অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাস ভারতবর্ষ আবিষ্কারের আশায় পূর্বদিকের পরিবর্তে পশ্চিমে থেকে যাত্রা শুরু করেন। ভেবেছিলেন, হয়তো এই নতুন পথেই সহজে ভারতবর্ষে পৌঁছানো যাবে। কিন্তু কলম্বাসের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তবে তিনি ভারতবর্ষে পৌঁছতে না পারলেও ক্যারিবিয়ান সমুদ্র উপকূলবর্তী কিছু অনাবিষ্কৃত দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছতে সক্ষম হন। তিনি এই দ্বীপপুঞ্জগুলোর নাম রেখেছিলেন পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ হিসেবে পরিচিত এই দ্বীপপুঞ্জের মাটি ছিল বেশ উর্বর এবং তা ঘন সবুজ গাছপালায় পরিপূর্ণ ছিল।
পরবর্তীকালে স্পেনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ধনী কৃষকরা এই দ্বীপপুঞ্জের বিশাল এলাকা জুড়ে কলা ও আখের আবাদ শুরু করে। এই কৃষি জমিতে কাজ করার জন্য তারা আফ্রিকা থেকে হাজার হাজার ক্রীতদাস আমদানী করতে শুরু করে। আফ্রিকা থেকে আসার সময় ক্রীতদাসরা তাদের সঙ্গে নিয়ে আসেন তাদের ভালবাসার আফ্রিকান সঙ্গীত। পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে আফ্রিকানদের আসার গল্প এভাবেই শুরু হয়। তাদের এই আফ্রিকান সঙ্গীতই পরবর্তী সময়ে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গীত হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচয় পেতে শুরু করে।
শুরুর দিকে এ সঙ্গীত ছিল পুরোপুরি আফ্রিকান। সময়ের সাথে সাথে এই সঙ্গীত তার উৎস থেকে একটু একটু করে পৃথক হতে শুরু করে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এসে ক্রীতদাসরা যখন মুক্তির স্বাদ পেতে শুরু করে, তখন থেকেই এই সঙ্গীত সম্পূর্ণরূপে তার নিজস্ব সুর ও ছন্দ আয়ত্ত করে ফেলেছে। আর সঙ্গীতের এক নতুন ধারা হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে ‘ক্যালিপসো সঙ্গীত’। অনেক সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ ‘কাইসো’ নামক এক সঙ্গীতের ধারা থেকে আজকের এই ক্যালিপসো সঙ্গীতের জন্ম বলে মনে করে থাকেন।
উপনিবেশকালে ক্যালিপসো ছিল ক্রীতদাসদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন
পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে আসা ক্রীতদাসরা জমিতে চাষাবাদের সময়, একান্তে নিজেদের মধ্যে সময় কাটাতে এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের এক মাধ্যম হিসেবে ক্যালিপসোকে বেছে নেয়। ক্যালিপসো হয়ে ওঠে তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র হাতিয়ার। এই অঞ্চলের অনেক লোকসঙ্গীতই ক্রীতদাস প্রথার সময় থেকে চলে আসছে। জ্যামাইকার বিখ্যাত লোকসঙ্গীত ‘ডে ওহো, ডে ওহো’ প্রথম শুরু করেছিলেন মহিলা ক্রীতদাসরা। এই গানটি গাইতে গাইতে তারা অপেক্ষমান জাহাজে কলার বোঝা তুলে দিতেন।
‘হিল অ্যান্ড গালি’ গানটিও প্রথম শুরু করেছিলেন পুরুষ ক্রীতদাসরা। চাষের জমিতে জল আনার জন্য পুরুষ ক্রীতদাসদের গাইতি হাতে নেমে পড়তে হতো খাল কাটার জন্য। আর এই গানটা গাইতে গাইতে তারা খাল কাটতেন। এই গানের তালে তালে সুন্দরভাবে এগিয়ে চলতো তাদের হাতের গাঁইতি।
