ধরুন, আপনি ৯০ দশকের অত্যন্ত জনপ্রিয় এক টিভি শো ‘ফ্রেন্ডস’ দেখছেন। চ্যান্ডলার একটি জোক বলল, অসাধারণ সারকাজম, অসাধারণ পাঞ্চ লাইন। আপনি হাসছেন, দৃশ্যে মনিকা, জোয়ি, র্যাচেল, রস, ফিবি সবাই হাসছে। কিন্তু তা-ও যথেষ্ট নয়। দৃশ্যের মধ্য থেকেও আপনি দর্শকের হাসির শব্দ, হাততালির শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। শুধুমাত্র ফ্রেন্ডস নয়, অন্যান্য জনপ্রিয় টিভি শো, যেমন বিগ ব্যাং থিওরি, দ্য সেভেন্টিস শো, হাও আই মেট ইউর মাদার, টু অ্যান্ড আ হাফম্যান- ইত্যাদি জনপ্রিয় সিটকম কমেডি টিভি শোতেও এ ধরনের হাসির শব্দ শুনতে পাওয়া যায়।
এই হাসির কারণ কী?
এ ধরনের হাসির অনেক নাম রয়েছে। ফিল্মি জগতে এর নাম ক্যানড লাফ ট্র্যাক। কিছু কিছু শোতে এ ধরনের লাফ ট্র্যাক আগে থেকে রেকর্ড করা থাকে, আবার কিছু জায়গায় এগুলো শুধুই সাউন্ড ডিজাইনের খেলা। কিন্তু কেন দরকার পড়ে এ ধরনের লাফ ট্র্যাকের? বর্তমান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এ নিয়ে সমালোচনাও কিন্তু কম নয়। তবে আলোচনা-সমালোচনা জানার আগে চলুন, আগে জেনে নেওয়া যাক এর ইতিহাস।
ইতিহাস
অনেকদিন আগের কথা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তখন মাত্রই টিভি শোগুলো জনপ্রিয় হওয়া শুরু করেছে। তখন এ ধরনের শো সিঙ্গেল ক্যামেরা দিয়ে শ্যুট করা হতো। অর্থাৎ, একটি মঞ্চে অভিনেতারা পারফর্ম করতেন, সামনে এক বিশাল সারির দর্শক সরাসরিই সেই অনুষ্ঠান উপভোগ করতেন এবং পরে শুধু মাত্র একটি স্টিল ক্যামেরা দিয়ে তা রেকর্ড করে অনুষ্ঠানটি টিভিতে প্রচার করা হতো। তবে তখন অনুষ্ঠান পরিচালকদের একটি বেশ বড় সমস্যার সম্মুখীন হতে হলো কমেডি শো নিয়ে। স্বাভাবিক ভাবেই শোগুলোর সাথে দর্শকদের সম্পৃক্ততা সবচেয়ে বেশি। একেকটি পাঞ্চ লাইনের পর দর্শকেরা তুমুল করতালি দিতেন এবং প্রাণ খুলে হাসতেন। তবে সমস্যা তৈরি হলো, যখন মাঝে মাঝে এই হাসির সময়টা বেশ দীর্ঘ হয়ে যায় এবং পরিচালক নির্দিস্ট পাঞ্চ লাইনের পর যেরকম হাসি আশা করছিলেন, অনেক জায়গাতেই সেটা পাচ্ছিলেন না।
হলিউডের অনেকেই এই স্বাভাবিক সত্যটি মেনে নিয়েছিলেন। তবে অনেকেই সরাসরি অনুষ্ঠানটি উপভোগ করা দর্শকদের এই ভুল জায়গায় দীর্ঘ সময়ের হাততালির ব্যাপারটি পছন্দ করত না। তাদের পক্ষের যুক্তিটি ছিল, দর্শকদের ভুল জায়গায় হাসা এবং হাততালির ব্যাপারটা টেলিভিশন শো-এর সৌন্দর্য নষ্ট করে এবং অনেকেই আসল পাঞ্চলাইনের পর হাসে না। আরেকটি বড় সমস্যা ছিল, দর্শকরা কতক্ষণ ধরে হাততালি দেবে, তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিলো না। দীর্ঘ সময় ধরে দর্শক প্রতিক্রিয়া দেখাতে থাকলে পাঞ্চলাইনের পরের সংলাপটিও শেষ পর্যন্ত শোনা যেত না। রূপালি দুনিয়ার অনেকেই এই সমস্যাগুলো নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলেন।
তেমনই একজন ছিলেন আমেরিকান সাউন্ড ডিজাইনার চার্লি ডাগলেস। তিনি তখন কাজ করছিলেন জনপ্রিয় টেলিভিশন ব্রডকাস্টিং কোম্পানি সিবিএস-এ। তিনি যে টিভি শোগুলোতে কাজ করতেন সেখানে আগে থেকেই এডিটিংয়ে প্রয়োজনমতো সরাসরি দর্শকদের হাসির শব্দ কাটতেন অথবা জোড়া লাগাতেন। অর্থাৎ, তার এডিট করা টিভি শোগুলোতে আসল দর্শকদের হাসির শব্দ শোনা যেত না।
