এই পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে কত আশ্চর্য সব জাদুঘর! কোথাও পেন্সিলের জাদুঘর, কোথাও হাতপাখার, আবার কোথাও হাতুড়ির। এরকম অসংখ্য মজার জাদুঘর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। প্রথমদিকে নিতান্তই শখের বশে কিংবা স্থানীয় কোনো ঐতিহ্যকে টিকেয়ে রাখার জন্য স্থানীয় বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে এসব জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পরবর্তীকালে এসব জাদুঘরের অনেকগুলোরই পরিসর বেড়েছে। এসব জাদুঘর দেখার জন্য ভীড় করেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক। দর্শনীর বিনিময়ে দেখতে পাওয়া এ জাদুঘরগুলোর প্রত্যেকটিই আপন স্বকীয়তায় ভাস্বর। ভেন্ট্রিলোকুইজম ও ইটের এমন দুটি চমৎকার জাদুঘর নিয়ে আজকের এই আয়োজন।
ভেন্ট্রিলোকুইস্ট জাদুঘর
ভেন্ট্রিলোকুইজম হলো এমন একধরনের শিল্প মাধ্যম, যেখানে দর্শকের সামনে শিল্পীরা কোলে বা হাতে কথা বলা পুতুল নিয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে সেই পুতুলের সাথে কথোপকথন করে চলেন। নিজের এবং পুতুলের দুজনেরই কন্ঠস্বর শিল্পী নিজেই দেন। মুখ না নেড়ে স্বর পরিবর্তন করে এমন নিপুণভাবে কথোপকথন চালিয়ে যান তারা, সামনে বসা দর্শকরা মুগ্ধ বিস্ময়ে তা দেখতে থাকেন। এই অলৌকিক শিল্পকর্ম খুবই নিখুঁতভাবে পরিবেশন করা হয়। তাই দর্শকরাও খেয়াল করতে পারেন না আসলে কী হচ্ছে! আর তাই দর্শকরা পুতুলের অভিব্যক্তি ও কথা বলা মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেন।
এই ভেন্ট্রিলোকুইজম শিল্প নিয়ে কেনটাকি ফোর্ট মিশেলের ভেন্ট হেভেনে গড়ে উঠেছে এক আশ্চর্য জাদুঘর। ভেন্ট হেভেন জাদুঘরটি এমন এক বিশেষায়িত জাদুঘর, যা শুধুমাত্র ভেন্ট্রিলোকুইজমের প্রসার এবং উন্নতির জন্য উৎসর্গীকৃত। এটি পৃথিবীর একমাত্র জাদুঘর, যেখানে এই ভেন্ট্রিলোকুইজম শিল্প এবং ব্যবহৃত ডামির ক্রমবিবর্তন দেখানো হয় এবং তা নিয়ে চর্চা হয়।
প্রতি বছর শত শত পর্যটক ভেন্ট্রিলোকুইজমের আশ্চর্য সব সংগ্রহ দেখতে এখানে আসেন। দর্শকরা এখানে ভেন্ট্রিলোকুইজম সম্পর্কে এবং এর ইতিহাস সম্পর্কে, কীভাবে ভেন্ট্রিলোকুইজমের ডামিগুলো তৈরি হয় সে সম্পর্কে জানতে পারেন।
উইলিয়াম শেক্সপিয়র বার্জার নামক একজন ব্যক্তির উদ্যোগে জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি কিন্তু পেশাদার ভেন্ট্রিলোকুইস্ট ছিলেন না। ১৮৯৫ সালে তিনি সিনসিনাটি শহরের কেমব্রিজ টাইল কোম্পানির মেইল রুমে কাজ করতেন। তখন তার বয়স মাত্র ১৭ বছর। ১৯৪৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎই ভেন্ট্রিলোকুইজমের প্রতি তার উৎসাহ জন্মে। ১৯১০ সালে বার্জার ভেন্ট্রিলোকুইজমের একটি পুতুল কেনেন। তিনি পুতুলটির নাম দেন টমি বেলোনি। এভাবে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে তিনি পুতুল জোগাড় করতে শুরু করেন। প্রথমদিকে বার্জার তার কেন্টাকির বাড়ির গ্যারেজে পুতুলগুলো নিয়ে চর্চা শুরু করেন।
উৎসাহ ও সংগ্রহ দিনকে দিন বাড়তে থাকে। ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত তিনি একের পর এক ভেন্ট্রিলোকুইজমের পুতুল কিনতে থাকেন। এভাবে তার পুতুলের সংগ্রহ বাড়তে থাকে এবং তা বিশাল আকার ধারণ করে। ১৯৪৭ সালে ডামিগুলো রাখার জন্য তিনি গ্যারেজটি পুনর্নির্মাণ করেন। তারপরও স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় ১৯৬২ সালে তিনি বাড়ির খালি জায়গায় দ্বিতীয় একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। এখানেই গড়ে ওঠে বর্তমানের ভেন্ট হেভেন জাদুঘর।
১৯৪০ সালের শেষের দিকে বার্জার ভেন্ট্রিলোকুইস্টদের আন্তর্জাতিক ব্রাদারহুডের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি এই পদে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ছিলেন। তার সময়কালে এই ভেন্ট্রিলোকুইস্টদের ৩০০ সদস্যের সংগঠনটি ১০০০ এর অধিক সদস্যের সংগঠনে পরিণত হয়। এছাড়া এ সময় ভেন্ট্রিলোকুইজম নিয়ে তিনি একটি পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন, নাম দেন ‘দ্য ওরাকল’। এই পত্রিকার মাধ্যমে বার্জার বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আয়োজিত ভেন্ট্রিলোকুইস্টদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের খবর