Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যে দশটি মিথ্যা বদলে দিয়েছিল ইতিহাসের গতিপথ!

মিথ্যা কথা পছন্দ করেন? এই প্রশ্নের উত্তর অধিকাংশের জন্যই না। তবে যদি বলা হয় মিথ্যা বলে ভালো কিছু হচ্ছে, তাহলে হ্যাঁ’র সংখ্যা বেড়ে যাবে হয়তো। কিন্তু যখন দেখবেন কিছু মিথ্যা, যা এক কথায় প্রতারণার সামিল, হাজারো মানুষের ক্ষতি করছে, তখনও কি মিথ্যার ‘উপকারী’ দিকের জন্য একে সমর্থন করবেন? এমনই ১০টি মিথ্যা এবং প্রতারণার গল্প আজ জানাবো, যেগুলোর কিছু দিয়েছে লাখো মানুষকে হতাশা-বিষাদগ্রস্ততা, কিছু মিথ্যা করেছে উপকার, কিন্তু প্রতিটিই প্রভাব ফেলেছে পৃথিবীর ইতিহাসে। পড়া শেষে আপনিই সিদ্ধান্ত নিন, মিথ্যা ভালো না মন্দ!

১. আলজেরিয়ার স্বাধীনতা আটকে গিয়েছিল জাদু বিশ্বাসে!

উত্তর আফ্রিকার একটি স্বাধীন মুসলিম দেশ আলজেরিয়া। ১৯৫৪-৬২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর ফরাসীদের সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা লাভ করে দেশটি। ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট বা এফএলএন এর দেড় লক্ষাধিক যোদ্ধাসহ ৩ লক্ষ আলজেরিয়ান নাগরিকের প্রাণের বিনিময়ে ফ্রান্সের উপনিবেশ থেকে মুক্তি পায় আফ্রিকার এই দেশটি। অথচ এর স্বাধীনতা আসতে পারতো আরো অনেক আগেই, অনেক কম রক্তের বিনিময়ে! প্রায় শত বছর আগেই আলজেরিয়া হতে পারতো একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। কিন্তু কেন পারেনি? কারণ জাদুবিদ্যায় ভ্রান্ত বিশ্বাস আর ফরাসিদের মিথ্যা প্রচারণা! যে ইতিহাসটা লেখা হতে পারতো শত বছর আগে, সেটি এক শতাব্দী পিছিয়ে যায় কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাসের জন্য।

জাদু দেখাচ্ছেন রবার্ট হুডিন; image source: youtube.com

১৯ শতকের মধ্যভাগে ফরাসি উপনিবেশ আলজেরিয়ার স্থানীয় লোকজন নানা কারণে ফুঁসতে থাকে সরকারের বিরুদ্ধে। স্থানীয়দের ক্ষোভের উদগীরণ ঘন ঘন প্রত্যক্ষ করতে শুরু করে ফরাসিরা। তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরো বাড়িয়ে দেয় স্থানীয় ‘ম্যারাবাউট’রা (আফ্রিকায় মুসলিম পবিত্র এবং সম্মানিত ব্যক্তি)। ম্যারাবাউটদের প্রবল আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করা আলজেরিয়ানরা তেঁতে ওঠে ম্যারাবাউটদের বিদ্রোহের ঘোষণায়। দিকে দিকে বিদ্রোহীদের বিস্ফোরণ শুরু হয়ে গেলে তাদের থামানো কঠিন হয়ে যাবে বুঝতে পেরে ভিন্ন রাস্তায় হাঁটে ফরাসিরা। তারা ফ্রান্স থেকে নিয়ে আসে জাদুবিদ্যার জনক খ্যাত রবার্ট হুডিনকে। হুডিন আলজেরিয়ানদের সামনে অত্যন্ত সাধারণ কিছু কৌশল দেখালেন, যেগুলো তখনকার সময়ে খুবই ‘অসাধারণ’ ছিল। আর হুডিনের কৌশলের নিকট ম্যারাবাউটরা বিপর্যস্ত হয়ে গেল। ফলে প্রমাণিত হলো, হুডিনই প্রকৃত আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী, ম্যারাবাউটরা নয়। তাই তাদের কথায় বিদ্রোহ করার কোনো মানে আছে?

২. যিশু ফর্সা ছিলেন (না)!

