চটপট একটি প্রশ্নের উত্তর দিন তো! যদি জিজ্ঞেস করি, সয়া সস, জাপানিজ মিসো এবং স্যাকের মধ্যে মিল কোথায়? আপনি যদি একজন জাপানিজ ফুড লাভার হয়ে থাকেন, তাহলে হয়তো উত্তর দিবেন- এই তিনটিই জাপানি খাদ্য উপকরণ, খুব সুস্বাদু এবং খাবারের স্বাদ বাড়ায়। নিঃসন্দেহে আপনার উত্তরটি সঠিক। তবে আরেকটি সঠিক উত্তর হচ্ছে, এই তিনটি খাদ্য উপকরণেই রয়েছে কোজি, যা বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে পোষা কুকুর-বিড়ালের মতো মাংসাশী প্রাণীর বিকল্প খাদ্য হিসেবে।
কী এই কোজি!
কোজি হচ্ছে একধরনের ছত্রাক বা ফাঙ্গাস, যার বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাসপারগিলাস অরয়েজি। কোজি একধরনের উদ্ভিজ্জণু, যা বহু এশিয়ান খাবারের মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বর্তমানে এই খাদ্য উপাদানটি ব্যবহার করে পোষা কুকুর এবং বিড়ালের খাদ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। উৎপাদনকারীরা আশা করছেন, এই খাদ্য পোষাপ্রাণীর খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে ভবিষ্যতে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে।
সাধারণত খাদ্যশস্য, যেমন- চাল বা ভুট্টার মধ্যে কোজি সরাসরিভাবে কালচার করা হয়ে থাকে। এই শস্য দানা থেকে প্রাপ্ত স্টার্চের সাহায্যে কোজি নামক ছত্রাক বিস্তার লাভ করে থাকে। পোষাপ্রাণীর খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, ওয়াইল্ড আর্থের প্রতিষ্ঠাতা রায়ান বেথেনকোর্ট বলেন, তারা প্রথমে একটি বিট ও চিনি মিশ্রিত দ্রবণের মধ্যে একে মিশিয়ে দেন। দ্রবণটি নিষ্কাশনের পর বাকি অংশকে চেপে চেপে তফুর মতো করে কেটে হালকা ভেজে নেন। ফলে এটি স্বাদে এবং গন্ধে অনেকটা পনিরের মতো হয়ে ওঠে।
রায়ান আরো বলেন, এই রেসিপি অনুসরণ করার মূল লক্ষ্য হচ্ছে, পোষা প্রাণীর জন্য একপ্রকার পরিবেশবান্ধব এবং উচ্চমানের খাবার তৈরি করা। ২০১৮ সালের জুনে এই কোম্পানিটি কুকুর এবং বিড়ালের জন্য এই বিশেষ কিবেলভিত্তিক খাবার বাজারে ছাড়বে বলে জানিয়েছিল।
যদিও এর আগে কুকুরের জন্য ভেষজ উপায়ে তৈরি খাবার বাণিজ্যিকভাবে বাজারে এসেছিল। তবে যারা ভেজিটেরিয়ান এবং মাংসকে খাবারের তালিকা থেকে ইতোমধ্যে বাদ দিয়ে দিয়েছেন, তাদের মধ্যে কুকুরের জন্য কোজি দিয়ে তৈরি এই খাদ্য ব্যাপক সাড়া ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে। মাংসের পরিবর্তে উদ্ভিদজাত খাদ্যশস্যের বাজার দিন দিন এতটাই বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, ২০১৭ সালে এই বাজারের মোট পরিমাণ ছিল ৪.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাশাপাশি ২০১৭ সালে এই বাজারের বেচাকেনার পরিমাণ বেড়েছিল প্রায় ৮.১ শতাংশ।
পোষা প্রাণীর জন্য শস্যভিত্তিক খাবার তৈরি করতে, খাবারে কোজি ব্যবহারের আইডিয়াটি প্রথম দিয়েছিলেন কোম্পানিটির সহপ্রতিষ্ঠাতা রন শিগেতা। রন হচ্ছেন তৃতীয় প্রজন্মের একজন জাপানি বংশোদ্ভূত আমেরিকান এবং কোজি উৎপাদনকারী।
পোষা প্রাণীর খাবারে কোজি ব্যবহার করার আইডিয়া আবিষ্কার করার কথা বলতে গিয়ে রায়ান বলেন,
আমাদের রনের কাছে তো সবসময়, সবখানে কোজি থাকেই। তা দেখে আমরা ভাবতে লাগলাম, শুধুমাত্র ফ্লেভার হিসেবে ব্যবহার করা ছাড়াও যদি এই কোজিকে প্রোটিনের উৎস হিসেবে খাবারের মধ্যে ব্যবহার করি, তাহলে কেমন হয়?