নাচের তালে তালে ক্যালিপসো গাওয়ার মধ্যে দিয়ে তারা ভুলে থাকতে চাইতেন তাদের ওপর হওয়া নির্যাতনের কথা, তাদের অভাব-অনটন আর অভিযোগের কথা। এভাবে প্রতিবাদের এক ভাষা হয়ে ওঠে ক্যালিপসো। এই গানের প্রতি ছত্রে বড় বড় আখের আবাদে দাস শ্রমিকদের মর্মন্তুদ জীবনকথা ব্যক্ত হয়ে উঠেছিল।
পরবর্তীকালে ক্রীতদাস প্রথার বিলুপ্তির পর পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে, বিশেষ করে জ্যামাইকা, ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো অঞ্চলে বেশিরভাগ ক্রীতদাসের আবাসভূমি গড়ে ওঠে। সেখানেই মূলত ক্যালিপসোর জোয়ার সৃষ্টি হয়। আস্তে আস্তে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের অন্যান্য দ্বীপেও এই সঙ্গীত ছড়িয়ে পড়ে। এখন তো পৃথিবীর বহু দেশেই এ সঙ্গীত খুবই জনপ্রিয়।
ক্যালিপসোর স্বর্ণযুগ
১৯১৪ সালকে ক্যালিপসোর ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য বছর হিসেবে গণ্য করা হয়। এই বছরেই প্রথম ক্যালিপসো গান রেকর্ড করা হয়। ১৯২০ সালের শেষের দিকে ক্যালিপসো ত্রিনিদাদ কার্নিভালের প্রধান সঙ্গীত হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। ১৯৩০ সালের শেষের দিকে আতিলা দ্য হান, লর্ড ইনভেডা এবং রোয়ারিং লায়ন ক্যালিপসো সঙ্গীতকে বিশ্ব সঙ্গীতের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেন। গানের কথা ও সুরে তারা শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। ১৯৪০ এর দিকে লর্ড কিচেনার, ১৯৪৪ এর মাঝামাঝি সময়ে এন্ড্রু সিস্টারস যুক্তরাষ্ট্রে ক্যালিপসোকে জনপ্রিয় করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
পঞ্চাশের দশক ক্যালিপসো সঙ্গীতের স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিত। এই সময় ক্যালিপসো সারা বিশ্বে বেশ আলোচিত হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তের পর উন্মুক্ত মঞ্চে, রেকর্ডিং পাড়ায় চলছিলো ক্যালিপসোর জয়জয়কার। এই সময় ক্যালিপসোর এক জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন হ্যারি বেলফন্ট। ১৯৫৬ সালে ‘ক্যালিপসো’ নামে তার প্রথম গানের অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত শব্দগুলো এখানে স্থান পাওয়ায় গানগুলো সে সময় সকলের মুখে মুখে ফিরতে থাকে। তার এই অ্যালবামটি তখন বেশ জনপ্রিয় হয়।
তার পরের বছরেই জনপ্রিয় মহিলা ক্যালিপসো শিল্পী মায়া অ্যাঙ্গেলু ‘মিস ক্যালিপসো’ নামের একটি গানের অ্যালবাম বের করেন। অ্যালবামটিও শ্রোতাদের মাঝে বেশ সাড়া জাগায়। মায়া অ্যাঙ্গেলু একজন ক্যালিপসো শিল্পী হিসেবেই শুধু নয়, লেখক হিসেবেও পরবর্তী সময়ে বেশ সুনাম অর্জন করেন। এভাবে বিভিন্ন সময়ে স্বনামধন্য সব সঙ্গীত শিল্পীরা বিশ্ব সঙ্গীত জগতে ক্যালিপসোকে জনপ্রিয় করে তুলতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।
ক্যালিপসো সঙ্গীতে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র
