আপনি কি জেমস বন্ডের ভক্ত? জেমস বন্ডের পরিচয় নিশ্চয়ই পাঠকদের সামনে নতুন করে উপস্থাপন করতে হবে না। ‘মাই নেম ইজ বন্ড, জেমস বন্ড!’- ০০৭ ভক্তদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। জেমস বন্ড সিরিজের প্রতিটি চলচ্চিত্রের সাথেই বেশ কুল, থ্রিল আর ফান জাতীয় কিছু ব্যাপার জড়িত থাকে। এ কারণে সহসাই সব শ্রেণীর দর্শকদের মন জয় করতে সময় লাগে না বন্ড সাহেবের। তিন ঘণ্টার মধ্যে সে শুধু আপনার মনোরঞ্জনই করবে না; গাড়ি, গ্যাজেট আর সুন্দরীদের দুর্দান্ত তালিকা দেখিয়ে আপনার দীর্ঘশ্বাস বের করেই ছাড়বে!
পাঠকপ্রিয় থেকে দর্শকপ্রিয় হয়ে ওঠা জেমস বন্ড সিরিজের পরবর্তী সিনেমা মুক্তির সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসের শুরুর দিককে মাথায় রেখে। এটি হতে যাচ্ছে বন্ড সিরিজের ২৫ তম সিনেমা, যার মধ্য দিয়ে সিক্রেট এজেন্ট জেমস বন্ড হিসেবে সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে সাড়া জাগানিয়া হলিউড অভিনেতা ড্যানিয়েল ক্রেইগের। ২০০৬ সালে ক্যাসিনো রয়েলের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে ১৪ বছরের জেমস বন্ড ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টানতে যাচ্ছেন তিনি।
এবারের জেমস বন্ড পরিচালক হিসেবে অস্কার জয়ী পরিচালক ড্যানি বয়েলের নাম শুনে ইতোমধ্যে নড়েচড়ে বসেছিলেন অনেকেই। তাদের প্রত্যাশার পারদ একবারে নিচে নামিয়ে গত আগস্টে সিনেমাটি থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ড্যানি। তার বদলে সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম আমেরিকান পরিচালক হিসেবে ‘বন্ড ২৫’ এর হাল ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ক্যারি জোজি ফুকুনাগা।
এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে পরবর্তী বন্ড, বন্ড কন্যা এসব নিয়ে হাজারো জল্পনা-কল্পনা। সেসব চলতে থাকুক, আমরা নাহয় একটু জেনে আসি জেমস বন্ড ফ্র্যাঞ্চাইজির মজার কিছু তথ্য।
জেমস বন্ড ফ্র্যাঞ্চাইজির জন্য একটি পরিবার নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার
একটি সিনেমা নির্মাণের সাথে মিশে থাকে অসংখ্য মানুষের শ্রম, সাধনা আর ত্যাগের গল্প। সেখানে একটি পরিবারকে জেমস বন্ড ফ্র্যাঞ্চাইজির জন্য আলাদা করে ধন্যবাদ কেন জানাতে হবে, তা নিয়ে খটকা লাগতেই পারে। কিন্তু বেশ কয়েক দশক ধরে পরিবারটি যেভাবে বন্ড ভক্তদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে, তা সত্যিকার অর্থেই পাদপ্রদীপের আলোয় আসার যোগ্য।
বলা হচ্ছিলো ব্রকলি পরিবারের কথা। ১৯৭৫ সাল থেকে মূলত তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রযোজিত হচ্ছে জেমস বন্ড সিরিজের চলচ্চিত্রগুলো। সিনেমাগুলো এখন যেন তাদের পারিবারিক বন্ধুতে পরিণত হয়েছে। আলবার্ট আর ব্রকলি সর্বপ্রথম এই রীতি শুরু করেছিলেন। তার হাত ধরে ১৯৮৪ সালে জেমস বন্ডের দায়িত্ব নেন তার পুত্র মাইকেল জি উইলসন। ১৯৯৫ সালে এসে কন্যা বারবারা ব্রকলির হাতে বন্ড সিরিজের ভার ছেড়ে দেন আলবার্ট। দুই প্রজন্মের প্রচেষ্টায় ব্রকলি পরিবারের প্রযোজনায় এগিয়ে চলেছে বন্ড সিরিজ, আর আমরা পাচ্ছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা নির্মল বিনোদন আর উত্তেজনায় ভরপুর একেকটি সিনেমা।
প্রথম সিনেমায় বড়লোক বনে যাননি ইয়ান ফ্লেমিং
এখনকার দিনে বন্ড মানেই আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার নিশ্চিত এক হাতিয়ার। বাণিজ্যিক দিকটাকে মাথায় রেখেই তো সিনেমাগুলোকে মুক্তি দেয়া হয়। তবে বর্তমানে যেমন বই ভালো চললেই সেই কাহিনী নির্ভর সিনেমাও ভালো চলবে, এমন একটি ধারণা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, সে সময়কার চিত্র কিন্তু বেশ ভিন্ন ছিল। লেখক ইয়ান ফ্লেমিং তার বই থেকে সিনেমা বানানো হবে এ বিষয়টি নিয়ে উৎফুল্ল ছিলেন বটে, কিন্তু আর্থিকভাবে ছবিটি আর যা-ই হোক ব্লকবাস্টারের তকমা গায়ে লাগাতে পারেনি।