১৯৫০ সালের দিকে তিনি একটি বিশেষ যন্ত্র বানিয়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে ফেললেন। সে যন্ত্রের নামই ‘লাফ বক্স’। এই যন্ত্র থেকে বোতাম টিপলেই মানবসৃষ্ট বিভিন্ন হাসি এবং হাততালির আওয়াজ বের হয়। একেকটি বোতামে একেক ধরনের হাততালি এবং হাসির শব্দ সেট করা ছিল। ডাগলেস এটি ব্যবহার করেই এডিটিং করতেন। রাতারাতি এই হাসির বাক্স বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আমেরিকা থেকে ব্রিটেন, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কমেডি টিভি শোগুলোতে এর পর থেকে লাফস বক্সের ব্যবহার শুরু হয়ে গেল।
মানুষের মনস্তত্ত্বে লাফ ট্র্যাকের প্রভাব
তবে দিন বদলাচ্ছিল, এখন আর সিঙ্গেল ক্যামেরার যুগ নেই। কমেডি শোগুলোও এখন নিজস্ব প্রোডাকশনে একাধিক ক্যামেরা দিয়ে শ্যুট করা হয়। লাইভ দর্শকের যুগটিও আর নেই। এর ফলে লাফ বক্সের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে গেল আরো। পরিচালকরা লক্ষ করলেন, মানুষ আগে থিয়েটারে বসে যখন কমেডি শো উপভোগ করত, সবাই এক সাথে হাসত এবং সেটা বেশ প্রাণবন্ত ছিল। এখন সেই একই শো যখন একজন দর্শক একা টিভিতে বসে দেখছেন, তখন সেই কমেডি দৃশ্যগুলো অতটা প্রাণবন্ত হচ্ছে না। এখন যদি টিভির মধ্য থেকেই হাসির শব্দ আসে, তাহলে দর্শকের মনে হবে, তিনি সবার সাথেই হাসছেন। ফলে লাফ বক্স সরাসরি দর্শকদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
তবে অনেক বাজে উদ্দেশ্যেও লাফ বক্স ব্যবহার করা হতো, বোরিং একটি দৃশ্যেও হাসির শব্দ যোগ করে সেটিকে জোর করে হাসির দৃশ্য বানানো হতো। ইউটিউবে ‘ফ্রেন্ডস’ টিভি শো’র কিছু দৃশ্য লাফ ট্র্যাক ছাড়া দেখলে আপনাকে বেশ অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হবে। যে দৃশ্যটি দেখে আপনি হেসেছিলেন, সেই একই দৃশ্য ক্যানড লাফ ট্র্যাক বাদ দিয়ে দেখলে আপনার আগের মতো সেই হাসিটা আর আসবে না। অর্থাৎ, লাফ ট্র্যাক যোগ করা যে দৃশ্যটি ‘কমেডি’ ছিল, সেই একই দৃশ্য লাফ ট্র্যাক উঠিয়ে নিলে অস্বস্তিকর আর গুরুগম্ভীর হয়ে যায়।
এ ব্যাপারে ব্রিটিশ স্নায়ুবিজ্ঞানী সোফি স্কট একটি প্রাসঙ্গিক কথা বলেছিলেন,
“What this study shows is that adding laughter to a joke, increases the humor value, no matter how funny or unfunny the joke is.”
অর্থাৎ,
“এই গবেষণায় দেখা গেছে, হাসি যোগ করে একটি কৌতুকের হাস্যরস বেড়ে যায়, তা সেটি হাসির হোক বা না হোক।”
সমালোচনা
লাফ বক্স প্রথম থেকেই সমালোচনার মুখে পড়েছিল। অনেক মার্কিন দর্শকই চাইছিলেন না, তাদের কেউ এটা কেউ শিখিয়ে দিক যে কোথায় হাসতে হবে এবং কোথায় হাততালি দিতে হবে। পরবর্তী সময়ে কমেডি জনরাতে নতুন কিছু কলা-কৌশল আসা শুরু করল।ফলে ক্যানড লাফ ট্র্যাকের ব্যবহার ছাড়া দ্য অফিস ব্রুকলিন নাইন নাইন, সিলিকন ভ্যালির মতো বেশ কিছু জনপ্রিয় কমেডি শো আমরা দেখতে পাই।
শেষ কথা
১৯৫০ সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল চার্লি ডাগলেসের এই লাফ বক্স, যে ধারণাটি বর্তমান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এখনো ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে সরাসরি কমেডি অনুষ্ঠানগুলোতে লাফ ট্র্যাকের ব্যবহার কমে গেছে। সর্বশেষ লাফ ট্র্যাকের দেখা আমরা পাই ২০১৮ সালে, বিগ ব্যাং থিওরির সিজন ফিনালেতে।
এই লাফ ট্র্যাক নিয়ে অনেক সমালোচনার পরেও অনেক দর্শক এখনো তা পছন্দ করেন। চিন্তা করুন, সারাদিন ব্যস্ত সময় কাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে আপনি যখন একা বাড়ি ফিরবেন এবং একা একাই আপনার প্রিয় টিভি শোটি দেখা শুরু করবেন, আপনি কি এই অনুভূতিটি নিতে চাইবেন না, যে আপনার সাথে অন্য কেউও হাসছে? একা থেকেও সবাই মিলে একসাথে হাসার অনুভূতিটি আমাদের এনে দিয়েছিল চার্লি ডাগলেস এবং তার বিখ্যাত যন্ত্র ‘লাফ বক্স’।