‘কার্নিভাল’ শব্দটি আমাদের কাছে খুব পরিচিত একটা শব্দ। কোনো এক বিশেষ দিনে, কোনো বিশেষ উপলক্ষে ইচ্ছেমতো মজার পোশাক পরে রাস্তায় মিছিল করে, হৈ-হুল্লোড় আর উচ্ছল আনন্দের মধ্য দিয়ে যে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়, তাই এখন ‘কার্নিভাল’ নামে সারা বিশ্বে পরিচিত।
কার্নিভাল কী
কার্নিভাল শব্দটি প্রকৃতপক্ষে ইতালীয়। অ্যাশ ওয়েডনেসডের (লেন্ট পর্বের প্রথম দিন, সেই দিনটা বুধবার হয় এবং তা অ্যাশ ওয়েডনেসডে নামে পরিচিত) আগের দিন যে মঙ্গলবার, সেটা ইতালীয় ভাষায় কার্নিভাল নামে পরিচিত। ‘কার্নিভাল’ শব্দটি এসেছে লাতিন ভাষার ‘কার্নিস ফেভার’ শব্দ থেকে। ‘কার্নিস ফেভার’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘মাংস মরিয়ে রাখা’। সহজ কথায় বলতে গেলে, মাংস না খাওয়া।
এই উৎসবের গোড়াপত্তন হয় কীভাবে
হাজার বছরের পুরনো এই কার্নিভাল উৎসব। ধারণা করা হয়, কার্নিভাল উদযাপনের বিষয়টি এসেছে সাতুরলানিয়ার প্যাগান উৎসব থেকে। প্রকৃতির আনুকূল্যে ফসলের চাষ এবং প্রচুর পরিমাণে ফসল উৎপাদনের জন্য প্রকৃতির দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য এই প্যাগান উৎসবের আয়োজন করা হতো। প্রথমদিকে ক্যাথলিক চার্চের তত্ত্বাবধানে এই উৎসবটির আয়োজন করা হতো।
প্রাচীন রোমের লুপারকালিয়া ও বাকানালিয়া উৎসবের মতো এটাও বহুকালের পুরনো এক পাগান উৎসব। এপিফ্যানির দিন থেকে শুরু হয়ে শ্রোভ টুইসডে (অ্যাশ ওয়েডনেসডের আগের দিন, মঙ্গলবার) পর্যন্ত ১৫ দিনের টানা এক আমোদে ডুবে থাকার উৎসব কার্নিভাল।
কার্নিভাল তাই লেন্ট পর্বের ঠিক আগের উৎসব। রোমান, ক্যাথলিক দেশগুলোতে আজও সেই একরকম জাঁকজমক আর হৈ-হুল্লোড় সহযোগে এই উৎসব পালিত হয়। খাওয়াদাওয়া, পান, ভোজন, এসব আমোদ-উচ্ছ্বলতা লেন্ট পর্বের সময় বারণ। লোকে তাই এই সময়ে শখ মেটানোর আতিশায্যে মেতে ওঠে। তবে বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বার্ষিক কোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে কার্নিভালের আয়োজন করে থাকে।
কার্নিভাল উৎসবের নানা আয়োজনের সা্থে আফ্রিকান দেশগুলোর প্রভাব
কার্নিভাল উৎসবের নানা আয়োজনের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় আফ্রিকান জনগণের প্রভাব। আফ্রিকান মানুষদের জীবনযাত্রার সাথে জড়িয়ে রয়েছে নানা উৎসব। এসব উৎসবে তারা নানা বৈচিত্র্যময় পোশাকের সাথে আফ্রিকান বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নাচ-গান, খাওয়া-দাওয়া আর আমোদ-ফুর্তিতে নিজেদেরকে মাতিয়ে রাখে। প্রকৃতির কাছ থেকে পাওয়া নানা উপকরণ থেকে তৈরি মুখোশ, খড়, লতাপাতা, মাটি দিয়ে তৈরি ভাস্কর্য এসব আফ্রিকান ঐতিহ্যগুলো পরবর্তীতে কার্নিভাল উৎসবের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে যুক্ত হয়েছে।
একসময় আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে কালো মানুষদের ক্রীতদাস হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পাঠানো হতো। এছাড়া ক্যারিবীয়ান দ্বীপপুঞ্জ, ব্রাজিল এবং আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গায় পর্তুগিজ থেকে শুরু করে ইংরেজ, ডাচ, ফরাসিদের কলোনি গড়ে উঠতে থাকে। প্রথমদিকে এসব কলোনিতে শ্বেতাঙ্গ লোকজন যখন কার্নিভালের আয়োজন করতো, তখন উৎসবের জন্য নতুন পোশাক পরিধান করে সমবেত প্রার্থনা করা এবং খাওয়া-দাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