১৯৫৪ সালে সিবিএস ফ্লেমিংকে ১ হাজার ডলারের বিনিময়ে তার বিখ্যাত গল্প ‘ক্যাসিনো রয়েল’ অবলম্বনে এক ঘণ্টার শো উপযোগী একটি স্ক্রিপ্ট লিখে দিতে বলে। ‘ক্লাইমেক্স মিস্ট্রি থ্রিলার’ সিরিজের একটি পর্ব হিসেবে নির্মাণ করা হয় এটি। এখানে জেমস বন্ড চরিত্রে অভিনয় করেন ব্যারি নেলসনম আর খলনায়ক লা শিফরের চরিত্রে অভিনয় করেন পিটার লরে। ১৯৫৪ সালের ২১ অক্টোবর পর্বটি টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। সেবারই প্রথম বন্ড সিরিজের জন্য আর্থিকভাবে কিছুটা লাভবান হন ফ্লেমিং সাহেব।
ফ্র্যাঞ্চাইজির যে সিনেমাটিকে আপনি সবচেয়ে বড় বক্স অফিস হিট ভাবছেন, বাস্তবে তা ঠিক নয়
আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় বাণিজ্যিকভাবে বন্ড সিরিজের সবচেয়ে হিট সিনেমা কোনটি, কী উত্তর দেবেন আপনি? প্রথমেই মানস চক্ষে ভেসে উঠবে ড্যানিয়ে ক্রেইগ অভিনীত ‘ক্যাসিনো রয়েলের’ কথা, কিংবা হয়তো ভাবছেন ‘থান্ডারবল’ বা ‘গোল্ডফিঙ্গারের’ কথা। কোনোটিই সঠিক উত্তর নয়। আয়ের দিক থেকে বন্ড সিরিজের চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ‘ক্যাসিনো রয়েল’।
তাহলে শীর্ষস্থানে অবস্থানকারী সিনেমাটির নাম কী হতে পারে? বলা হচ্ছে ‘স্কাইফলের’ কথা, যা মুক্তি পেয়েছিল ২০১২ সালের ৮ নভেম্বর। সিনেমাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডোমেস্টিক বক্স অফিস থেকেই আয় করেছে কেবল ৩০,৪৩,৬০,২৭৭ ডলার! দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাণিজ্যিকভাবে সফল সিনেমা ‘স্পেক্টার’ এর চেয়ে এটি আয় করেছে প্রায় ১০০ মিলিয়ন বেশি ডলার। আন্তর্জাতিক বক্স অফিসের কথা শুনলে তো চোখ চড়ক গাছে উঠে যেতে বাধ্য হবে। মুক্তির সময়ই ১১১ কোটি ডলারেরও বেশি কামিয়েছে ‘স্কাইফল’। এমনিতেই জেমস বন্ড সিরিজ মানেই সুপার ডুপার হিট, এ কথা সর্বজনবিদিত। সারা বিশ্বে জেমস বন্ড সিরিজের সর্বমোট অর্জিত অর্থের পরিমাণ প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার।
ড্যানিয়েল ক্রেইগকেই বন্ড হিসেবে উপভোগ করুন, আরও একবার
ক্যাসিনো রয়েলের জন্য যখন নতুন বন্ড খোঁজা হচ্ছিলো, তখন তাকে মেনে নিতে পারেননি অনেকেই। কোমল-কঠোরের মিশেলে অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী, কালোকেশী রজার মুর বা পিয়ার্স ব্রসন্যানের কাছে তিনি যেন অনেকটাই ফ্যাকাসে। কাজেই সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠেছিল ভক্তকুল, ক্রেইগ পারবেন তো? এবং তাদের সব সন্দেহকে মিথ্যা প্রমাণ করে রূপালি পর্দায় হাজির হয়ে এমনই ঝড় তুলে দেন ক্রেইগ যে সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় নতুন বিতর্ক, শন কনারি না ড্যানিয়েল ক্রেইগ? কে হবেন সর্বকালের সেরা জেমস বন্ড?
অবশেষে ২০১৯ সালে শেষ হতে চলেছে ড্যানিয়েল ক্রেইগের রাজত্ব। ‘বন্ড ২৫’ নামে পরিচিত এই সিনেমাটির পর কে হবেন নতুন বন্ড তা নিয়ে ইতোমধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। ক্রেইগ এর মধ্যে কাজ করছিলেন একটি টেলিভিশন শোতে। কাজেই এই বন্ড সিরিজে তাকে পাওয়া যাবে কি না তা নিয়েও সংশয় ছিল ভক্তদের মনে। তাদেরকে অবশ্য নিরাশ করেননি হাল আমলের জনপ্রিয় এই ব্রিটিশ অভিনেতা।
জেমস বন্ডের হাত ধরে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নতুন নতুন গ্যাজেটের উদ্ভবও ঘটেছে বটে!
