বর্তমান সময়টা ডিজিটাল বিনোদনের। ভিজ্যুয়াল বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে যেমন নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইমের মতো স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো নবযুগের সূচনা করেছে, ঠিক তেমনই সঙ্গীত জগতেও বিভিন্ন স্ট্রিমিং সার্ভিসের কল্যাণে এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। সঙ্গীতের জন্য সেরা স্ট্রিমিং সার্ভিস কোনগুলো? নিঃসন্দেহে সকলের মাথায় আসবে স্পটিফাই, গুগল প্লে মিউজিক, অ্যাপল মিউজিক, প্যানডোরা, প্রাইম মিউজিক প্রভৃতির নাম। এছাড়া পুরোদস্তুর মিউজিক স্ট্রিমার না হওয়া সত্ত্বেও, সবচেয়ে বেশি মানুষ এর মাধ্যমেই গান শুনে থাকে বলে, ইউটিউবকেও রাখতে হবে এ তালিকায়।
কিন্তু যদি জানতে চাওয়া হয়, কোন স্ট্রিমিং সার্ভিসটি সঙ্গীত জগতকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে, তাহলে কিন্তু উপরোক্ত কোনোটির নামই আসবে না। বরং আসবে সাউন্ডক্লাউডের নাম। হ্যাঁ পাঠক, ঠিকই পড়েছেন। বিনামূল্যে গান শোনা যায় বলে যে সার্ভিসটি স্পটিফাই কিংবা অ্যাপল মিউজিকের অভিজাত তালিকার অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি, সেটিই সাম্প্রতিক সময়ে সঙ্গীত জগতের সবচেয়ে প্রভাবশালী মিউজিক স্ট্রিমিং সার্ভিস। বিগত কয়েক বছরে অন্য যেকোনো প্ল্যাটফর্মের চেয়ে সাউন্ডক্লাউডকে কাজে লাগিয়েই আত্মপ্রকাশ করেছে সবচেয়ে বেশি সঙ্গীতশিল্পী, এবং তাদের মধ্যে অনেকে এতটাই সফল হয়েছে যে, পুরো বিশ্ব আজ তাদেরকে এক নামে চেনে।
হিপ-হপ সঙ্গীতের প্রাঙ্গনকে খোলনলচে পাল্টে দেয়া সাউন্ডক্লাউডের পথচলা শুরু হয় ২০০৭ সালের জুনে, আলেক্সান্ডার ইজুং ও এরিক ওয়াহলফর্সের হাত ধরে। আনুষ্ঠানিকভাবে এটিকে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় পরের বছর অক্টোবরে। প্রাথমিকভাবে এর লক্ষ্য ছিল সঙ্গীতশিল্পীদের জন্য এমন একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা, যেখানে তারা তাদের রেকর্ডেড অডিও শেয়ার করতে পারবে, এবং সে বিষয়ে আলোচনা করতে পারবে। কিন্তু খুব শীঘ্রই এটি পরিণত হয় মূলধারার বাইরে, উঠতি সঙ্গীতশিল্পীদের সৃষ্টিকর্ম প্রকাশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যমে। ইতিপূর্বে যারা বিভিন্ন মিউজিক লেবেলের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও পাত্তা পায়নি, পায়নি কাঙ্ক্ষিত ‘ব্রেক’, তারাই দলে দলে নিজস্ব প্রোফাইল তৈরি করতে থাকে সাউন্ডক্লাউডে, এবং সেখানে নিজেদের গান প্রকাশের মাধ্যমে বড় ধরনের ভক্তগোষ্ঠীও পেয়ে যেতে থাকে।
সাউন্ডক্লাউডের মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে শুধু র্যাপারই এত বেশি উঠে এসেছে যে, সঙ্গীত জগতে ‘সাউন্ডক্লাউড র্যাপার’ শব্দযুগল এখন দারুণ জনপ্রিয়। অনেকেই হয়তো জেনে অবাক হবেন যে, আপনাদের অনেক প্রিয় সঙ্গীতশিল্পী, যাদের গান এখন আপনাদের প্রতিদিনের প্লে-লিস্টের বড়সড় জায়গা দখল করে থাকে, এমনকি বিলবোর্ড টপ ১০০ চার্টেও যাদেরকে আজকাল প্রায়ই দেখা যায়, তাদের অনেকেই কিন্তু শুরু করেছিলেন সাউন্ডক্লাউড থেকেই।
এক্সএক্সএক্স টেনটাসিওন, পোস্ট ম্যালোন, লিল পাম্প, ট্র্যাভিস স্কট, প্লেবয় কার্টি, লিল ইয়টি, লিল উজি ভার্ট- এরা সকলেই কিন্তু সাউন্ডক্লাউডেরই আবিষ্কার। তারা প্রত্যেকেই সাউন্ডক্লাউডে একেবারে শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন। নিজস্ব প্রোফাইল তৈরি করে নিজেদের গান সেখানে পোস্ট করেছিলেন, এবং সেই গানের সুবাদেই তারা জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকেন, তাদের প্রোফাইলে হাজার হাজার ফলোয়ার যুক্ত হতে থাকে। বাণিজ্যিকভাবে প্রকাশ না করা সত্ত্বেও তাদের অনেক গান এত বেশি জনপ্রিয়তা পায় যে, আগামী পঞ্চাশ বছরেও হয়তো সেগুলোর আবেদন ফুরোবে না।