ছাপাতেন। ভেন্ট্রিলোকুইস্টদের মধ্যে যোগাযোগের অন্যতম সেতুবন্ধন হিসেবে এই পত্রিকাটি সেসময় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তার এই পত্রিকাটি ভেন্ট্রিলোকুইস্টদের মধ্যে এবং ভেন্ট্রিলোকুইজম ভালবাসে এমন মানুষদের মধ্যেে এতোটা জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে তিনি প্রতি সপ্তাহে ৫০ এর অধিক চিঠি পেতেন। এদিকে ভেন্ট্রিলোকুইজমের উপর বার্জারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বইপত্র, পুতুলের সংগ্রহ, পৃথিবীর নামী ভেন্ট্রিলোকুইস্টদের কাজ, স্ক্রিপ্ট, স্মারক, অনুষ্ঠানের পোস্টার, ভেন্ট্রিলোকুইজম সংক্রান্ত নানা ভিডিও, ফটো গ্যালারি- সব মিলিয়ে আস্তে আস্তে তা এক নিজস্ব জাদুঘরের চেহারা নিলো।
বার্জারের কোনো উত্তরাধিকার ছিল না, সেজন্য তিনি সবসময় তার মৃত্যুর পর এই সংগ্রহ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে চিন্তিত ছিলেন। শেষপর্যন্ত তিনি তার অ্যাটর্নি জন ব্রুকিংয়ের সহায়তায় একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সক্ষম হন। সেই প্রতিষ্ঠানের কাছে বার্জার তার যাবতীয় সম্পদ এবং ভেন্ট্রিলোকুইজমের এই বিশাল সংগ্রহশালা দান করে যান।
অবশেষে বার্জার আর ব্রুকিংয়ের কল্যাণে এবং সেই দাতব্য প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধানে ভেন্ট্রিলোকুইজমের বিশাল এই সংগ্রহশালাটি চলতে থাকে। ১৯৭৩ সালে ভেন্ট মিউজিয়ামের দরজা সাধারণ দর্শকদের জন্যে খুলে দেয়া হয়। জাদুঘরটিতে বর্তমানে উনবিংশ, বিংশ এবং একবিংশ শতকের বিভিন্ন ভেন্ট্রিলোকুইস্টদের ব্যবহৃত ৯০০ এর অধিক ডামি রয়েছে। এই পুতুলগুলোর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগান, জিমি কার্টার এবং লিঙ্কনের মতো ব্যক্তিত্বরাও।
তবে এই জাদুঘর দেখার জন্য তিন থেকে চারদিন আগে জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। আর তা নিতে হয় টেলিফোন বা ইমেইল মারফত এবং তা মে থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে। ছোট ছোট দলে ভাগ করে দর্শকদের জাদুঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। ট্যুর গাইড ঘুরিয়ে দেখান ভেন্ট্রিলোকুইজমের বিস্ময়কর সব ইতিহাস।
ওয়ার্ল্ড ব্রিক জাদুঘর
জাপানের কিয়োটোর এক ছোট্ট বন্দর শহর এই মাইজুরু। এই শহরের বিশেষত্ব হলো লাল রঙের ইটের বাড়িঘর। একসময় জাপানে লালরঙা ইটের বাড়িঘর তৈরির প্রচলন ছিল। পুরনো দিনের জাপানের সেই লালরঙা ইটের বাড়িঘর এখনও এখানে দেখা যায়। শহরটির বেশ কিছু পরিত্যক্ত সামরিক ভবন, গুদাম, টানেল এবং মন্দিরগুলোতে লাল ইটের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। সেই প্রাচীন ঐতিহ্য স্থানীয় বাসিন্দারা আজও বহন করে চলেছে।
তাই শহরটিকে লাল ইটের শহর হিসেবে স্থানীয়রা এখনও পরিচয় দিয়ে থাকেন। শহরে নৌ-সেনাদের টর্পেডো মজুত করার ওয়্যারহাউসগুলোর একটিকে সাজিয়ে গুছিয়ে তৈরি করা হয়েছে ইটের এক আশ্চর্য জাদুঘর। এই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৩ সালে।পৃথিবীর প্রায় ৩৬টি দেশ থেকে নিয়ে আসা ২৫০টিরও বেশি নানা ধরনের ইট এই সংগ্রহশালায় রয়েছে। বিশেষ করে মেসোপটেমিয়া, মহেঞ্জোদারো, চীন ও গ্রিসের চারটে অতি প্রাচীন মানব সভ্যতায় ব্যবহৃত ইট এখানকার প্রদর্শনীতে রাখা আছে।
১৯৯৩ সালে ইংল্যান্ডের ঐতিহাসিক পোর্টসমাউথ ডকইয়ার্ডের কিছু ইট এই সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে। জাদুঘরের দ্বিতীয় তলার প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে শুধুমাত্র জাপানে ব্যবহৃত লাল ইট। সেই সাথে রয়েছে জাপানে কীভাবে ইট দিয়ে বাড়িঘর তৈরির কৌশল আয়ত্ব করেছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য। মিইজি এবং তাইশো সময়কালে জাপানে এই ইটের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এখানে আরও স্থান পেয়েছে জাপানের টোকিও রেল স্টেশনে ব্যবহৃত লাল ইটের রেপ্লিকা।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আনা ইট অন্য আরেকটি প্রদর্শনী হলে রাখা আছে। আর আছে তার সাথে জড়িয়ে থাকা বহু ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ। রয়েছে ছবির গ্যালারিও। জাপান সরকার এই জাদুঘরটিকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
ফিচার ইমেজ- dallasnews.com