাধ্যমে এই মূল্যায়নটি করা হয়। তবে মজার ব্যাপার হল খোদ আমেরিকার অবস্থানই এই র্যাঙ্কিং এ অনেক পেছনে দিকে। তাই আমেরিকাসহ সারা বিশ্বের শিক্ষাগবেষকদের কাছে অত্যন্ত আগ্রহের বিষয় হল ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা। ফিনল্যান্ড নিয়ে তাঁদের গবেষণায় বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য উঠে এসেছে যা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আগাগোড়া বদলে দিতে পারে। তাই ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সাজানো হয়েছে এই ফিচারটি।
প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা
ফিনিশ শিশুরা ৭ বছরের আগে স্কুলের যায় না। এমনকি ৬ বছর পর্যন্ত তাদের স্কুলে ভর্তির অযোগ্য হিসাবে গণ্য করা হয়। অথচ আমাদের দেশে রাস্তাঘাটে প্রায়ই দেখা যায় ৩-৪ বছরের শিশুদের ভারবাহী গাধার মত পিঠে ব্যাগের মস্ত বোঝা চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে স্কুলে। শুধু তাই নয় এই অত্যাচার এমন মাত্রায় পৌঁছে গেছে যে অতিসম্প্রতি প্রাথমিক স্কুলের শিশুদের শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভারী স্কুলব্যাগ বহন নিষেধ করে সুনির্দিষ্ট একটি আইন প্রণয়ন করতে নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। দেরীতে হলেও এটি নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
ফিনল্যান্ডের শিশুদের যে শুধু মোটা মোটা বইয়ের বোঝা বইতে হয় না তা কিন্তু নয় ১৬ বছর বয়সে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার আগে এই দীর্ঘ ৯ বছর তাদের কোন ধরণের বার্ষিক পরীক্ষায়ও অংশগ্রহণ করতে হয় না। আরও মজার ব্যাপার হল সব স্কুলের কার্যক্রম শুরু হয় সকাল ৯:০০ থেকে ৯:৪৫ এর মধ্যে এবং সমাপ্ত হয় দুপুর ২:০০ থেকে ২:৪৫ এর মধ্যে। এমনকি একই স্কুলে একেকদিন একেক সময়ে ক্লাস শুরু হয় অর্থাৎ বাঁধাধরা কোন নিয়ম নেই পাঠকার্যক্রম শুরু করার।
শুধু তাই নয় ফিনিশরা মনে করে সকাল ৯টার আগে কোন ভাবেই ক্লাস শুরু করা উচিত নয়। স্কুলে সচরাচর দিনে তিন থেকে চারটি ক্লাস হয়। একেকটি ক্লাসের দৈর্ঘ্য ৭৫ মিনিট করে। প্রতি ক্লাসের পর ১৫ থেকে ২০ মিনিটের বিরতি দেওয়া হয় যাতে এই সময়ের মধ্যে পড়াটা আত্মস্থ করা যায় এবং কিছুক্ষণ হাঁটাচলা ও কথাবার্তার মাধ্যমে নতুন উদ্যমে পরের ক্লাসটা শুরু করা যায়। প্রতি ক্লাসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা থাকে গড়ে ১৫ থেকে ২০ জন। হোমওয়ার্কের পেছনেও ফিনল্যান্ডের শিশুদের ব্যয় করতে হয় অন্যান্য দেশের তুলনায় কম সময়।
ফিনল্যান্ডের শিক্ষক
ফিনল্যান্ডের সমাজব্যবস্থায় শিক্ষকদের সম্মান অকল্পনীয়। সামাজিক কাঠামোতে ডাক্তার কিংবা আইনজীবীর সমপর্যায়ে দেখা হয় একজন শিক্ষককে। স্কুল শিক্ষক হিসাবে চাকরি পেতে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা হল মাস্টার্স ডিগ্রী। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ১০% পোস্ট গ্র্যাজুয়েটরা শিক্ষক হিসাবে চাকরির আবেদনের সুযোগ পান।
শিক্ষকদের ক্লাস নিতে হয় দিনে মাত্র ৪ ঘন্টা । এছাড়া শিক্ষক শিক্ষিকাদের অন্যান্য কাজেরও চাপ অনেক কম এবং ঘন্টা হিসাবে বেতন আমেরিকার চেয়ে অনেক বেশি। যেহেতু একজন শিক্ষকের সান্নিধ্যে ৪-৫ বছর একটি ক্লাসের শিক্ষার্থীদের থাকতে হয় তাই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। খেয়াল রাখা হয় একজন শিক্ষকও যেন ছাত্রছাত্রীদের কাছে বাজে শিক্ষক বলে মনে না হন। ফিনল্যান্ডের অভূতপূর্ব শিক্ষা বিপ্লবের পেছনে এই উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
পারস্পরিক বিশ্বাস বনাম পরীক্ষা
ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল শিক্ষার্থীদের প্রতি কর্তৃপক্ষের অগাধ বিশ্বাস। ফিনল্যান্ডের স্কুলগুলোতে পরীক্ষা নেওয়া হয় খুবই কম। আলোচ্য বিষয় থাকে সীমিত। কিন্তু যা শেখানো হয় খুব মজবুতভাবে এবং বিস্তারিত শেখানো হয়। যেহেতু পরীক্ষায় ফলাফল নিয়ে দুশ্চিন্তা শিক্ষক কিংবা ছাত্র কারোরই থাকেনা তাই নতুন নতুন মজার মজার বিষয় শেখানোর ঝুঁকি শিক্ষকরা খুব সহজেই নিতে পারেন। ফিনল্যান্ডের স্কুলগুলোতে পরীক্ষা না নেওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ মেধা বিকাশের সাম্য নিশ্চিত করা। ইউরোপের অন্য যেকোন দেশের তুলনায় ফিনল্যান্ডে খারাপ ছাত্র এবং ভাল ছাত্রের মধ্যে ব্যবধান সবচেয়ে কম। তাই বেছে বেছে ভাল ছাত্র খুঁজে বের করার চেয়ে ফিনিশদের কাছে প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীকে যোগ্য হিসাবে গড়ে তোলা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চাপিয়ে দিয়ে নয় দায়িত্ববোধ তৈরির মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া তাঁদের মূলমন্ত্র।
শেষকথা
ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা পৃথিবীর অন্য যেকোন দেশের চেয়ে আলাদা এবং বেশ অদ্ভুতও বটে। কড়া অনুশাসন কিংবা নিয়মনীতির বেড়া জালের বাইরে গিয়েও যে সফল হওয়া যায় ফিনিশরা সেটা প্রমাণ করে দেখিয়েছে। এই প্রসঙ্গে একটি প্রশ্ন চলে আসে পৃথিবীর সব দেশেরই কি ফিনল্যান্ডের কারিকুলাম গ্রহণ করা উচিত? এই প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে আমাদের কিছু ব্যাপারে আরও স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার।
প্রথমত, ফিনল্যান্ডের জনসংখ্যা খুব কম। মাত্র ৫৪ লক্ষ যা পৃথিবীর অনেক বড় শহরের অর্ধেকের চেয়েও কম। অল্প সংখ্যক ছাত্রছাত্রী থাকায় যে সুবিধা ফিনল্যান্ড দিতে পারছে বিশেষ করে প্রতি ক্লাসে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা কম রাখার ব্যাপারটা অনেক দেশে চাইলেও সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, ১৯৬০ এর দশকে ফিনল্যান্ডের নীতিনির্ধারকরা বুঝতে পেরেছিলেন তাঁদের প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতাজনিত সমস্যা জনসম্পদ তৈরির মাধ্যমেই একমাত্র সমাধান করা সম্ভব। তাই শিক্ষাখাতকে ফিনিশরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে শুরু করল এবং মানব সম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে আরম্ভ করল। এখানে একটি প্রশ্ন অবধারিতভাবে চলে আসে পৃথিবীর কতগুলো দেশের পক্ষে এই ধরণের সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব?
তৃতীয়ত, ফিনল্যান্ডে শিক্ষা ১০০% অবৈতনিক। এর কারণ শিক্ষা ফিনিশদের কাছে একটি লাভজনক বিনিয়োগ কেননা এই খাতে বিনিয়োগের সুফল নগদে পাওয়া না গেলেও দীর্ঘ মেয়াদী সাফল্য পাওয়া যায়। তবে আমেরিকায় একজন শিক্ষার্থীর পেছনে সরকার যা ব্যয় করে ফিনল্যান্ড তার চেয়ে ২০% এর কম ব্যয় করে। তাই এক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত শিক্ষাখাতে ফিনল্যান্ডের সাফল্যকে শুধু ধনীর দুলালের বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার হওয়ার কাহিনী ভাবলে ভুল হবে।
শিক্ষার মাধ্যমে অল্পদিনেই কীভাবে একটি জাতিকে বদলে ফেলা যায় তার জলজ্যান্ত প্রমাণ ফিনল্যান্ড। আমাদের মনে রাখা উচিত অন্ধ অনুকরণ যেমন সুফল বয়ে আনে না তেমনি অন্যের উদাহরণ থেকে নিজের ভুলগুলো শুধরে না নিলে সামনে এগিয়ে যাওয়াও সম্ভব হয়না। তাই আমাদের উচিত ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার বিশেষ বিশেষ দিকগুলোর উপর গবেষণা করে বাংলাদেশের আঙ্গিকে সেগুলো কাজে লাগানো।