যিশু খ্রিস্টের নাম শুনলেই চোখে সামনে কী ভেসে ওঠে আপনার? একটি ফর্সা মুখাবয়ব নিশ্চয়ই? এতে অবশ্য আপনার-আমার দোষ নেই। মেল গিবসনের ‘প্যাসন অব দ্য ক্রাইস্ট’ ছবির মতো অসংখ্যা সিনেমা রয়েছে, কিংবা যিশু খ্রিস্টের ‘ক্রুসিফিক্সন অব জেসাস’ ও ‘গ্রুনওয়াল্ড ক্রাইস্ট’ এর মতো বিখ্যাত সব চিত্রকর্মেই তিনি একজন সাদা চামড়ার মানুষ। কিন্তু হঠাৎ যিশুর গাত্রবর্ণ নিয়ে এত কথা কেন? তাহলে বিস্মিত হবার জন্য প্রস্তুত হন। আপনার সামনে আজন্ম উপস্থাপন ধবধবে ফর্সা যিশু আসলে পুরোটাই ভ্রান্ত! প্রকৃত যীশু খ্রিস্টের গায়ের রং কৃশকায়। যে কারণে অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের সাথে প্রোটেস্টেন্ট আর ক্যাথলিকদের দ্বন্দ্ব দেখা যায়

পাবলিয়াস লেন্টুলাসের চিঠি; image source: Fishingstudio.com

যিশু খ্রিস্টের গাত্রবর্ণ এমন বিস্ময়করভাবে পাল্টে যায় একটি ‘ভুলে ভরা’ চিঠির জন্য কেবল! কোনো এক পাবলিয়াস লেন্টুলাস নামক ব্যক্তির লেখা চিঠিতে যিশু খ্রিস্টের গায়ের রঙের বর্ণনা দেয়া হয় ফর্সা হিসেবে। চিঠিটি প্রথম ছাপা হয় ১৫ শতকে প্রকাশিত ‘ইন্ট্রোডাকশন টু দ্য ওয়ার্ক অব সেন্ট আনসেলম’ বইয়ে, যেখানে বলা হয় লেন্টুলাস ছিলেন জেরুজালেমের গভর্নর। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, আনসেলমের লেখায় এসবের কোনো বিবরণ নেই, ছিল না লেন্টুলাস নামক কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব। চিঠিটি মূলত একটি প্রাচীন রোমান দলিলপত্রের সাথে খুঁজে পাওয়া যায়, যা কনস্টান্টিনোপোল থেকে রোমে প্রেরণ করা হয়েছিল। যা-ই হোক, উৎসের ভিত্তি না জানা এক চিঠির বদৌলতে কৃশকায় যিশুখ্রিস্ট আজ বিশ্বজুড়ে ফর্সা।

৩. ভুয়া বিজ্ঞানীতে বিপত্তি!

আর্জেন্টিনার ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্টদের একজন হুয়ান পেরন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ক্ষমতায় এসে তিনি আর্জেন্টিনাকে পারমাণবিক শক্তিধর দেশে রূপান্তর করার প্রকল্প হাতে নেন। কিন্তু প্রকল্পের সবচেয়ে বড় গলদ ছিল বিজ্ঞানী নিয়োগেই। আন্তর্জাতিকভাবে গোপন রেখেই তিনি একজন জার্মান ‘পারমাণবিক বিজ্ঞানী’ রোনাল্ড রিখটারকে নিয়োগ দেন। রিখটার দাবি করেন, বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন নাৎসিদের উচ্চপদস্থ একজন বিজ্ঞানী। অথচ সবকিছু ফাঁস হবার পর জানা যায় রিখটারের সাথে নাৎসিদের কোনো সম্পর্ক ছিল না! এমনকি রিখটারের তেমন কোনো সাফল্যই ছিল না যার জন্য তাকে বিজ্ঞানী বলা যায়!

