ভোজনরসিক না হয়ে থাকলে আপনি সাধারণত একইরকম খাবার নিয়মিত খেয়ে থাকেন। তবে আপনি কি জানেন কিছু কিছু খাবার এমন আছে যেগুলো একসাথে খাওয়া ঠিক নয়, এমনকি সেগুলো বিপজ্জনকও হতে পারে। এক খাবারে যে এনজাইম রয়েছে তা অন্য খাবারে থাকা এর নিজস্ব এনজাইমের গুণাগুণ নষ্ট করে দিতে পারে। তাই সেসব খাবার একসাথে না খেয়ে অস্বাস্থ্যকর সমন্বয় থেকে বিরত থাকুন।
পানীয় ও খাবার
খাবার খাওয়ার পর অথবা খাওয়ার সময় বিভিন্ন পানীয়, যেমন- চা, কফি, জুস, এমনকি পানি পান করা থেকে বিরত থাকুন। কারণ এতে আপনার শরীরে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট হজমের জন্য প্রয়োজনীয় সব এনজাইম জলমিশ্রিত হয়ে নিস্তেজ হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও এটি আপনার হজমশক্তির কার্যকরীতা কমিয়ে শরীরে চর্বি জমিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা রাখে, যা পাকস্থলীকে শিথিল করে দিতে পারে।
পানি পানের আদর্শ সময় হলো খাবার খাওয়ার অন্তত ৩০ মিনিট আগে এবং খাবার খাওয়ার আধা ঘণ্টা পর। খাবার খাওয়ার অন্তত ১৫ মিনিট আগে পানি খাওয়ার উপকারিতা হলো যে, এতে করে আপনার পেট কিছুটা ভরা থাকবে এবং আপনার ক্ষুধা কম লাগবে। তাই স্বাভাবিকের তুলনায় আপনি কিছুটা কম খাবেন। খাওয়ার ৩০ মিনিট পর গরম চা খাওয়া ভালো। কারণ এতে করে সেই গরমের তাপ ফ্যাটগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি পরিমাণে ভেঙে থাকে।
খাওয়ার সময় অথবা পরে ফলমূল খাওয়া
মাঝে মাঝে মাছের সাথে ম্যাঙ্গো সালসা বা ডেজার্ট হিসেবে অ্যাপেল পাই হয়তবা খেয়ে থাকেন। কিন্তু খাওয়ার সময় বা খাওয়ার ঠিক পরপর ফলমূল খাওয়া ঠিক নয়। কারণ ফলমূল অন্ত্রে হজম হয়ে পাকস্থলী দিয়ে খুব দ্রুত পার হয়ে যায়। অন্যদিকে, খাবার জটিল এবং হজম হতে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় নেয়। যখন আপনি ফল জাতীয় বিভিন্ন খাবার, যেমন- গম বা শস্যের সাথে মেশান, তখন ফলমূল অধিক সময়ের জন্য আপনার পাকস্থলীতে থেকে যায় এবং সক্রিয় হওয়া শুরু করে। কারণ ফলমূল চিনির মতো কাজ করে। তাই খাবার খাওয়ার ৩০-৬০ মিনিট আগে ফলমূল খাওয়ার চেষ্টা করুন। যখন খাওয়ার আগে খালি পেটে ফলমূল খাওয়া হয়, তখন এটি হজমের বিস্তারকে পরবর্তীতে খাওয়া সব খাবার হজমের জন্য প্রস্তুত করতে থাকে। পানি সেই হজমের বিস্তারকে পরিষ্কার ও হাইড্রেট করে, ফাইবার পরিষ্কার রাখে এবং এনজাইম হজমের রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে কার্যকরী করে। আর তাই খাওয়ার আগে ফলমূল খেলে তা হজম প্রক্রিয়াকে অধিক পরিমাণে পুষ্টিগুণ শোষণ করতে সাহায্য করে।
গ্রিলড চিজ স্যান্ডুউইচ
