একটা কথা হামেশাই শোনা যায়, “চোখের পলকে বদলে গেছে কলকাতার সিনেমা।” অর্থাৎ একসময় যে ইন্ডাস্ট্রি পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল নায়ক-নায়িকার অসম প্রেম, পিতৃহত্যার প্রতিশোধ কিংবা বি-গ্রেডের রগরগে যৌনতায়, যে ইন্ডাস্ট্রিতে বাণিজ্যিক সফলতার পূর্বশর্ত ছিল বোধবুদ্ধিহীন আড়ম্বরপূর্ণতা এবং অযৌক্তিক নাচ-গান-মারামারি, সেখানেই এখন একের পর এক নির্মিত হচ্ছে বিষয়-নির্ভর চলচ্চিত্র, যা চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করছে মননশীল দর্শককে, হলে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে রুচিশীল মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে।
কিন্তু আসলেই কি চোখের পলকে কিছু বদলে যাওয়া সম্ভব? মোটেই না। যেকোনো পরিবর্তনকেই একটি লম্বা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। শুরুতে হয়তো পরিবর্তনগুলো দৃশ্যমান হয় না, কিন্তু পর্দার অন্তরালে পরিবর্তনের প্রচেষ্টাগুলো চলতে থাকে ঠিকই, এবং হঠাৎ একদিন সাধারণ মানুষ লক্ষ করে, “আরে, কিছু একটা বদলে গেছে মনে হচ্ছে!”
কলকাতার সিনেমার ক্ষেত্রেও এমন পরিবর্তন লোকসম্মুখে উদ্ভাসিত হওয়ার পেছনে একটি বিশেষ বছরকে চিহ্নিত করা হয়। কলকাতার সিনেমার সেই ‘ব্রেকথ্রু ইয়ার’ বা শত্রুব্যূহভেদের বছরটি হলো ২০১০ সাল। এ বছরেই, দীর্ঘ অন্ধকারের পর, ফের উজ্জ্বল সোনালী সূর্য হেসে উঠেছিল টালিগঞ্জের পুব দিগন্তে।
২০১০ সালই ছিল পরম আকাঙ্ক্ষিত সেই বছর, যে বছর বক্স অফিসের সাফল্য আর সমালোচকদের প্রশস্তিবাণী, দুই-ই হাত ধরাধরি করে এসেছিল। আর পুনরায় পায়ের তলার জমিন শক্ত করতে পেরেছিল ভারতের এই আঞ্চলিক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিটি।
এর আগে কয়েক বছর ধরেই, দক্ষিণী ছবির ফ্রেম বাই ফ্রেম নকল করে প্রযোজকদের পকেট ভরানোর কাজটি করে যাচ্ছিলেন বাংলা ছবির নির্মাতারা। তারা পেয়ে গিয়েছিলেন ‘কপিক্যাট’ আখ্যাও। এর বাইরে দুই-একটি মৌলিক কাহিনীর, সুনির্মিত ছবির আগমন যে ঘটছিল না, তা কিন্তু নয়। কিন্তু সংখ্যায় তারা ছিল এতটাই নগণ্য যে, আলাদা করে তা নজর কাড়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না।
কিন্তু ২০১০ সালে এসে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। আর্ট ফিল্ম আর মেইনস্ট্রিম কমার্শিয়াল ফিল্ম বলে কলকাতায় যে দুইটি পরস্পরবিরোধী ঘরানার জন্ম ঘটেছিল, এ বছর এসে তাদের মধ্যকার যাবতীয় ব্যবধান বিলীন হয়ে যায়। তারা দুইয়ে মিলে অদ্বিতীয় অস্তিত্ব ধারণ করে।
যে ছবিগুলোর কল্যাণে এ অসাধ্য সাধন সম্ভব হয়েছিল, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অটোগ্রাফ, মনের মানুষ, দ্য জাপানিজ ওয়াইফ এবং শুকনো লঙ্কা। এই ছবিগুলো সমালোচকদের মন ভরাতে সক্ষম তো হয়ই, পাশাপাশি আশ্চর্যজনকভাবে সাধারণ দর্শকের মনও জিতে নেয়, ফলে বক্স অফিসে চুটিয়ে ব্যবসাও করে।
ইতোমধ্যেই বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ঋতুপর্ণ ঘোষ, অপর্ণা সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, কৌশিক গাঙ্গুলী ও গৌতম ঘোষের মতো নির্মাতা তো ছিলেনই, তাদের সাথে নতুন করে যুক্ত হন আরো কয়েকজন সম্ভাবনাময় নবীন নির্মাতা। তাদের মধ্যে যার নাম সবার আগে আসবে, তিনি নিঃসন্দেহে সৃজিত মুখার্জি।
কলকাতার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে একদমই নতুন এই মুখ তৈরি করে ফেলেন অটোগ্রাফ-এর মতো একটি ছবি। একদিকে শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের মতো বড় ব্যানার, তার উপর আবার মুখ্য ভূমিকায় প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জির মতো তারকা। সব মিলিয়ে বিশাল একটা জুয়াই খেলেছিলেন সৃজিত। এরপর বাকিটা তো ইতিহাস।
সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ এবং ইংরিদ বারিমানের ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ’ এর থেকে অনুপ্রাণিত এবং ডিজিটাল ক্যামেরায় ধারণকৃত এ ছবিটিই মূলত বদলে দেয় কলকাতার বাংলা সিনেমার গতিপথ। সে বছর অক্টোবরে আবুধাবি চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তর্জাতিক প্রিমিয়ারের মাধ্যমে বৈশ্বিক দর্শকবোদ্ধার প্রশংসার বৃষ্টিতে ভেজেন সৃজিত।
কলকাতায় মুক্তির পরও ছবিটি এতটাই উন্মাদনা সৃষ্টি করে যে, এক পর্যায়ে গুঞ্জনও ওঠে বলিউডে হিন্দি রিমেক হবে ছবিটির, যেখানে নাকি প্রধান দুই চরিত্রে অভিনয় করবেন সুপারস্টার শাহরুখ খান ও রণবীর কাপুর!
শেষ পর্যন্ত সে গুঞ্জন বাস্তবে রূপান্তরিত না হলেও, কলকাতার বাংলা সিনেমার জন্য ‘অটোগ্রাফ’ যা করেছিল, তার কোনো তুলনা হয় না। এটি একাধারে পশ্চিমবঙ্গের রুচিশীল মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে হলমুখী করেছিল, বাংলা ছবির গানের প্রতি তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ ফিরিয়ে এনেছিল, অপরাপর পরিচালক-প্রযোজকদের মাথায় এই চরম সত্যটা ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিল যে কোনো ছবির বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনা ভালো হলে দর্শক সেটিকে গ্রহণ করবেই, এবং সবচেয়ে বড় কথা: প্রসেনজিতের ক্ষয়িষ্ণু ক্যারিয়ারে নবজাগরণের সৃষ্টি করেছিল। এ ছবির মাধ্যমে প্রসেনজিতের ক্যারিয়ারে অতিরিক্ত আরো অন্তত দশটি বছর যোগ হয়, তিনি ‘পোসেনজিত’ থেকে ‘প্রসেনজিতবাবু’-তে উত্তীর্ণ হন!