রোনাল্ড রিখটার; image source: legacy.com

যা হোক, আর্জেন্টির হিউমুল দ্বীপে ‘প্রোজেক্ট হিউমুল’ নামে শুরু হয় এ পারমাণবিক প্রকল্প। রিখটার দুই বছর গবেষণা করে পারমাণবিক ফিউশনে সাফল্য পেয়েছেন বলে দাবি করলে আন্তর্জাতিকভাবে জানান দেন পেরন। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীমহল ছিল সন্দেহপ্রবণ। পেরনের কথার সত্যতা যাচাই করতে আর্জেন্টিনার হিউমুল দ্বীপে ভ্রমণ করেন মার্কিন, রাশান, ব্রিটিশ আর ফরাসি বিজ্ঞানীরা। রিখটার সেখানে টিএনটি বিস্ফোরণ দেখিয়ে ফিউসন বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেও বিজ্ঞানীদের চোখ ফাঁকি দিতে পারেননি। অধিকাংশ বিজ্ঞানীই রিখটারের এহেন কর্মকাণ্ড নিয়ে ঠাট্টা করতে ছাড়েননি। আর পেরনও বুঝতে পারেন, এই প্রকল্পের পেছনে তার ব্যয় করা ১৯০ মিলিয়ন পাউন্ড পুরোটাই জলে গেছে। দেশের জনগণ ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে এত বিশাল অঙ্কের অর্থহানীর জন্য। এরই ধারাবাহিকতায় ৩ বছর পর পতন হয় পেরনের।

৪. জালিয়াৎ থেকে কিংবদন্তি!

মাইকেল এঞ্জেলোর নাম শুনেছেন? পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী ও ভাস্করদের মধ্যে একজন তিনি। ফ্লোরেন্সের এই চিত্রশিল্পীর নাম শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে সিস্টিন চ্যাপের কারুকার্যময় ছাদ, ‘দ্য লাস্ট জাজমেন্ট’ এর মতো বিশ্বনন্দিত দেয়ালচিত্র, পিয়েটা আর ডেভিডের মতো নিপুণ ভস্কর্যের ছবি। কিন্তু চিত্রকর্ম আর ভাস্কর্যশিল্পের ইতিহাস পাল্টে দেয়া এই চিত্রশিল্পী কিন্তু কর্মজীবনের শুরু করেছিলেন জালিয়াতি করে!

১৫ শতকের শেষভাগে রেনেসাঁর সূচনালগ্নের কথা। ফ্লোরেন্সের অনেক বিখ্যাত ভাস্করদের কাছে ভাস্কর্য নির্মাণ শিখতে লাগলেন মাইকেল এঞ্জেলো। তার প্রতিভায় তার শিক্ষাগুরুরা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রাথমিকভাবে মুগ্ধ হয়নি কেবল ক্রেতারা, যাদের ছাড়া জীবিকার্জন সম্ভব না। দারুণ সব চিত্রকর্ম তৈরি করেও যখন সেগুলো বিকোতে না পেরে অর্থাভাবে ধুঁকছেন মাইকেল এঞ্জেলো, তখন ফ্লোরেন্সে মাটি খুঁড়ে বের করা ক্লাসিক্যাল যুগের ভাস্কর্য সংগ্রহ করাই ছিল মানুষের অধিক পছন্দ। মাইকেল এঞ্জেলোর মাথায় তাই খেলে গেল দুষ্টু বুদ্ধি। তিনি একটি স্লিপিং কিউপিডের ভাস্কর্য বানিয়ে সেটিকে মাসখানেক মাটিতে পুঁতে রেখে দিলেন এবং দক্ষতার সাথে ভাস্কর্যটির ক্ষতিসাধন করলেন যাতে করে সেটি পুরাতন মনে হয়!

মাইকেল এঞ্জেলো; image source: medium.com

প্রথমে সাফল্য পেয়েও গিয়েছিলেন মাইকেল এঞ্জেলো। কার্ডিনাল রিয়ারিওর নিকট কিউপিডটি ভালো দামে বিক্রয় করতে সক্ষম হন তিনি। কিন্তু মুখ ফসকে নিজেকে এর নির্মাতা বলে ফেলায় শুরু হয় বিপত্তি। ক্রোধে আগুন কার্ডিনাল অবশ্য পরে দেখলেন যে নকল করলেও কিউপিডটি ছিল অত্যন্ত নিখুঁত। তিনি তাই মাইকেল এঞ্জেলোকে সাজা না দিয়ে বরং ভালো চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্য তৈরির জন্য পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করলেন। এই ঘটনার পর মাইকেল এঞ্জেলোর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

৫. প্রতারণা থেকে বিখ্যাত রক ব্যান্ড দল!