জেমস বন্ডের অধিকাংশ গ্যাজেটকে নিছক বিনোদন আর অ্যাডভেঞ্চারের সামগ্রী বলে চালিয়ে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তবে এর মধ্যে কয়েকটি গ্যাজেট যে ভবিষ্যতের পথ প্রদর্শক হিসেবেও কাজ করেছে, তা বলতে দ্বিধা নেই।
১৯৮৫ সালে ‘এ ভিউ টু কিল’ সিনেমায় প্রথমবারের মতো দেখানো হয় একটি রিং ক্যামেরা। এখনকার দিনে কেবল আংটিতে কেন, যেকোনো জায়গায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ক্যামেরা স্থাপন করে গোপন সব তথ্য-প্রমাণ বের করে আনা বেশ স্বাভাবিক একটি ঘটনাতে পরিণত হয়েছে। একই সিনেমায় প্রদর্শিত হয় ছোট একটি রোবট কুকুর। রোবট কুকুর, বেড়াল যে এখন রীতিমতো ডালভাতে পরিণত হয়েছে, তা আলাদা করে বলাই বাহুল্য।
২০০৮ সালের সাড়া জাগানো সিনেমা কোয়ান্টাম অফ সোলাসে প্রদর্শিত হয় একটি মাল্টিটাচ টেবিল। ৬ জনের ব্যবহার উপযোগী এই টেবিলটির সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পাবেন সাম্প্রতিক সময়ে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর আইটি অফিসে ব্যবহৃত টেবিলের। আঙুলের ছোঁয়ায় তারা একের পর এক ফাইল সরিয়ে ফেলছে, নিজেরা এক ইঞ্চিও না নড়ে ডকুমেন্ট শেয়ার করছে। বন্ডের মতো হতে আর বাকি আছে কী!
শুরুতে ‘০০৭’ হিসেবে খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা ছিল না শন কনারির
জেমস বন্ড চরিত্রে অভিনয় করা অনেক অভিনেতা নিজেদের স্টান্ট নিজেরাই করেছেন। নিরাপত্তা আর ইন্স্যুরেন্সের খাতিরে অবশ্য পুরোটা করার অনুমতি তাদের মিলতো না। তবে জেমস বন্ড সিরিজে এমন একজন অভিনেতা রয়েছেন যিনি জীবনে একবারও নিজের স্টান্ট নিজে করেননি। নাম শুনলে অবাক হয়ে যেতে পারেন (যদি উপরের শিরোনামটি না পড়ে থাকেন!), যাকে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জেমস বন্ড বলা হয়, সেই শন কনারিই করেছিলেন এমনটা।
তার পরবর্তী বন্ড জর্জ ল্যাজেনবির ভাষ্যমতে, “সিঁড়ি বেয়ে এক ধাপ নামতে গেলেও শন কনারির মুখ থেকে অবধারিতভাবে বেরিয়ে যেত চিরচেনা সেই ডাক, ‘স্টান্ট ম্যান’!” সত্যি বলতে জেমস বন্ড সিনেমা সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে, তারা নিঃসন্দেহে মেনে নেবেন, ঘরে বসে টেলিভিশনের পর্দায় বা সিনেমা হলে বসে বিশাল পর্দায় একটি অ্যাডভেঞ্চার দৃশ্য দেখে শিহরিত হওয়া আর সেই দৃশ্যে নিজে অভিনয় করার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক আছে। এখানে ভয়ঙ্কর কিছু স্টান্টও ব্যবহার করা হয় চরিত্রের স্বার্থে। তবে মিস্টার ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া ড্যাশিং হিরো শন কনারি অন্তত একবার রেসিং কারের ভেতরে বসে নিজে গাড়ি চালাবেন, ভক্তদের এমন প্রত্যাশায় পানি ঢেলে তাদের কিছুটা হতাশই করেছেন বটে!
প্রথম বড় পর্দার জেমস বন্ড ছিলেন একজন সত্যিকারের খেলোয়াড়
জর্জ ল্যাজেনবি কে আমাদের প্রজন্মের তা জানার বা চেনার কথা নয়। একটিমাত্র জেমস বন্ড মুভিতে অভিনয় করেছেন তিনি, ‘অন হার ম্যাজেস্টি’স সিক্রেট সার্ভিস’। জেমস বন্ডের চরিত্রে বেশিদিন কাজ না করলেও বন্ডের লাইফস্টাইলে দিব্যি গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন এই অভিনেতা। তার ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি ১,০০০ এরও বেশি নারীর সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন এবং খ্যাতির শীর্ষে থাকাকালীন সময় প্রতিদিন ৫ জন করে নারীর মন জয় করতেন!
নিজেকে ‘সুদর্শন অস্ট্রেলিয়ান’ বলে দাবী করা এই ভদ্রলোকের ভালোই দম্ভ আর আত্মবিশ্বাস ছিল নারীদের ব্যাপারে। এজন্যই হয়তো শূন্য অভিনয় দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা নিয়েও অনায়াসেই জেমস বন্ডের মতো রোল পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি!