আট বছরের এক মহাকাব্যিক যাত্রা দেখে এসেছে গেম অব থ্রোন্স। এখন সময় হয়েছে সমাপ্তির। বছর তিনেক আগে এইচবিওর প্রেসিডেন্ট কেসি ব্লয়েজ বলেছিলেন, “সম্ভব হলে আমি আরো অন্তত ১০টা সিজন বানাতাম।” তবে তা তো আর সম্ভব নয়। তাই অষ্টম সিজনেই পর্দা নামবে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় কালচারাল ফেনোমেননের। আগামী সোমবার থেকে শুরু হবে সেই বহুল প্রতীক্ষিত অষ্টম সিজনের। এরপর আরো পাঁচটি সপ্তাহ টানটান উত্তেজনার মধ্যে দিন কাটাতে হবে বিশ্বব্যাপী গট ভক্তদের। আর তারপরই, সব শেষ!
কিন্তু, আসলেই কি শেষ? এই একটি টিভি সিরিজ যেভাবে বদলে দিল আমাদের টিভি ইন্ডাস্ট্রির মানচিত্র, তা কি খুব শীঘ্রই আর বদলাবে? একদিন টিভি কনটেন্ট থেকে যা আশাও করা যেত না, গেম অব থ্রোন্সের মাধ্যমে এখন সেগুলোই চরম বাস্তব। পথপ্রদর্শক হয়তো আর থাকবে না, কিন্তু গেম অব থ্রোন্সের দেখানো পথ ধরে টিভি ইন্ডাস্ট্রির যে উত্তরোত্তর উন্নতি অব্যাহত থাকবে, তা এখনই বেশ আঁচ করা যায়।
গেম অব থ্রোন্স ছাড়াও দ্বিতীয় যে জিনিসটি আমাদের টিভি দেখার অভিজ্ঞতাকে চিরতরে বদলে দিয়েছে, সেটি হলো নেটফ্লিক্স। এই নেটফ্লিক্সের কল্যাণেই এখন আমরা বাস করছি স্ট্রিমিং যুগে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের টিভিতে স্ক্রিপ্টেড অনুষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে গেছে ৮৬ শতাংশ। ২০১১ সালে, অর্থাৎ যে বছর গেম অব থ্রোন্সের প্রথম সিজন পর্দায় এলো, সে বছর মোট অনুষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ২৬৬। আর গত বছর সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৪৯৫ এ।
কিন্তু তারপরও আপনাকে স্বীকার করতেই হবে, টিভি ইন্ডাস্ট্রিকে এক গেম অব থ্রোন্সই যে বড় ধাক্কাটা দিয়েছে, অন্য আর কোনো অনুষ্ঠানই তার ছিটেফোঁটাও দিতে পারেনি।
পুরস্কারের দিক থেকে আর সবার চেয়ে এগিয়ে আছে গেম অব থ্রোন্স। এর চেয়ে বেশি গ্র্যামি আজ অবধি জিততে পারেনি আর কোনো ড্রামাটিক সিরিজই। এখন পর্যন্ত পূর্বের সাত সিজনে ১৩২টি মনোনয়ন পেয়ে ৪৭ বার এমি জিতেছে এই সিরিজ, যার মধ্যে তিনবার ছিল সেরা ড্রামার সম্মাননাও।
দর্শকপ্রিয়তার দিক থেকেও গেম অব থ্রোন্স যোজন যোজন ব্যবধানে পিছনে ফেলেছে আর সবাইকে। এককালে দর্শকদেরকে দ্য সোপরানোস কিংবা সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটির মতো সিরিজ উপহার দিয়েছে এইচবিও। কিন্তু সেগুলোকে পেছনে ফেলে এটিই এইচবিওর সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। সার্বিকভাবে বিগত এক দশকে সবচেয়ে বেশিবার দেখা অনুষ্ঠানগুলোর একটিও এটি। ডিজিটাল দর্শকদেরকে যদি ধরা হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে গেম অব থ্রোন্সের সপ্তম সিজনের প্রতি পর্বের দর্শকসংখ্যা ছিল গড়ে ৩২.৮ মিলিয়ন করে।