সেসময় উৎসবটি ধনী শ্রেণী বা শাসক শ্রেণীর মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। ধীরে ধীরে আফ্রিকান ক্রীতদাসরা এই উৎসবে যোগদান করতে থাকে। এই উৎসব উপলক্ষে তাদেরকে কিছু সময়ের জন্য মুক্তির স্বাদ দেয়া হতো। আর এই মুক্তির স্বাদ পেয়ে তারা নিজেদের ঐতিহ্য অনুসারে, গানে, নাচে আনন্দে নিজেদের মাতিয়ে রাখতে থাকে। তা দেখে অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হতে থাকে। পরবতীর্তে আফ্রিকান এই প্রাচীন ঐতিহ্যই কার্নিভালের প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে যুক্ত হতে থাকে।
উৎসবের প্রধান আকর্ষণ
কার্নিভাল উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হলো রং-বেরঙের মজাদার সব পোশাক আর বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। প্রাচীন রোমে বলি দেওয়ার সময় এরকমই এক শোভাযাত্রা বের করা হতো। সেই প্রাচীন প্রথারই এক মজাদার অনুকরণ পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশের কার্নিভালে দৃশ্যমান হতে থাকে।
কার্নিভালের সময়ে রাস্তায় মুখোশ পরে সবাই নাচের আনন্দে মেতে ওঠে। ফলে-ফুলে রাস্তাটিকে সাজানো হয়। প্রতিটি মানুষের মুখে থাকে অদ্ভুত সব মুখোশ। চাকার ওপর বসিয়ে, রাজপথ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সুবিশাল, সুসজ্জিত সব ট্যাবলো। উৎসবে একজনকে রানী ও একজনকে রাজা সাজানো হয়।
শোভাযাত্রার লোকজন ফুটপাতে দাঁড়ানো দর্শকদেরও এই উচ্ছ্বল আমোদে টেনে নিতে চায়। পথচারীদের দিকে তারা ফুল, মিষ্টি ইত্যাদি ছুঁড়ে দেয়। আগে ছাই, জঞ্জাল এসব ছোঁড়া হতো। পরে সেই প্রথাটা ক্রমশ বদলে যায়। জার্মানিতে মানুষেরা আবার বিভিন্ন পশুর মুখোশ পরে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে। সেই মিছিলে আবার কিছু হাতি আর ভালুক থাকে। তারা দর্শকদের কাছ থেকে পয়সা সংগ্রহ করে। ইংল্যান্ডে এই পর্বের জন্যই বিখ্যাত ‘প্যান-কেক’ তৈরি করা হয়। ইংল্যান্ডের কার্নিভাল উৎসব থেকেই সারা পৃথিবীতে একদিন প্যান-কেক ছড়িয়ে পড়েছিল।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উল্লেখযোগ্য কার্নিভাল
ফ্রান্সের সবচেয় জনপ্রিয় কার্নিভাল উৎসবটি মার্দি গ্রাস (মোটা মঙ্গলবার) নামে পরিচিত। সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই উৎসবের প্রচলন শুরু হয়। সেদিন আবার মোটাসোটা ষাঁড়ের গলায় ফুলের মালা ও কাপড়ের রিলে জড়িয়ে দেয়া হয়। সেই হৃষ্টপুষ্ট ষাঁড়টিকে নিয়ে রাস্তায় মিছিল বের করা হয়। একদল লোক পুরোহিতের মতো সেজেগুজে সেই ষাঁড়টির সঙ্গে হাঁটতে থাকে। ২০১৮ সলে এই উৎসবের তিনশ বছর উদযাপিত হবে। সাধারণত জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে এই উৎসবটি পালিত হয়ে থাকে।
