ছয় সন্তানের জননী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি এ বছর ৪৩ এর ঘরে পা দিলেন। বয়স বাড়ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দায়িত্ব, দুশ্চিন্তা, এগিয়ে যাওয়ার তাড়না। “বয়সের সাথে সাথে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, উপলব্ধি, চিন্তার স্বচ্ছতা তো বাড়ছেই, সেই সাথে নারীসুলভ কমনীয়তা, সৌন্দর্যও কিন্তু একটুও পিছিয়ে নেই,” বলছিলেন লাখো দর্শকের মন জয় করা জনপ্রিয় হলিউড অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং মানবহিতৈষী আঞ্জেলিনা জোলি।
“বয়সের সঙ্গেই নারী, পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের সবার মধ্যকার মানুষ সত্ত্বাটা জেগে ওঠে। এই সত্ত্বার কাছে হেরে যায় যাবতীয় কুটিলতা, পঙ্কিলতা,” আয়নায় তাকিয়ে আজকাল নিজের সাথে এসব বোঝাপড়াই হয় তার। রূপালি দর্পণে ইদানিং যাকে দেখতে পান তার সাথে নাকি মা মার্শেলিন বার্ট্রান্ডের চেহারার অদ্ভুত মিল রয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় তার মধ্য দিয়ে মা-ই যেন পৃথিবীর বুকে ফিরে এসেছেন, বিষয়টি দারুণ উপভোগ করেন জোলি।
২০০৭ সালে জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মার্শেলিন। মেয়ের মতো তিনিও ছিলেন সুঅভিনেত্রী, মানবদরদী। তার টানেই গুয়েরলেইনের সুগন্ধি গৃহে ছুটে আসেন জোলি। গত বছর তাদের নতুন পারফিউম ‘মন গুয়েরলেইনের’ মোড়ক উন্মোচিত হওয়ার আগপর্যন্ত, বিগত দশ বছর এই অস্কার জয়ী অভিনেত্রী কোনো সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় হাজির হননি। কিন্তু এই সুগন্ধি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লরেন্ট বয়লট যখন জোলির কাছে তাদের প্রতিযোগিতায় অতিথি হবার আমন্ত্রণ জানালেন, চকিতে তার মনে পড়ে গেল গুয়েরলেইনের ফেস পাউডারের রীতিমতো ভক্ত ছিলেন তার মা।
“মাকে আমরা খুব একটা সাজতে দেখিনি। কিন্তু মা সবসময় বিশেষ অনুষ্ঠানে মাখার জন্য গুয়েরলেইনের পাউডারটা আলাদা করে রেখে দিত,” এ বছরের অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে হ্যালো ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেছেন তিনি। “গুয়েরলেইনের নামটা শুনলেই খুব ফ্যান্সি একটা ফ্রেঞ্চ ব্র্যান্ডের কথা মাথায় আসতো, যার সাথে জড়িয়ে রয়েছে মায়ের স্মৃতি”।
গত বছর গোল্ডেন গ্লোব এবং বাফটা পুরস্কারের মনোনয়ন পাওয়া জোলি পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘ফার্স্ট দে কিলড মাই ফাদার’ মুক্তির পর আবারও রূপালি জগতে পা রেখেছেন তিনি। এ বছর ডিজনির ‘দ্য ওয়ান অ্যান্ড অনলি ইভান’ চলচ্চিত্রের একটি চরিত্রে কণ্ঠ দিয়েছেন। অভিনয় করছেন সাড়া জাগানো মুভি ‘ম্যালিফিসেন্ট’ এর সিক্যুয়াল ‘ম্যালিফিসেন্ট ২’ এ। যুক্তরাজ্যে চলছে সিনেমাটির শুটিং, এরই এক ফাঁকে বর্তমান জীবনের নানা গল্পের ডালি খুলে বসেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি।
বাচ্চারা তার কাজে কতটা অবদান রাখে সেই প্রসঙ্গে জানালেন অজানা কিছু তথ্য।