এই সংখ্যার ব্যাপকতা যাদের বোধগম্য হচ্ছে না, তাদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখা যায়- ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আরেকটি জনপ্রিয় সিরিজ ম্যাড মেনের ফিনালে দর্শক টেনেছিল মাত্র ৪.৬ মিলিয়ন। এছাড়া ২০০৮ সালের পর থেকে বিবিসির সবচেয়ে বেশি দেখা টিভি সিরিজ হলো ২০১৮ সালের বডিগার্ড। অথচ এটিও যুক্তরাজ্যে সর্বোচ্চ দর্শক পেয়েছিল ১১ মিলিয়ন, যা যুক্তরাষ্ট্রে গেম অব থ্রোন্স সপ্তম সিজনের প্রতি পর্বের দর্শকসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র।
বিগ বাজেট টিভি অনুষ্ঠান নির্মাণের ক্ষেত্রেও গেম অব থ্রোন্সই সবচেয়ে বড় পথিকৃৎ। আজকাল অনেক টিভি অনুষ্ঠানের প্রতি পর্বের বাজেট ৩ মিলিয়ন থেকে শুরু করে এমনকি ১০ মিলিয়ন বা তারও বেশিও হয়ে থাকে, এবং তা মূলত গেম অব থ্রোন্সের কারণেই।
সাহসিকতায়ও গেম অব থ্রোন্স স্রেফ এক ও অদ্বিতীয়। প্রথম সিজনে, যখন গেম অব থ্রোন্স এখনকার মতো জনপ্রিয়তা পায়নি, তখনই তারা নিয়েছিল দুর্ধর্ষ এক সিদ্ধান্ত। ‘ফেস অব দ্য শো’ মনে করা হচ্ছিল যে শন বিনকে, তাকেই তারা মেরে ফেলেছিল প্রথম সিজন শেষ হওয়ার আগেই। এর মাধ্যমে তারা প্রমাণ করে দিয়েছিল, কাহিনীর ভারসাম্যই তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দর্শক ধরে রাখার জন্য কাহিনীর সাথে তারা কোনো আপোষ করবে না। ঠিক এভাবেই, তারা আপোষ করেনি পর্দায় যৌনতা কিংবা সহিংসতার উপস্থাপনেও। টেকনিক্যাল দিক থেকে ড্রাগন কিংবা যুদ্ধের দৃশ্য প্রদর্শনেও তারা কোনো খুঁত রাখেনি।
একটা সময় ছিল যখন টিভি অনুষ্ঠান এবং চলচ্চিত্রের কাহিনীতে যত সাদৃশ্যই থাকুক না কেন, উপস্থাপনের দিক থেকে টিভি ও বড় পর্দার মধ্যে কোনো তুলনাই চলত না। চলচ্চিত্রের রয়েছে অঢেল অর্থ ও সীমাহীন স্বাধীনতা। তাই কাহিনীর প্রয়োজনে তারা যা খুশি দেখাতে পারবে। কিন্তু টিভি অনুষ্ঠানকে সবসময়ই একটা নির্দিষ্ট গন্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে, এমনটাই ছিল অলিখিত নিয়ম। সেই নিয়মকে এক ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে গেম অব থ্রোন্স। এখনকার দিনে টিভি অনুষ্ঠানগুলোতেও যে কাহিনীর প্রয়োজনে যেকোনো কিছু দেখানো হচ্ছে, সেক্ষেত্রে বিশাল অবদান গেম অব থ্রোন্সেরই।