ভুয়া জোম্বিস; image source: ultimateclassicrock.com

১৯৬৯ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ ব্যান্ড দল জোম্বিস প্রকাশ করে ‘টাইম অব দ্য সিজন’, যা সপ্তাহের পর সপ্তাহ জুড়ে ব্রিটেন এবং আমেরিকার টপ চার্টে জায়গা করে নিল। তবে এই অ্যালবাম প্রকাশের পরই কোনো কারণে জোম্বিস ভেঙে যায়। কিন্তু জোম্বিসের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে অর্থ উপার্জনের প্রতারণামূলক ফন্দি আঁটলো একটি মার্কিন কোম্পানি ‘ডেলটা প্রমোশন’। তারা জোম্বিস বলে টেক্সাস এবং মিশিগান কেন্দ্রিক দুটি ভুয়া ব্যান্ড দল দিয়ে কনসার্ট পরিচালনা করতে শুরু করলো। প্রকৃত জোম্বিসের সদস্যদের না দেখতে পেয়ে যখন তারা প্রশ্নের সম্মুখীন হতো, তখন “ভোকাল মারা গেছে” কিংবা “অরগানিস্টকে জেলে নেয়া হয়েছে” ইত্যাদি মিথ্যা বলতো! অথচ তখনো জোম্বিসের প্রকৃত সদস্যরা বহাল তবীয়তেই আছেন। কিন্তু ভুয়া জোম্বিসের দৌরাত্ম্য অবসানে দ্রুতই ব্রিটিশ জোম্বিস নিয়ে আসে তাদের নতুন অ্যালবাম। আর ততদিনে ভুয়া জোম্বিসের ফ্যাংক বিয়ার্ড এবং ডাস্টি হিল জনপ্রিয়তার চূড়ায় উঠে গেছেন। সেটিকে কাজে লাগিয়ে তারা প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন নিজেদের ব্যান্ড ‘জেজে টপ’!

৬. গুটেনবার্গ ছাপাখানা আবিষ্কার করেন বাধ্য হয়ে!

জোহানেস গুটেনবার্গ তখন আচেন শহরে। এই শহরে প্রতিবছর হাজারো মানুষ ভিড় করতো পবিত্র তীর্থস্থান ভ্রমণ করতে। কিন্তু সে সময় এমন কোনো প্রযুক্তি ছিল না যা তীর্থযাত্রীদের জন্য পবিত্র সব প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষের স্মৃতি ধরে রাখতে পারবে। তবে যা ছিল, তা হচ্ছে ভ্রান্ত বিশ্বাস! তার বিশ্বাস করতো একধরনের বিশেষ কাঁচ আছে, যে কাঁচে সেসব প্রত্নতত্ত্বের ছবি প্রতিফলিত হয়ে সামনে রাখা বাক্স সেগুলোর পবিত্রতায় ভরে ফেলা যায়! যে কারণে তীর্থযাত্রীরা মাথায় ছোট কাঁচের টুকরো লাগিয়ে রাখতে। যখন কোনো পবিত্র বস্তু বা মন্দিরের দর্শন করতেন, তখন মাথার কাঁচ থেকে আলোর প্রতিফলন বাক্সে পড়া মাত্রই তারা বাক্সটি বন্ধ করে রেখে দিতেন এই ভেবে যে, বাক্সটি পবিত্রতায় ভর্তি হয়ে গেছে!

জোহান গুটেনবার্গ; image source: friendsofcsntm.com

এরকম ভ্রান্ত বিশ্বাসে বিশ্বাসীদের নিকট আয়না বিক্রয় করে অর্থ উপার্জন করতে আচেন শহরে ভ্রমণ করেছিলেন গুটেনবার্গ। তিনি একটি দোকান খুলে প্রচুর পরিমাণে আয়না প্রস্তুত করেন। কিন্তু সে বছর বন্যা এবং প্লেগের প্রাদুর্ভাবে আচেনে সব ধরনের ভ্রমণ নিষিদ্ধ করেন পোপ। ফলে মাঠে মারা যায় গুটেনবার্গের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য। উপরন্তু, তার এই আয়না নির্মাণের উপর বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগকৃত অর্থ শোধ করার চিন্তাই হয়ে ওঠে বড় চিন্তা। আর এই চিন্তা থেকেই তিনি দেনা শোধ করার সহজ পন্থার কথা ভাবতে লাগলেন। ভাবতে ভাবতে তার মাথায় এলো সহজে বই ছেপে বিক্রয় করা বুদ্ধি। আর এর ধারাবাহিকতায় তৈরি করলেন সক্রিয় ছাপা হরফ!