পোস্ট ম্যালোনের প্রথম অডিও অ্যালবাম ‘স্টোনি (ডিলাক্স ভার্সন)’ মুক্তি পায় ২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর। কিছুদিনের মধ্যেই সেটি বিলবোর্ড টপ ১০০ চার্টের শীর্ষস্থানে পৌঁছে যায়, এবং টানা ১৭ সপ্তাহ তালিকায় নিজের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়। তার অ্যালবাম মাত্র ছয় মাসেরও কম সময়ে প্ল্যাটিনাম খেতাব পেয়ে যায়। এর সাড়ে ছয় মাস পর সেটি ডাবল প্ল্যাটিনাম খেতাব লাভ করে। ঐ অ্যালবামের যে গানটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, সেটি হলো ‘কংগ্র্যাচুলেশন্স’। গানটি প্রকাশের মাত্র সাড়ে তিন মাসের মধ্যে প্ল্যাটিনাম খেতাব পায়, এবং এক বছর তিন মাসের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে সাত মিলিয়ন ইউনিটের বেশি বিক্রি হয়।
সাউন্ডক্লাউড থেকে উঠে আসা এমন আরেকজন দারুণ জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী হলেন লিল পাম্প। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে তিনি ছিলেন বিশ্বের সর্বাধিক আলোচিত নবীন শিল্পীদের একজন। ২০১৭ সালের ৬ অক্টোবর তার প্রথম অ্যালবাম ‘লিল পাম্প’ প্রকাশিত হয়। ঐ অ্যালবামের একটি গান, ‘গুচ্চি গ্যাং’, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭-তে মুক্তির চার মাসের কিছু বেশি সময়ের মধ্যেই প্ল্যাটিনাম খেতাব পায়।
এভাবেই তরুণ সঙ্গীতশিল্পীদের জন্য পরম নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেছে সাউন্ডক্লাউড। একটা সময় ছিল যখন কোনো প্রতিষ্ঠিত মিউজিক লেবেলের সহায়তা ছাড়া একক প্রচেষ্টায় কোনো সঙ্গীতশিল্পীর পক্ষে বড় কিছু করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু সাউন্ডক্লাউডের কারণে এখন অবস্থার ৩৬০ ডিগ্রি পরিবর্তন হয়েছে। ইতিপূর্বে বড় বড় লেবেলের অফিসে ধর্না দিয়েও যারা পাত্তা পায়নি, সাউন্ডক্লাউডের মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভের পর সেই মিউজিক লেবেলগুলোই এখন তাদেরকে চুক্তিবদ্ধ করতে মরিয়া হয়ে উঠছে।
সার্বিকভাবে সঙ্গীত জগতে সাউন্ডক্লাউড এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এমন সব পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে সঙ্গীত জগতে, যা কেউ আগে কখনো ভাবতেও পারেনি। চলুন, দেখে নিই সাউন্ডক্লাউডের বদৌলতে হওয়া সবচেয়ে বড় পরিবর্তনগুলো কী কী।
বাড়ছে স্বাধীন শিল্পীর সংখ্যা
সঙ্গীতশিল্পীদেরকে এখন আর পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হচ্ছে না। আগে তাদেরকে মিউজিক লেবেলগুলোর মন জুগিয়ে চলতে হতো। ফলে তাদের নিজেদের সৃষ্টিশীলতা ব্যাহত হতো। কিন্তু সাউন্ডক্লাউডে নিজের ইচ্ছামাফিক গান প্রকাশ করা যায় বলে, সঙ্গীতশিল্পীরা গানের সুর, কথা, গায়কী সবকিছুতেই সর্বোচ্চ স্বাধীনতা উপভোগ করছে। সফলতা লাভের কোনো পূর্ব চাপেও তাদেরকে ভুগতে হচ্ছে না। হ্যাঁ, এ কথা হয়তো ঠিক যে তাৎক্ষণিকভাবেই আর্থিক লাভের দেখা মিলছে না, তবে তারা নির্ভার হয়ে নিজেদেরকে প্রমাণের সুযোগ পাচ্ছে। পাশাপাশি তারা জানছে, কোনোভাবে যদি একবার শ্রোতাদের মন জয় করা যায়, তাহলেই তাদের সামনে চলে আসবে অসংখ্য আকর্ষণীয় সুযোগ।
কমছে মিউজিক লেবেলদের আধিপত্য