যেমনটি আগেই বলা হয়েছে, গেম অব থ্রোন্স সচেতনভাবে দর্শক ধরে রাখার জন্য বিশেষ কোনো প্রচেষ্টা চালায়নি, কিন্তু হুলু কিংবা অ্যাপলের মতো নতুন নতুন বিনোদন আউটলেটগুলো দর্শকদের আকৃষ্ট করতে এইচবিওর দেখানো পথেই হাঁটছে। অনেক দর্শক এখন জানেও না যে এইচবিওর সামগ্রিক ক্যাটালগে ঠিক কী কী আছে। তারা স্রেফ গেম অব থ্রোন্স দেখার আশাতেই এইচবিও সাবস্ক্রাইব করছে। তেমনি নতুন নতুন আউটলেটগুলোও চাচ্ছে তাদের ক্যাটালগে যেন অন্তত একটি গেম অব থ্রোন্সের মতো অনুষ্ঠান থাকে, শুধু যেটির জন্য মানুষ মাসে ১০ থেকে ১৫ ডলার সাবস্ক্রিপশন ফি গুনতে রাজি থাকবে।
গেম অব থ্রোন্সের অভিষেকের তিন বছর পর নেটফ্লিক্স শুরু করে তাদের নিজস্ব বিগ বাজেট এপিক সিরিজ মার্কো পোলোর নির্মাণ। এটির কাহিনী ছিল মোঙ্গল সাম্রাজ্যকে কেন্দ্র করে। যদিও শেষ পর্যন্ত সিরিজটি ফ্লপ হয়। এদিকে নেটফ্লিক্সের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যামাজন কিনে নিয়েছে লর্ড অব দ্য রিংসের টিভি স্বত্ত্ব, আর এজন্য তারা খরচ করেছে পুরো ২০০ মিলিয়ন ডলার। এখনো তাদের কাছে কোনো স্ক্রিপ্ট নেই। কিন্তু ধারণা করা হচ্ছে, লর্ড অব দ্য রিংসের প্রিকুয়েল সিরিজ নির্মাণে তাদের মোট ব্যয়ের পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। এদিকে অ্যাপলও মুক্তি দেবে জ্যাসন মোমোয়া ও আলফ্রে উডার্ড অভিনীত বিগ বাজেট ফ্যান্টাসি ড্রামা সি, যার কাহিনী আবর্তিত হয়েছে “সকলেই অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর মানবজাতির পরিণতি কী হবে,” এমন থিমকে কেন্দ্র করে।
অর্থাৎ গোটা বিষয়টা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। এইচবিও কেবল গেম অব থ্রোন্সের মাধ্যমেই নিজেদেরকে এক ঈর্ষণীয় অবস্থানে নিয়ে গেছে। তাই নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন, অ্যাপলের মতো সকলেই এখন রয়েছে তাদের নিজস্ব একটি গেম অব থ্রোন্সের খোঁজে, যা তাদের সকল চিন্তার অবসান ঘটাবে। অবশ্য তারা এটা বুঝছে না যে, গেম অব থ্রোন্সের মতো অনুষ্ঠান শতাব্দীতে একবারই আসে। চাইলেই এর অন্ধ অনুকরণ সম্ভব নয়। তাই তো এখন পর্যন্ত গেম অব থ্রোন্সের নিকটতম কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর দেখাও আমরা পাইনি।
অবশ্য অন্যান্য নেটওয়ার্ককেই বা দোষ দিয়ে কী লাভ, যখন এমনকি এইচবিও-ও গেম অব থ্রোন্সের উপর নির্ভরতা কমাতে পারছে না। গেম অব থ্রোন্সের শেষ সিজন শুরু হওয়ার আগে থেকেই তারা ঠিক করে ফেলেছে যে, জর্জ আর আর মার্টিনের বই অবলম্বনেই সামনে এগোবে তারা। আগামী জুনে শুট করা হবে থ্রোন্সেরই প্রিকুয়েলের পাইলট পর্ব।
তবে গেম অব থ্রোন্সের পাশাপাশি এইচবিও এখন অন্যান্য ফ্যান্টাসি ইউনিভার্সকেও বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। আগামী মাসগুলোতে তারা সম্প্রচার শুরু করবে বিতর্কিত এপিক হিজ ডার্ক ম্যাটেরিয়ালসের টিভি অ্যাডাপটেশনের। এছাড়া তাদের জন্য লেফটওভারের সহ-নির্মাতা ড্যামন লিন্ডলোফ তৈরি করছেন কমিক বুক ওয়াচমেন অবলম্বনে সিরিজ। তাদের ভবিষ্যৎ তালিকায় আছে জে জে আব্রামস এবং অ্যাভেঞ্জার্সের পরিচালক জস হোয়েলডন নির্মিত একটি সায়েন্স ফিকশন সিরিজও।