৭.  হাতুড়ে ডাক্তারের হাত ধরে রেডিওতে দেশীয় সঙ্গীতের প্রচলন!

ইতিহাসের অন্যতম সেরা একজন হাতুড়ে ডাক্তার হিসেবে পরিচিতি আছে জন ব্রিংকলির। বেশ কিছুদিন ছাগলের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে তিনি ঘোষণা দিলেন যে, ছাগলের অণ্ডকোষ প্রজননে অক্ষম পুরুষের অণ্ডথলিতে স্থাপন করে তাকে প্রজননক্ষম করে তোলা সম্ভব! ক্যানসাসে তার করা সে গবেষণার কোনো ভিত্তি বা স্বীকৃতি কোনোটাই ছিল না, যদিও সেখানকার জনপ্রিয় রেডিও স্টেশন ‘কেএফকেবি’ থেকে তার অণ্ডকোষ অপারেশনের খবর প্রচার করা হয় বেশ জোরেশোরেই। আর তাতেই তার চিকিৎসার চাহিদা ওঠে তুঙ্গে। আমেরিকার অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব তার নিকট অস্ত্রোপচারের জন্য আসতে লাগলেন। কিন্তু কিছুদিন যেতেই প্রমাণ হতে লাগলো তার চিকিৎসা পুরোটাই ‘অবৈজ্ঞানিক’। ফলে তার সার্জারি এবং রেডিও প্রচারণা, দুটোই বন্ধ করে দেয়া হলো।

জন ব্রিংকলি; image source: oldtimeherald.org

কিন্তু ব্রিংকলি নাছোড়বান্দা। তিনি তার অণ্ডকোষ চিকিৎসা চালিয়ে যাবেন বলেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ক্যানসাস ছেড়ে চলে গেলেন মেক্সিকোতে এবং খুলে বসলেন অণ্ডকোষ প্রতিস্থাপন কেন্দ্র। আর প্রচারণার জন্য স্থাপন করলে রেডিও স্টেশন। চিকিৎসার প্রচারণা চালানোর জেদ থেকে তিনি রেডিওতে সঙ্গীত উপস্থাপন এবং বিজ্ঞাপন প্রচারের মডেল বনে যান! তিনি নিজের সার্জারি সম্পর্কে মাঝে মাঝে ১ ঘন্টারও অধিক কাল কথা বলতেন রেডিওতে। তার কথা বলার ধরন এবং উল্লেখ করা তথ্যাদি এতটা সাজানো এবং বাহুল্যবর্জিত ছিল যে অনেকে তাকে আধুনিককালের ‘ইনফমার্শিয়াল’ বা তথ্যমূলক বিজ্ঞাপনের জনক বলে অভিহিত করেন! আর এই দীর্ঘ বক্তৃতামূলক বিজ্ঞাপনের মাঝে তিনি প্রচার করতেন জনপ্রিয় সব দেশীয় সঙ্গীত। এভাবে তার হাত ধরেই মার্কিন রেডিওগুলোতে দেশীয় সঙ্গীত জনপ্রিয়তা লাভ করে।

৮. এপ্রিল ফুল থেকে প্রেততত্ত্ব

স্পিরিচুয়ালিজম বা প্রেততত্ত্বে বিশ্বাসী বিশ্বাস করেন যে আত্মার সাথে মানুষের যোগাযোগ সম্ভব। বাইবেলে এরকম কিছু ধারার উল্লেখ থাকায় খ্রিস্টানদের মধ্যে এ বিশ্বাস আরো প্রবল ছিল। ইউরোপে আধ্যাত্মবাদের যথেষ্ট জনপ্রিয়তা থাকলেও, আমেরিকায় এর বিশ্বাসটা দৃঢ়তা পায় ১৯ শতকের মধ্যভাগে দুটি বোকা বানানোর প্রয়াস থেকে! প্রথমটি শুরু হয় ফক্স বোনত্রয়ের হাত ধরে। তিন বোন ম্যাগি, কেট এবং লিয়ার মধ্যে লিয়া ছিলেন সবার বড় এবং বিবাহিত। তিনি অন্যত্র থাকতেন। ১৮৪৮ সালের এপ্রিল ফুলকে সামনে রেখে মা এবং প্রতিবেশীদের বোকা বানাতে দুষ্টু বুদ্ধি আঁটেন ম্যাগি এবং কেট। তারা নানা উপায়ে দেয়ালের ভেতরে ঠকঠক শব্দ উৎপন্ন করতেন যেন মনে হতো দেয়ালের ভেতরে কেউ হাঁটছে। 