“আর দশজন বাবা-মায়ের মতো নতুন কোনো কাজে হাত দেওয়ার আগে শুরুতেই মাথায় আসে পরিবারের কথা। ‘দ্য ওয়ান অ্যান্ড অনলি ইভান’ বইটি শিলোর খুব পছন্দের, হঠাৎ একদিন দৌড়ে এসে বইটা আমাকে দেখালো সে। তারপরই সিদ্ধান্ত নিলাম এই বই নিয়ে সিনেমা বানালে সেই প্রজেক্টে কাজ করবো। আহত হাতি আর গণ্ডারদের দেখাশোনার জন্য একটা অভয়ারণ্য আছে কলম্বিয়ায়, শির (শিলো) নামেই সেটার নামকরণ করা হয়েছে। আর এই মুভিতে আমার চরিত্রের নাম স্টেলা দ্য এলিফ্যান্ট। এই অভয়ারণ্যগুলোকে আমি ‘মানুষ যেখানে ক্ষতিপূরণ করতে আসে’- এই নামেই ডাকি। ‘কাম অ্যাওয়ে’ নামে পিটার প্যান সিরিজের একটা প্রিকুয়েল করছি আমি। পিটার প্যানের হয়ে কাজ করে পথশিশুদের জন্য নির্মিত একটি হাসপাতাল, ‘গ্রেট অর্মোন্ড স্ট্রিট চিল্ড্রেন’স হসপিটাল’। আমার বাচ্চারা অসহায়, অধিকার বঞ্চিত এই মানুষগুলোর প্রতি দারুণ আকর্ষণ অনুভব করে”।
‘ম্যালিফিসেন্ট ২’ এর শুটিংয়ে তার সাথে যুক্তরাজ্যে এসেছে বাচ্চারাও। তারা এই ট্যুরটা কতটা উপভোগ করছে তা বলতে গিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন জোলি।
“এমনিতেই ঘুরতে খুব পছন্দ করে বাচ্চারা। নতুন কোনো অ্যাডভেঞ্চারে বেরোনোর আগে ওদের একগাদা আবদার মেটাতে খুব ভালো লাগে আমার। ব্যাগ গোছাতে গেলে বোঝা যায় কতটা উত্তেজনা কাজ করছে ওদের মধ্যে। ওদেরকে আমি ‘স্বনির্ভর অভিযাত্রী’ বলে ডাকি। শির বইয়ের সংখ্যা সবসময় জামা-কাপড়ের চেয়ে বেশি হয়। জাহারা একদম পারফেক্টভাবে সবকিছু গুছিয়ে নেয়”।
সারা দুনিয়ার খোঁজখবর কখন রাখেন জানতে চাইলে উত্তর দেন, মেকআপ চেয়ারে বসেই ওসব কাজ সারতে হয়। “ঐ সময়টুকু সংবাদ পড়ি বা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার সাথে পরবর্তী কোন শরণার্থী শিবিরে যেতে হবে সেসব পরিকল্পনা করি বা বক্তব্য তৈরি করি,” ব্যাখ্যা করলেন তিনি। আর যদি একান্ত অবসর পেয়েই যান, তবে নিজের সাথে কিছুটা সময় কাটাতে বেশ ভালো লাগে জোলির।
লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন জগতের উজ্জ্বল তারকা জোলি ব্যক্তিগত জীবনে হইচই একদমই পছন্দ করেন না। “সরলতা পছন্দ করি আমি। যেমন- এক তেলেই চুল, ত্বক, শরীর সব মসৃণ থাকবে, এমন জিনিসই বেছে নেই। নারী হিসেবে যতটা যত্ন পাওয়া উচিত, ততটা আমরা পাই না বলেই আমার মনে হয়। কাজেই নিজের যত্ন নেয়া, নিজেকে মূল্যায়ন করা আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব। লোকে কী করবে তার উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজেই নিজেকে গুরুত্ব দেয়া শিখতে হবে,” এভাবেই একা একা এতটা পথ চলেছেন বলে জানালেন জোলি।
মা হিসেবে জোলি যা যা করেন, শুনলে চমকে যাবে অনেকেই। “বাচ্চাদের চুল আমি কাটি। ধরা-বাধা কোনো নিয়ম নেই যে আমাকেই এটা করতে হবে। কিন্তু ওরা এসে আমার কাছে আবদার ধরে, আমারও ভালো লাগে কাজটা করতে,” ‘মি. অ্যান্ড মিসেস স্মিথ’ মুভির নায়িকা তার মায়ের মতো করে সন্তানদের দেখভাল করতে চান। তার মা যে পাউডারটি ব্যবহার করতেন, সেটিই আবার নতুন করে ফিরিয়ে আনছে গুয়েরলেইন। বড়দিনের আগ দিয়ে এমন একটি সংবাদে স্বভাবতই বেশ উচ্ছ্বসিত জোলি। “এই পাউডারটা মায়ের কাছে স্পেশাল ছিল। সিঙ্গেল মাদার হিসেবে একাই আমাকে বড় করেছেন তিনি। অভিনয় জীবনের পাশাপাশি সন্তানদের দেয়ার মতো তেমন একটা সময় তার ছিল না। তারপরও তিনি আমাদের জন্য যা করেছেন, তার জন্য আমরা চিরঋণী। তার সৌজন্যে গুয়েরলেইন পাউডারটি নতুনভাবে আনছে, এটা জানলে মা খুব খুশি হতেন”।
আজকের দিনে নারীবাদ নিয়ে অনেক কাজ করছে গুয়েরলেইন। অ্যাঞ্জেলিনা জোলির কাছে নারীদের অধিকার খুব গুরুত্বপূর্ণ।