২০১১ সালের এপ্রিলে এইচবিওতে শুরু হয়েছিল গেম অব থ্রোন্স। এর মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই নেটফ্লিক্স শুরু করেছিল এখন পর্যন্ত তাদের অন্যতম সর্বাধিক জনপ্রিয় সিরিজ হাউজ অব কার্ডসের নির্মাণকাজ। এই মুহূর্তে নেটফ্লিক্স অন্য যেকোনো স্টুডিও বা নেটওয়ার্কের চেয়ে বেশি অরিজিনাল অনুষ্ঠান নির্মাণ করছে। তাদের কারণেই মূলত এত বেড়ে গেছে বার্ষিক স্ক্রিপ্টেড অনুষ্ঠানের সংখ্যা। কেবল চলতি বছরেই তারা কনটেন্ট নির্মাণের পেছনে ব্যয় করবে আরো ১০ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে গেম অব থ্রোন্স যখন যাত্রা শুরু করেছিল, পর্বপ্রতি তাদের বাজেট ছিল ৫ মিলিয়ন ডলারের মতো। কিন্তু শেষ সিজনের জন্য তারা পর্বপ্রতি ব্যয় করেছে ১৫ মিলিয়ন ডলার করে। তাদের এই দৃষ্টান্ত ইন্ডাস্ট্রির বাদ-বাকিদেরও এতটাই মনে ধরেছে যে, এখন এমনকি সিজিআই ড্রাগন, হোয়াইট ওয়াকার কিংবা ডায়ারউলভস নেই এমন অনুষ্ঠানগুলোর পেছনেও ব্যয় করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় অ্যাপলের কথা। তারা রিসি উইদারস্পুন ও জেনিফার অ্যানিস্টার অভিনীত একটি মর্নিং টিভি শোর জন্য ২৪০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করে ফেলেছে। অথচ এই অর্থ প্রদানের চুক্তি করার সময়ে অনুষ্ঠানটির কোনো স্ক্রিপ্টও তৈরি ছিল না!
হ্যাঁ, ঠিক এভাবেই টিভি ইন্ডাস্ট্রিকে খোলনলচে পালটে দিয়েছে গেম অব থ্রোন্স। একসময় এই সিরিজটি দেখার সময় অনেক দর্শককেই বিভ্রান্তিতে পড়তে হতো: তারা যা দেখছে তা কি কোনো টিভি সিরিজ, নাকি একটি পুরোদস্তুর চলচ্চিত্র। আজকাল শুধু গেম অব থ্রোন্সই না, প্রায় যেকোনো বিগ বাজেট টিভি সিরিজ দেখার সময়ই দর্শকদের এমন অনুভূতি হয়। তবে সেদিন আর খুব দূরে নয়, যখন দর্শকরা আর এসব ছোটখাট বিষয় নিয়ে আর বিস্মিত হবে না। তারা এগুলোকেই স্বাভাবিক বলে ধরে নিতে শুরু করবে।
গেম অব থ্রোন্সের সার্থকতা এখানেই। টিভি সিরিজ ও চলচ্চিত্রের মধ্যে যে ফারাক ছিল, সেটি তারা ঘুচিয়ে দিয়েছে। তাই তো সাধারণ দর্শকেরা যতটা না উত্তেজিত অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম নিয়ে, তার চেয়ে ঢের বেশি উত্তেজিত গেম অব থ্রোন্সের শেষ সিজন নিয়ে।
বোকা বাক্সের কাছে হার মানবে বড় পর্দা, এ কথা কি কেউ কোনোদিন চিন্তাও করতে পেরেছিল?
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/