এই শব্দের কথা তাদের মা পাড়া প্রতিবেশীদের জানান এবং তাদেরকে বাড়িতে ডেকে শোনান। ঠিক এপ্রিলের ১ তারিখে সবাইকে সর্বোচ্চ বোকা বানিয়ে এই নাটকের অবসান ঘটানোর সিদ্ধান্ত ছিল তাদের। ১ তারিখ তারা দেয়ালের ভেতর দিয়ে হেঁটে বেড়ানো কাল্পনিক ভূতের সাথে কথা বলে সবাইকে অবাক করে দেন। হাস্যকর হলেও সত্য, ম্যাগি ও কেটের মা একবারও লক্ষ্য করেননি যে, সবাই যে ব্যাপারটা ভয় পাচ্ছে, তা তার ছোট মেয়ে দুটি মোটেই সমীহ করছে না। আবার এই ঘটনাটা ঠিক এপ্রিলের ১ তারিখেই ঘটলো, সেটা নিয়েও প্রতিবেশীদের মনে কোনো সন্দেহের উদ্রেক হলো না। নিজেদের নাটকের এমন সাফল্যে ম্যাগি এবং কেট যোগ দিলে রোচেস্টারে বসবাসকারী বোন লিয়ার সাথে। তারা ততদিনে সত্য প্রকাশের সিদ্ধান্ত পাল্টে শহরজুড়ে “ভূতের সাথে কথা বলা ক্ষমতাধর মানুষ” হিসেবে পাওয়া খ্যাতিতে গাঁ ভাসিয়ে দিয়েছেন! যদিও এর জন্য তাদের নিজ বাড়িটিও ছেড়ে আসতে হয়েছিল।

ফক্স বোনেরা; image source: monovisions.com

ততদিনে প্রগতিশীল মার্কিনরাও বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে এই ত্রয়ী প্রেতাত্মার সাথে কথা বলতে পারে। তার নিউ ইয়র্ক শহরে প্রেত গবেষণা বিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠানও খুলে বসে! কিন্তু সব কিছুতে জল ঢেলে দেন ম্যাগির স্বামী, যিনি দেখে ফেলেছিলেন ফক্স বোনত্রয়ীর প্রতারণা। ম্যাগি স্বীকার করে নিলে ব্যাপারটা যখন প্রায় নিভু নিভু, তখন ঘটলো অপর ঘটনাটি। ফক্সদের ফেলে আসা বাড়ি ততদিনে বিখ্যাত ভূতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। কোনো এক প্রতিবেশী, যিনি ভূতে বিশ্বাস করতেন না কিন্তু বিশ্বাসীদের ভয় দেখে বেশ মজা পেতেন, তিনি গিয়ে একদিন দেয়ালের ভেতর একটি মানুষের কঙ্কাল রেখে আসলেন। একদিন দিনের বেলা খেলতে গিয়ে একদল ছেলেমেয়ে সেটি আবিষ্কার করলে আবারো প্রেতাত্মার অস্তিত্বের ব্যাপারটা সামনে চলে আসে। এই কঙ্কাল নিয়ে এরপর অনেক জল ঘোলা হয়েছে। একে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কেউ বলেছেন এটা মানুষের না, কেউ বলেছেন মানুষের হলেও অন্তত শত বছর আগের, আর কেউ বা খুব সহজেই ধরে নিয়েছেন এটিও ফক্স বোনদের মতোই একটি ধোঁকা। বলা বাহুল্য, তৃতীয় দলের মানুষগুলোই এ ব্যাপারে সঠিক সিধ্যান্ত নিয়েছিলেন। আর যারা এটিকে বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন, তাদের বিশ্বাস আজও আমেরিকার একটা অংশের মধ্যে টিকে আছে মানুষের আর আত্মার সম্পর্ক নিয়ে।

৯. কমেডি বানাতে গিয়ে ইতিহাসের সেরা হরর মুভি!