অটোগ্রাফ ছবির গানের কথা আরেকটু বলা দরকার। এ ছবির মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেন অনুপম রায়ও। তার আমাকে আমার মতো থাকতে দাও গানটি যে কী ভীষণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে তা কল্পনাও করা যায় না। এটিও অবিশ্বাস্য লাগতে পারে অনেকের কাছেই যে, সে বছর এমনকি বলিউডি ছবির অ্যালবামকেও পেছনে ফেলে, দেবজ্যোতি মিশ্রর সাথে জুটি বেঁধে অনুপমের করা অটোগ্রাফ-এর অ্যালবামটি কলকাতার সকল গানের দোকানের ‘বেস্টসেলার’ খেতাব জিতে নিয়েছিল। তবে আজ দশ বছর পরও যখন তাকে দেখা যায় নিত্যনতুন গানের পসরা সাজিয়ে চলেছেন, দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন নতুন প্রজন্মের প্লে-লিস্ট, তখন অনুপমের প্রতিপত্তি আঁচ করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না।
এদিকে ২০১০ সালেই অটোগ্রাফ-এর পাশাপাশি সোনায় সোহাগা হিসেবে এসেছিল প্রসেনজিতের মনের মানুষ ছবিটি। গৌতম ঘোষ পরিচালিত এ ছবিটি সর্বশেষ এক দশকের মধ্যে প্রথম ভারতীয় ছবি হিসেবে গোয়ায় অনুষ্ঠিত ৪১তম ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অভ ইন্ডিয়ায় গোল্ডেন পি-কক ট্রফি জিতে নেয়।
উনিশ শতকের মরমী কবি লালন ফকিরের জীবনদর্শন নিয়ে নির্মিত সে ছবিটিতে প্রসেনজিৎ অভিনয় করেছিলেন লালনের ভূমিকায়। এ ছবিটি আঞ্চলিক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে টলিউডকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়।
ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার মনের মানুষ-ই ১৯৫৪ সালের পর প্রথম ছবি, প্রতিবেশী দুই দেশে যার যুগপৎ মুক্তি ঘটে। বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত হওয়ার সাথে সাথে ছবিটি বক্স অফিসেও দারুণ সাফল্য পায়, হয় সুপার-ডুপার হিট।
ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত আবহমান ছবিটিও আলোকিত করেছিল স্মরণীয় ২০১০ সালকে। এটি হয়তো বক্স অফিসে আশানুরূপ সাড়াতে ব্যর্থ হয়, তবু এর প্রাপ্তির ঝুলি নেহাত শূন্য ছিল না। চার-চারটি জাতীয় পুরস্কার জিতে নিয়েছিল এ ছবিটি, যার মধ্যে ছিল সেরা বাংলা ছবি আর সেরা পরিচালকের সম্মাননাও। এছাড়া অনন্যা চট্টোপাধ্যায়ের মতো অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত অভিনেত্রীও এ ছবির সুবাদে পেয়ে যান সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার। আর সেরা সম্পাদনার স্বীকৃতি জুটেছিল অর্ঘ্যকমল মিত্রের কপালে।
২০১০ সালে সৃজিতের পাশাপাশি নতুন আর যে নির্মাতা এসেই চমকে দিয়েছিলেন বাংলা ভাষার দর্শককে, তিনি গৌরব পাণ্ডে। তার হাতে তুরুপের তাস হিসেবে ছিল শুকনো লঙ্কা। তিনিও প্রথম ছবিতেই পেয়েছিলেন মিঠুন চক্রবর্তীর মতো একজন সুপারস্টারকে। একই সাথে কলকাতা, দিল্লি ও মুম্বাইয়ে মুক্তির সৌভাগ্য লাভ করেছিল ছবিটি। বক্স অফিসে শিকে ছেঁড়ার পাশাপাশি একজন পুরোদস্তুর অভিনেতা হিসেবে মিঠুন চক্রবর্তীর শক্তিমত্তাও নতুন করে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করেছিল ‘শুকনো লঙ্কা’।
এদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধ্রুপদী ছোট গল্প ল্যাবরেটরি অবলম্বনে একই নামের ছবি বানিয়েছিলেন রাজা সেন। এ ছবির মাধ্যমে বাংলা ছবিতে অভিষেক ঘটেছিল বলিউড অভিনেত্রী রাভিনা ট্যান্ডনের। ভারতের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি শহরে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল ছবিটির। বিস্ময়কর ব্যাপার, স্থানীয় বাজারে এ ছবি খুব একটা সাড়া ফেলতে না পারলেও, যুক্তরাষ্ট্রে ঈর্ষণীয় বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছিল।
এ বছর অপর্ণা সেনও উপহার দিয়েছিলেন পরিচালক হিসেবে এখন পর্যন্ত তার অন্যতম সেরা ছবিটি। দ্য জাপানিজ ওয়াইফ ছবিটিতে তিনি কবিতা এঁকেছিলেন সেলুলয়েডে। তার সেই কবিতারূপী ছবি ভরিয়ে দিয়েছিল মাল্টিপ্লেক্সের দর্শকদের মন। রাহুল বোস আর রাইমা সেনের অভিনয়ও হয়েছিল দারুণ প্রশংসিত।
২০১০ সাল বাংলা সিনেমার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে আরেকটি কারণে। সেটি হলো: ব্যোমকেশ বক্সী রূপে বড় পর্দায় আবীর চট্টোপাধ্যায়ের আত্মপ্রকাশ। অঞ্জন দত্ত তার ‘ব্যোমকেশ বক্সী’ ছবিটির মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর বড় পরিসরে ফিরিয়ে এনেছিলেন বাঙালির অন্যতম প্রিয় গোয়েন্দাকে। দর্শক-সমালোচকরাও সাদরে গ্রহণ করেছিল ছবিটি। এছাড়া একই বছর ফেলুদার কাহিনী ‘গোরস্থানে সাবধান’ নিয়ে এসেছিলেন সন্দীপ রায়ও। বরাবরের মতো সে ছবিটিও পেয়েছিল দর্শকের আনুকূল্য।
তবে নিছকই দর্শকের সাড়া দেয়া কিংবা সমালোচকদের ইতিবাচকভাবে গ্রহণেই সীমাবদ্ধ থাকবে না এই দুই ছবির সাফল্য। বরং এই দুই ছবির মাধ্যমেই কলকাতার বাংলা সিনেমায় জোয়ার ওঠে গোয়েন্দা বা থ্রিলারধর্মী কাহিনী নিয়ে ছবি নির্মাণের। খেয়াল করে দেখবেন, ২০১০ এর পর গত দশকজুড়েই কিন্তু কলকাতায় মুক্তি পেয়েছে অসংখ্য থ্রিলার ছবি, পর্দায় আত্মপ্রকাশ ঘটেছে মৌলিক কিংবা বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী অনেক চরিত্রের।
কেউ যেন ভাববেন না, ২০১০ সালে কলকাতায় কেবল বিষয়-নির্ভর, তথাকথিত অফ ট্র্যাকের ছবিগুলোই সফলতার দেখা পেয়েছিল। বরং জয়যাত্রা অব্যাহত ছিল বাণিজ্যিক ছবির প্রধান দুই সুপারস্টার জিৎ ও দেবেরও। সে বছরের ব্যবসাসফল ছবির তালিকায় ছিল জিতের ওয়ান্টেড, জোশ এবং দেবের সেদিন দেখা হয়েছিল, লে ছক্কা, বলো না তুমি আমার। এছাড়া তারা দুজন একসাথে করেছিলেন রাজ চক্রবর্তীর ‘দুই পৃথিবী’ ছবিটিও। বলাই বাহুল্য, দুই পৃথিবী-ও হেসেছিল বক্স অফিসে, বনে গিয়েছিল বছরের সবচেয়ে ব্যবসাসফল ছবি। জিৎ-দেবের বাইরে সাফল্য পেয়েছিল সোহমের অমানুষ ছবিটিও।
এভাবেই নতুন দর্শকগোষ্ঠীর জন্ম দেয়া, সমালোচকদের মন যোগানো, কিংবা বক্স অফিসে উপর্যুপরি সাফল্য—সব দিক থেকেই কলকাতার বাংলা সিনেমার জন্য একটি সোনায় মোড়ানো বছর ছিল ২০১০। এমন অনবদ্যভাবে একটি নতুন দশক শুরুর পর বাকি পুরোটা সময় জুড়ে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার প্রচেষ্টা লক্ষণীয় ছিল। মাঝেমধ্যে হয়তো হোঁচট খেতে হয়েছিল, এমনকি ঋতুপর্ণ ঘোষের আকস্মিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে বেশ খানিকটা পিছিয়েও যেতে হয়েছিল কলকাতার সিনেমাকে, তারপরও ২০১০ সালে প্রাপ্ত মজবুত ভিত্তিই তাদেরকে টিকিয়ে রেখেছিল লড়াইয়ে।