“নারীবাদ কোনো একক বিষয় নয়। স্থান, কাল, পাত্র ভেদে নারীবাদের রূপ পরিবর্তিত হয়। আপাতদৃষ্টিতে নারীদের কোমল, নমনীয় মনে করা হলেও অধিকার আদায়ের দাবীতে তারাও কিন্তু হতে পারে সোচ্চার। মেয়েরা এখন বুঝে গেছে তাদের কোমলতাকে দুর্বলতা মনে করে তাদের অপব্যবহার করার চেষ্টা করছে কিছু মানুষ। মা হিসেবে তারা যতটা শারীরিক কষ্ট সহ্য করে, সেই প্রেক্ষাপট থেকে ভাবলে আরও অনেক বেশি সম্মান তাদের প্রাপ্য। প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে অনেক বেশি মায়া দিয়ে। অন্যের দায়িত্ব নিতে নিজেদেরও যত্নের প্রয়োজন, সেই কথাটি আমরা ভুলেই যাই। প্রতিটি মানুষই একজন আরেকজনের থেকে আলাদা। নিজেকে নিজের মতো করে উপস্থাপন করতে পারাই প্রকৃত সৌন্দর্য। অহেতুক সুন্দর হতে গিয়ে কাউকে অনুকরণ করে নিজের স্বাভাবিক সৌন্দর্য নষ্ট করা নিছকই বোকামি।”
নিজের নারীসত্ত্বার সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ হিসেবে বাচ্চাদেরকেই মানেন জোলি।
“প্রতি বছর আমরা একটু একটু করে বড় হই, একটু একটু করে বদলে যাই। জীবনে অনেক চড়াই-উৎরাই থাকে। সেগুলো মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। নারী হিসেবে সমতা বলতে আমার কাছে সবকিছু করার সমান অধিকারই যথেষ্ট নয়, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারার স্বাধীনতাই আমার সমতা। পুরুষ বিদ্বেষী হয়ে নয়, বরং পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। বাচ্চাদের নারীবাদের প্রকৃত সংজ্ঞা শেখাতে হবে। নারীবাদের নাম করে আমরা যেন পুরুষবিদ্বেষী একটি প্রজন্ম গড়ে না তুলি সেটা খেয়াল রাখতে হবে। শক্তিশালী নারী রোল মডেলদের উপস্থাপন করে তাদের বোঝাতে হবে প্রকৃত বিজয়ী কারা”।
অনেকেই হয়তো জানেন না বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই লাস্যময়ী অভিনেত্রীর রয়েছে পাইলট লাইসেন্স। “ওড়ার সময় মনে হয় আমি সত্যি সত্যিই পাখির মতো মুক্ত, স্বাধীন। অভিনয়ের বাইরে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে খুব ভালো লাগে। শরণার্থীদের সাথে দেখা করতে কিংবা আন্তর্জাতিক নানা ইস্যুতে কাজ করতে পছন্দ করি”।
শরণার্থী সমস্যা নিয়ে নিজের মতামত জানালেন জোলি, “বৈশ্বিক কূটনীতি আর রাজনীতিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে মানবাধিকার আদায় করতে হবে। যারা সাধারণ মানুষের অধিকার দিতে জানে না, তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনে জোর করে অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে। আমরা যদি এখনো শরণার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতা তৈরি করতে না পারি, তাহলে পৃথিবী থেকে সংঘাত কখনো কমবে না। আন্তর্জাতিকভাবে এখনো ৬০ মিলিয়নের বেশি শরণার্থী ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এই মানুষগুলো প্রতিদিন একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তাদেরকে বাঁচানোর দায়িত্ব আমাদের সবার”।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ব্র্যাড পিটের সাথে ১১ বছরের যৌথ ও ২ বছরের বিবাহিত জীবনের ইতি টেনে সন্তানদের অভিভাবকত্ব নিয়ে লড়ছিলেন জোলি। তাদের ৬ সন্তানের মধ্যে ৩ জন দত্তক নেয়া। সম্প্রতি সন্তানদের দায়িত্ব নেয়ার বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে সমঝোতা হয়ে গেলেও সেই সমঝোতার ফলাফল যে কী হয়েছে তারা কেউই তা জনসম্মুখে প্রচার করেননি। তবে জোলি এককভাবেই সন্তানদেরকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন বলে জানা যায়। জোলি জানান, তিনি ভালো আছেন, সন্তানরা বাবার সাথে সময় কাটাতে চাইলে তার কোনো আপত্তি নেই। সন্তান আর ক্যারিয়ার নিয়েই আগামীর দিনগুলোতে এগিয়ে যেতে চান অপ্রতিরোধ্য জোলি।