উইলিয়াম ব্লাটি; image source: exorcist.wikia.com

সেই ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দ্য এক্সরসিস্ট’ সিনেমাটিকে এখনো বলা হয় পৃথিবীর ইতিহাসের সেরা হরর সিনেমা। অথচ এই সিনেমাটি হবার কথা ছিলে একটি কমেডি! সিনেমাটি যার উপন্যাস থেকে তৈরি করা হয়েছে, সেই উইলিয়াম পিটার ব্লাটি ছিলেন একজন মাঝারি মানের লেখক, যিনি কমেডি ঘরনার লেখালেখি করতেন। ‘আই ওয়াজ অ্যান আরব প্রিন্স’ নামক একটি কমেডি নাটকে অভিনয় করে বেশ জনপ্রিয়তা পান নিজের কৌতুকপূর্ণ কথা বলার ধরনের জন্য। এই জনপ্রিয়তার জন্যই তিনি ডাক পান তখনকার জনপ্রিয় মার্কিন টিভি রিয়েলিটি শো ‘ইউ বেট ইয়োর লাইফ’-এ। ব্লাটি এই শো জিতে নেন এবং ৫ হাজার ডলার পুরস্কার লাভ করেন, যা সে সময় বেশ বড় অঙ্কের অর্থ। অনুষ্ঠানের হোস্ট যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এই অর্থ দিয়ে তিনি কী করবেন, তখন তিনি কী উত্তর দিয়েছিলেন জানেন? “আমার পরবর্তী বই লেখার পেছনে ব্যয় করবো, যা আরব প্রিন্সের চেয়েও হাস্যরসাত্মক হবে।” কিন্তু ব্লাটি শেষতক রচনা করেছিলেন ইতিহাসের অন্যতম ভয়ানক উপন্যাস, ‘দ্য এক্সরসিস্ট’।

১০. মিথ্যা প্রচার করে রোমান্টিসিজমের সূত্রপাত ঘটান ম্যাকফারসন!

১৭৬০ সালে এডিনবার্গের এক স্কুল শিক্ষক জেমস ম্যাকফারসন “ফ্র্যাগমেন্টস অব অ্যানশেন্ট পোয়েমস কালেক্টেড ইন দ্য হাইল্যান্ডস অব স্কটল্যান্ড অ্যান্ড ট্রান্সলেটেড ফ্রম দ্য গ্যালিক অর আর্স ল্যাংগুয়েজ” শিরোনামে কিছু কবিতা প্রকাশ করেন। কবিতাগুলো ৩য় শতকের কোনো এক চারণকবি ওসিয়ানের লেখা বলে দাবি করেন ম্যাকফারসন। কবিতাগুলো বিস্ময়কর সাড়া জাগায় ইউরোপে। নেপোলিয়ন এত বেশি ভালোবাসতে কবিতাগুলোকে যে তিনি সেগুলোতে বর্ণিত স্থানসমূহের ছবিও আঁকিয়েছিলেন! দিদেরট, গ্যাটে, ক্লপস্টক, কলারিজ, ওয়াল্টার স্কট, ওয়ার্ডসওর্থ আর ইস্টের মতো কবিরা এর শৈল্পিকগুণে মজে ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং নিজেদের অনুপ্রেরণা বলে অভিহিত করেন। মূলত ওসিয়ানের এই কবিতাগুলোই ইউরোপীয় সাহিত্যে রোমান্টিসিজমের সূচনা করে।

ম্যাকফারসন; image source: divertinajes.com

অথচ ইউরোপ জুড়ে শিল্প, সাহিত্য আর সঙ্গীতে রোমান্টিসিজম আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটানো ওসিয়ানের কবিতাগুলো ছিল পুরোটাই মিথ্যা! ম্যাকফারসনের মৃত্যুর পর প্রমাণিত হয় যে তিনি কোনো গ্যালিক কবিতা আবিষ্কার করেননি, বরং নিজে লিখে সেগুলোকে অনুবাদ রূপে চালিয়ে দিয়েছিলেন! এখন ইতিহাসে ম্যাকফারসনের নাম একজন প্রতারক হিসেবে লেখা হলেও, রোমান্টিসিজমের সূচনা তার হাত ধরেই হয়, একথা ভুলে যাবার কোনো উপায় নেই।

ফিচার ছবি: youtube.com

Related Articles