ক্যালিপসোতে মজার মজার শব্দ থাকে। আমাদের চারপাশের মানুষদের ব্যবহৃত সাধারণ শব্দগুলোই ক্যালিপসো সঙ্গীতের মূল উপজীব্য। সেই শব্দের তালে তালে যারা ক্যালিপসোর গানে সুরের ঝঙ্কার তোলেন, তাদের বলা হয় স্টিল ব্যান্ড। ১৯৪০ সাল থেকে স্টিল ব্যান্ডরা প্রথম ত্রিনিদাদে জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ক্যালিপসো সঙ্গীতের প্রধান বাদ্যযন্ত্র হচ্ছে ড্রাম। ক্যালিপসোর বিভিন্ন সুর তোলার জন্য জন্য স্টিল ব্যান্ডরা বিভিন্ন আকারের বিভিন্ন রকম ড্রাম বাজান।
প্রথমদিকে ড্রামগুলো ছিল এলোমেলোভাবে তৈরি। ইস্পাতের তেলের ড্রামের ওপরটা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ড্রামগুলোকে একটা নির্দিষ্ট আকার দেয়া হতো। ধারণা করা হয়, এই তেলের ড্রামগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সেনারা এই দ্বীপপুঞ্জে ফেলে গিয়েছিল। তবে অনেকেই এ বিষয়ে একমত নন। কেউ কেউ মনে করেন, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের খনিজ তেল শিল্প থেকে জোগাড় করা হয়েছিল ড্রামগুলো। বাজনার এই ড্রামকে ‘প্যান’ বলা হয়, এগুলো তৈরি করার জন্য বিশেষ এক শ্রেণীর কারিগর থাকেন।
প্যানের আকৃতি মূলত তিন রকম। সবচেয়ে ছোট প্যান এর নাম ‘পিংপং’। এটি সবচেয়ে উঁচুতে বাজে আর এর স্বরও সবচেয়ে তীক্ষ্ণ। ব্যান্ডের দলটিতে পিংপং দিয়ে গানের সুর বাজানো হয়। মাঝখানের ড্রামটির নাম ‘দ্বিতীয় প্যান’ বা ‘গিটার প্যান’। এর স্বর পিংপং এর চেয়ে নিচুতে, এতে সুরের সঙ্গত করা হয়। সবচেয়ে নিচু স্বর বাজানো হয় ‘তেলো প্যান’ বা ‘ব্যাস প্যান’ এর সাহায্যে। আর গানের সাথে সুরের ছন্দে তাল রাখার জন্য রয়েছে কিম্বল, গায়রো ইত্যাদি আরও নানা রকমের বাদ্যযন্ত্র। এসব বাদ্যযন্ত্রের সাথে গাওয়া হয়ে থাকে ক্যালিপসো।
ত্রিনিদাদ কার্নিভালের এক জনপ্রিয় সঙ্গীত ক্যালিপসো
ত্রিনিদাদ এন্ড টোব্যাগো অঞ্চলের এক জনপ্রিয় সঙ্গীত হলো ক্যালিপসো। ক্যালিপসো এখন এখানকার কার্নিভালের এক প্রধান অনুষঙ্গ। কার্নিভাল হলো লেন্ট পর্বের আগে ত্রিশ দিনব্যাপী সঙ্গীত, শোভাযাত্রা আর অফুরন্ত খাওয়া-দাওয়ার এক বর্ণাঢ্য উৎসব। সাধারণত এই উৎসব ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হয়।
মজার ছন্দ আর বাজনার তালে তালে স্টিল ব্যান্ডের শিল্পীরা ক্যালিপসোর সুরমূর্চ্ছনা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ত্রিনিদাদের রাজধানী পোর্ট অব স্পেনে যে সমস্ত স্টিল ব্যান্ডের সদস্য ক্যালিপসো গাইতে গাইতে রাস্তায় নাচেন, তাদের দলে প্রায় এক হাজার বাদক থাকেন। কার্নিভালের শোভাযাত্রায় হাজার হাজার বাদক যখন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ক্যালিপসো গাইতে থাকেন, তখন এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী এবং আগত দর্শনার্থী সকলেই মেতে ওঠেন এই ক্যালিপসো সঙ্গীতে। এভাবে ক্রীতদাসদের জীবনকাহিনী থেকে উৎসারিত ক্যালিপসো সঙ্গীত আজ সারা বিশ্বের সঙ্গীতের দরবারে তার স্থায়ী আসন করে নিতে সক্ষম হয়েছে।
ফিচার ইমেজ- Hpssociety.info