ইতালির ভেনিস শহরে উদযাপিত ভেনিস কার্নিভালটি বেশ প্রাচীন এক উৎসব। ১১৬২ সালে শুরু হয়েছিল এই উৎসব। ক্যাথলিকদের ধর্মীয় উৎসব ইস্টারের ৪০ দিন আগে শুরু হয় এ উৎসব। শহরে বেশ জাঁকজমক ও আড়ম্বর সহযোগে এই কার্নিভাল পালন করা হয়ে থাকে। রাতের উৎসব যেন আরও জমকালো। এই কার্নিভালের সময়েই রাস্তায় মুখোশ পরে সবাই নাচের আনন্দে মেতে ওঠে। সারা ইউরোপের অন্যতম চমৎকার ও ব্যয়বহুল অনুষ্ঠান ভেনিস কার্নিভাল।
কার্নিভাল উদযাপনগুলোর মধ্যে ব্রাজিলের রিও কার্নিভাল সুপরিচিত। রিও ডি জেনেইরোতে এই কার্নিভালের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় কার্নিভালগুলোর একটি। ২০১০ সালের গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অনুসারে রিও কার্নিভাল বিশ্বের সবচেয়ে বড় কার্নিভাল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৭২৩ সালে প্রথম শুরু হয় এই কার্নিভাল।
এই উৎসবে ব্রাজিলের প্রাচীন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা হয়। রিও কার্নিভালের প্রধান আকর্ষণ জনপ্রিয় সাম্বা নাচ। এই কার্নিভাল দেখার জন্য ব্রাজ়িলে ভিড় জমায় দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মানুষ।
ত্রিনিদাদের সাংস্কৃতিক নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোব্যাগো কার্নিভাল। এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় উৎসব এটি। দক্ষিণ ক্যারিবিয়ার সবচেয়ে বড় দ্বীপ ত্রিনিদাদে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসব হিসেবে এটি সীমাবদ্ধ থাকে না। দ্বীপের সাংস্কৃতিক নানা ঐতিহ্য তুলে ধরা হয় কার্নিভালে। ঐতিহ্যবাহী নৃত্য, বৈচিত্র্যময় পোশাক আর গান-বাজনায় উৎসবটি হয়ে ওঠে জাঁকজমকপূর্ণ।
জার্মানির সবচেয়ে জনপ্রিয় কার্নিভাল কোলনি ফেস্টিভ্যাল। গ্রীষ্মকালীন উৎসব হিসেবে এটি বিশেষ পরিচিত। ঐতিহ্য মেনে প্রতি বছর নভেম্বর মাসের ১১ তারিখে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। হরেক রকমের পোশাক ও মেক আপে সেজে ওঠে সাধারণ মানুষ। রঙিন পোশাকে নেচে গেয়ে স্থানীয়রা বার্ষিক এই উৎসবটি পালন করে থাকেন। রঙিন এই কার্নিভালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটকেরা অংশগ্রহণ করে থাকে।
সপ্তদশ দশকের শেষের দিকে ইতালি, ফ্রান্স, রাইনল্যান্ডের মতো মহাদেশীয় অঞ্চলগুলো হয়ে কার্নিভাল পৌঁছেছিল ইংরেজদের দেশে। ইংল্যান্ডের লন্ডনে অনুষ্ঠিত নটিংহাম কার্নিভাল ইউরোপের অন্যতম বড় কার্নিভাল। স্ট্রিট পার্টি হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে এটি। আগস্ট মাসে এই কার্নিভালের আয়োজন করা হয়ে থাকে। কার্নিভালের থিমে থাকে জনপ্রিয় ক্যারিবিয়ান ছোঁয়া। গান, নাচ, বৈচিত্র্যময় পোশাক সব মিলিয়ে জমজমাট এই কার্নিভাল।
সারা বিশ্বে কার্নিভাল উজ্জ্বল এক উৎসব। বর্তমানে কার্নিভাল আর ধর্মীয় উৎসবের গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন কার্নিভাল হয়ে পড়েছে সার্বজনীন এক উৎসবে। আর তাই প্রাচীন কোনো উৎসব উপলক্ষে বা কিংবা নিতান্ত বাণিজ্যিক কারণেও পৃথিবীর অনেক জায়গায় এই কার্নিভাল পালন করা হয়ে থাকে। গ্রীষ্মের ছুটির সময়, সমুদ্রের ধারের হোটেলগুলোতে বছরের প্রায় সময়ই কার্নিভালের আয়োজন করা হয়ে থাকে। সেই জাঁকজমকের মূল লক্ষ্য পর্যটকদের আকর্ষণ করা।
ফিচার ইমেজ-Veloso Tours