তাদের প্রাথমিক একটি গবেষণায় তারা দেখেছিলেন, কোজিকে যদি সলিড বা শক্ত করে তৈরি করা হয়, তাহলে প্রায় ৫০ শতাংশ প্রোটিন এর মধ্যে থাকে। তবে চাক করে কাটা একটি কোজির ফালিতে প্রায় ৩০ শতাংশ প্রোটিন থাকে। এর সাথে চর্বি, ফাইবার এবং অন্যান্য পুষ্টি যুক্ত করার জন্য কোজিকে বিভিন্ন ধরনের সবজি, যেমন- মিষ্টিকুমড়া, মিষ্টি আলু, আলুর আটার মধ্যে মিশিয়ে দেয়ার কথা ভাবা হয়। কোজি দিয়ে তৈরি কুকুরের জন্য বিশেষ এই খাবারটি লোলা নামক একটি কুকুরকে দিয়ে সবার প্রথমে টেস্ট করানো হয়েছিল।
কুকুর-বিড়ালের খাদ্যাভ্যাস এবং কোজি
প্রোটিনের উৎস হিসেবে কোজি যতই মানসম্পন্ন হোক না কেন, এটি কি আসলেই কুকুর বা বিড়ালের খাদ্য হিসেবে উপযুক্ত?
পোষা প্রাণীর জন্য মানসম্পন্ন এবং উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের চাহিদা আমেরিকানদের মধ্যে দিনকে দিন বেড়ে চললেও প্রাণীদের খাবারের উচ্চ-প্রোটিন বলতে কী পরিমাণ প্রোটিনকে বোঝানো হবে তার কোনো সরকারি নির্দেশনা সেখানে নেই। ফলে পশুচিকিৎসক এবং পুষ্টিবিদ এমি ফারকাস পোষা প্রাণীর খাবার নির্ধারণের বেলায়, নিজস্ব কিছু নিয়মকানুন মেনে চলেন। এই নিয়মানুসারে, কুকুরের জন্য নিম্ন পর্যায়ের প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারে, প্রতিদিন ১০-১৫% ক্যালোরি প্রোটিন থেকে আসে। অন্যদিকে গতানুগতিক খাদ্যাভ্যাসে একটি কুকুর প্রতিদিন মোটামুটি ২৫-৩৫% ক্যালোরি প্রোটিন থেকে পায়। তবে কোনো প্রোটিনভিত্তিক খাবারে যদি ৩৫% এর বেশি ক্যালরি থাকে, তাহলে তাকে বলা হয় উচ্চ-প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার।
কুকুরের খাবারে প্রোটিনের পরিমাপ করার পদ্ধতি ইচ্ছামাফিক উপায়ে তৈরি। তবে ফারকাস উল্লেখ করেন, স্বাস্থ্যবান কুকুরের জন্য প্রোটিন গ্রহণের কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই। অর্থাৎ যতক্ষণ না তাদের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি এবং চর্বির অভাব পূরণ না হবে, ততক্ষন পর্যন্ত তারা প্রোটিন গ্রহণ চালিয়ে যেতে পারে।
টরন্টোর একজন ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র পরিচালক জ্যাক রয়টর বলেন, তার ১৩ বছর বয়সী কুকুর আলভী ইতোমধ্যে ঘরে তৈরি ভেষজ খাবারের প্রতি বেশ ভালোভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তিনি আরো বলেন, তিনি তার কুকুরের খাদ্যতালিকায় কোজি অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবছেন। আলভী এমনিতেও তফু খেতে পছন্দ করে, ফলে কোজিও আলভীর পছন্দ হবে বলে তিনি ধারণা করছেন।
বিভিন্ন ধরনের খাদ্যাভ্যাসের সাথে কুকুরের স্বাস্থ্য এবং জীবনের মান কীভাবে পরিবর্তিত হয়- এর উপরে ইতোমধ্যে যদি কোনো গবেষণা করা হয়ে থাকে, তাহলে সেই গবেষণা থেকে সহজেই ধারণা করা যেত যে, ভেষজ খাদ্যাভ্যাসের ফলে কুকুরের স্বাস্থ্য এবং জীবনে কী ধরনের প্রভাব পড়ে?