দশকের পর দশক ধরে মিউজিক লেবেলগুলো শিল্পী ও শ্রোতা সকলের উপর ছড়ি ঘুরিয়ে এসেছে। কোন সময় কোন ধরনের গান চলবে, তা লেবেলগুলোই নিয়ন্ত্রণ করেছে। শিল্পীরা তাদের কথা মেনে চলতে বাধ্য ছিল, আর লেবেলগুলো যা প্রকাশ করত, নিরুপায় সাধারণ শ্রোতাদেরকেও সেগুলোই শুনতে হতো। কিন্তু এখন আর কোনো বাণিজ্যিক পলিসি থাকছে না, ফলে লেবেলগুলোর আধিপত্যও খর্ব হচ্ছে। এদিকে সাউন্ডক্লাউডে বিনামূল্যে সব গান শোনা যায় বলে, শ্রোতাদেরকে সাবস্ক্রিপশন বা পেমেন্টের ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে না। ফলে অন্যান্য স্ট্রিমিং সার্ভিসের তুলনায় এখানে নতুন শিল্পীদের গান চালানোর হারও বেশি থাকছে। এভাবে শিল্পী ও শ্রোতা উভয়ই লাভবান হচ্ছে।
সৃষ্টি হচ্ছে শিল্পী ও শ্রোতাদের সেতুবন্ধন
আগে শিল্পী ও শ্রোতাদের মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়াত রেকর্ড কোম্পানিগুলো। ফলে তাদের বাধা এড়িয়ে শিল্পী ও শ্রোতাদের পক্ষে পরস্পরের কাছে পৌঁছানো অনেক কঠিন ছিল। কিন্তু এখন সাউন্ডক্লাউডের কল্যাণে শিল্পীরা সরাসরি শ্রোতাদের কাছ থেকে তাদের গানের প্রতিক্রিয়া, প্রশংসা ও সমালোচনা জেনে নিতে পারছে। আর শ্রোতারাও শিল্পীদের সাথে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের পছন্দ-অপছন্দ ও ভবিষ্যৎ চাহিদার কথা ব্যক্ত করতে পারছে।
শিল্পীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে
ইতিপূর্বে সরাসরি শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া জানার কোনো উপায় ছিল না বলে, শিল্পীদের কাজ অনেকটা আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ার মতোই ছিল। তারা জানতেও পারত না, কোন ধরনের গান শ্রোতারা পছন্দ করবে, আর কোনগুলো থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেবে। কিন্তু সাউন্ডক্লাউডের মাধ্যমেই প্রথম তারা দ্রুততম সময়ে, সরাসরি শ্রোতাদের কাছ থেকে ভালো-মন্দ মন্তব্য পেতে শুরু করে। এর ফলে তারা দর্শকদের রুচিবোধ সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা লাভ করে, পাশাপাশি বুঝতে পারে কোন ধরনের গান বানালে তাদের সাফল্যের সম্ভাবনা আরো জোরালো হবে। এভাবেই শিল্পীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে, সার্বিকভাবে তাদের সৃষ্টিকর্মের গুণগত মান বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মিউজিক লেবেলগুলো সহজেই যোগ্য শিল্পী খুঁজে পাচ্ছে
ইতিপূর্বে মিউজিক লেবেলগুলোর কাজও অনেক বেশি কঠিন ছিল। নতুন কোনো শিল্পীর অ্যালবাম বা একক প্রকাশের ক্ষেত্রে তাদেরকে অনেক বড় ঝুঁকি নিতে হতো, কারণ একটি অ্যালবাম বা একক প্রকাশের আগে তো তাদের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না যে ঐ শিল্পী শ্রোতাদের মন জয় করতে পারবে কি না। কোনো শিল্পী তা করতে পারলে তাদের বাজিমাৎ হতো বটে, কিন্তু ব্যর্থ শিল্পীদের ব্যর্থতার দায়ও তাদেরই নিতে হতো, আর্থিক ক্ষতিটাও তাদেরই হতো। তবে এখন শিল্পীরা আগে থেকেই সাউন্ডক্লাউডের মাধ্যমে শ্রোতাদের ভালো লাগার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আসছে, পাশাপাশি তাদের নির্দিষ্ট একটি ভক্তগোষ্ঠীও তৈরি হয়ে থাকছে। তাই তাদের উপর লেবেলগুলোকে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ বাজি ধরতে হচ্ছে না। তারা আগে থেকেই নিশ্চিত থাকতে পারছে যে, সাউন্ডক্লাউডে সফল একজন শিল্পীর পেছনে বিনিয়োগ করলে, সেই অর্থ অবশ্যই ফিরে আসবে।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/