ওয়াইল্ড আর্থের প্রতিষ্ঠাতা রায়ান মনে করেন, তার কোম্পানি খুব শীঘ্রই এই প্রশ্নের উত্তর সকলের সামনে উপস্থাপন করবে। তিনি বলেন,
যদিও এখন আমাদের হাতে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ তথ্য এবং উপাত্ত নেই। তবে মাংস এবং তেল পরিহার করা জিটেরিয়ান খেলোয়াড়দের কথাই চিন্তা করে দেখুন, আমরা মনে করি পোষা প্রাণীর জন্যও এই ভেষজ খাদ্যাভ্যাস আশ্চর্যজনক হলেও উপকারীই হবে।
কোজি নামক ছত্রাককে পোষা প্রাণীর ভবিষ্যৎ খাদ্যাভ্যাস হিসেবে ধরা হলেও, বিড়ালের বেলায় শুধুমাত্র কোজি দিয়ে খাবারের কাজ চালিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিড়াল পুরোপুরিভাবে একটি মাংসাশী প্রাণী এবং বেঁচে থাকার জন্য তাকে অবশ্যই টরিন এবং আর্কিডনিক এসিডের দরকার পড়ে। যার চাহিদা ভেষজ খাদ্য থেকে বিড়াল পূরণ করতে পারবে না। ফারকাস বলেন,
যদিও বিড়ালের ক্ষেত্রে চর্বি এবং প্রোটিনের চাহিদা কুকুরের চাইতেও অনেক বেশি, তবে তারা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ উদ্ভিদজাত খাবার তাদের খাদ্যে সহ্য করে নিতে পারে।
তবে রায়ান বলেন, তার কোম্পানি ইতোমধ্যে বিড়ালের জন্য একপ্রকার আমিষজাত খাবার উৎপাদনের পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছেন, যা ল্যাবরেটরিতে ইদুরের কোষ থেকে তৈরি হবে।
দরদাম
কিছুটা মানবিক দিক থেকে চিন্তা করলে, এসব পোষা প্রাণীর খাদ্য পণ্য, পৃথিবীর গৃহপালিত প্রাণীদের খাবার এবং এর পরিবেশগত প্রভাব কমিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০১৭-১৮ সালের ন্যাশনাল পেট ঔনারস সার্ভে অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ প্রায় ৪৭.১ মিলিয়ন বিড়াল এবং ৬০.২ মিলিয়ন কুকুর বাসাবাড়িতে পুষে থাকে। এসব কুকুর-বিড়াল তাদের সাথেই উঠে, বসে এবং খাবার খেয়ে থাকে।
এই সমীক্ষার ফলাফল এবং বিশ্বজুড়ে পোষা প্রাণীর জন্য প্রিমিয়াম কোয়ালিটির খাবারের চাহিদার বিস্তার দেখে ইউসিএলএ’র ভূগোলবিদ গ্রেগরি ওকিন পোষা প্রাণীর খাবারের উৎপাদন এবং এর পিছনে মানুষের খরচের পরিমাণ হিসেব করতে শুরু করেন।
তার হিসেব মতে, প্রতি বছর আমেরিকাতে যত কুকুর-বিড়াল আছে, এদের সবার খাদ্য চাহিদা মেটাবার জন্য যে পরিমাণ ক্যালরির প্রয়োজন, তা দিয়ে প্রায় ৬২ মিলিয়ন আমেরিকান জনগণের খাদ্য চাহিদা মেটানো যায়। আর পোষা প্রাণীর জন্য এই বিপুল পরিমাণ খাদ্যের মূল উৎস অন্যান্য কোনো প্রাণী থেকেই আসে। যদিও অন্যান্য প্রাণীর উপজাত, যা কুকুর-বিড়ালের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তা খুব একটা ব্যয়সাধ্য নয়; কিন্তু এসব উপজাতকে খাবারের উপযোগী করে তোলা কিছুটা দুরূহ। আর পোষা প্রাণীর জন্য বাজারজাত কিবেল উৎপাদন প্রক্রিয়াটিও দিন দিন শক্তিসাপেক্ষ হয়ে উঠছে।
কোজি যদি কুকুরের বা বিড়ালের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তাহলে এটি পরিবেশগতভাবে কতটা প্রভাব ফেলবে তা আগে থেকেই বলা যাচ্ছে না। আর প্রাকৃতিক খাবারের সাথে এর তুলনা করতে গেলেও প্রথমে পোষা প্রাণীর খাবার হিসেবে একে বাজারে আসতে হবে।
মানুষের জন্য কোজি!
বেথেনকোর্ট বলেন, ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের খাদ্যতালিকায় প্রোটিনের উৎস হিসেবে কোজি অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। উদাহরণস্বরুপ কিছু উন্নত দেশের কথা বলা যেতে পারে, যেখানে খাদ্য বিনষ্ট হয়ে যাওয়া একটি উদ্বেগের কারণ। এসব দেশে এই ফাঙ্গাসভিত্তিক কোজি একটি ভাল সমাধান হতে পারে। যেহেতু প্রোটিনের এই উৎসটি প্রথমত, সহজে পচনশীল নয়; এবং দ্বিতীয়ত গুণগত মানের বিচারে বেশ ভাল, তাই এটি দুর্গম অঞ্চলে যুদ্ধরত সৈনিকদের জন্যও খাবারের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
প্রচলিত খাদ্যসমূহ বিড়াল বা কুকুরের বর্তমান খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে থাকলেও আগামীতে তাদের খাবারের মুখরোচক বিকল্প হিসেবে কোজি একটি বিশেষ জায়গা করে নিতে পারে।
কুকুর-বিড়ালের খাবারের বিকল্প হিসেবে ভাবা হলেও, যেহেতু কোজিতে পুষ্টিগুণ সম্পন্ন প্রোটিন রয়েছে, তাই দূর ভবিষ্যতে যদি পৃথিবী খাদ্য সংকটের মুখে পড়ে, তাহলে মানুষের খাবারের উৎস হিসেবেও এটি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে। আপাতত মাংসাশী প্রাণী কুকুরের জন্য, বিকল্প খাদ্য হিসেবে নিরামিষভিত্তিক কোজি কতটুকু সহায়ক হয় সেটিই দেখার বিষয়।