মূলত, প্রোটিন-স্টার্চ সমন্বয়টি এড়িয়ে চলা উচিত। এর মধ্যে রয়েছে লাজানিয়া, টার্কি স্যান্ডুউইচ, মাংস ও আলু এবং চিকেন ও পাস্তা। ঠিকভাবে হজম হওয়ার জন্য প্রোটিন এবং স্টার্চের ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হজম বা পাচক এনজাইম ও অম্লতার মাত্রা দরকার হয়। বিভিন্ন ধরনের পাচক রস একে অন্যের কার্যকারিতা অকার্যকর করে দেয় এবং এর কারণে পেট ফেঁপে যাওয়া, স্ফীত হওয়া ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যাগুলো দেখা দেয়। এর বদলে আপনি প্রোটিন বা স্টার্চ জাতীয় খাবারগুলো স্টার্চ ব্যতীত সবজির সাথে মিলিয়ে খেতে পারেন। যদি একদমই এরকম হয় যে, প্রোটিন ও স্টার্চ জাতীয় খাবার একসাথে মিলিয়ে খেতে হচ্ছে, তাহলে এর সাথে কিছুটা সবুজ শাকসবজি দিয়ে নিন। এতে করে এর নেতিবাচক প্রভাব কমে যাবে।
টমেটো এবং চিজ পাস্তা সস
আপনি হয়তো বা টমেটো, চিজ সস বা গরুর মাংস ছাড়া পাস্তার কথা চিন্তাও করতে পারেন না। কিন্তু এতে করে আপনার দৈহিক গঠনতন্ত্রে ক্ষতি হতে পারে। টমেটো হলো ক্ষারীয়, আর তাই এটি স্টার্চ জাতীয় কার্বোহাইড্রেট যেমন-পাস্তা মেশানো উচিত নয়। খাবার মিশ্রণের তত্ত্ব কার্বোহাইড্রেট ও ক্ষার একত্রিত করার পরামর্শ দেয় না। টমেটোতে যে এসিড বা ক্ষার রয়েছে তা পাস্তাতে থাকা এনজাইমকে দুর্বল করে দেয় এবং চিজে থাকা দুগ্ধজাতকে ঘন করে ছানার মতো একটা আভা এনে দেয়। এছাড়াও টমেটো ও চিজ পাস্তা সসের সমন্বয়টি হজম করা আপনার শরীরের জন্য বেশ কঠিন। এতে করে খাওয়ার পর আপানর ভেতর অবসাদ বা ক্লান্তিভাব কাজ করতে শুরু করে। কারণ খাবারটি হজম করার জন্য আপনার শরীর প্রচুর পরিমাণে এনার্জি দরকার হয়। তাই খাওয়ার পর ঝিমুনি বা ক্লান্তি এড়াতে আপনি পাস্তার সাথে পেস্তো সস এবং গ্রিলড শাকসবজি খেতে পারেন।
ভেজিটেবল অয়েলে ভাজা গরুর মাংস
এটি মূলত ভুল রকমের খাবারের ফ্যাটের সমন্বয়। এর মধ্যে রয়েছে পাউরুটির সাথে জলপাই বা টুনা মাছের সাথে মেয়োনিজ। আর এর খারাপ সমন্বয় হওয়ার কারণ হলো যে, ফ্যাট ভাঙার জন্য পিত্ত লবণ ও পিত্ত কোষ প্রয়োজন হয়। ফ্যাটের সাথে অন্যান্য পাচক রাসায়নিকগুলো মিশে শরীরে অসুখ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ফ্যাট জাতীয় খাবারের সাথে উচ্চ মাত্রার প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেলে তা আপনার হজম প্রক্রিয়াকে মন্থর করে দিতে পারে। তাই এর বদলে আপনি অল্প পরিমাণে অশোধিত এবং জৈব ফ্যাট, যেমন- জলপাই বা নারিকেল তেল দিয়ে শাকসবজি, শস্য ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার রান্না করে খেতে পারেন। প্রোটিন ফ্যাট, যেমন- অ্যাভোক্যাডো, বীচি এবং যেকোনো ধরনের বাদাম শুধুমাত্র স্টার্চ ব্যতীত শাকসবজির সাথে মিশিয়ে খাওয়া উচিত। এছাড়াও এ ধরনের পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে যে, ফ্যাট জাতীয় খাবার খাওয়ার সময় কাঁচা সবুজ শাকসবজি খাওয়া ভালো।
দুধ এবং সিরিয়াল (খাদ্যশস্য) বা ওটমিল ও কমলার রস
এককথায় বলতে গেলে, এই ধরনের খাবার একসাথে খাওয়ার অভ্যাস থাকলে আপনার প্রতিদিনের সকালের নাস্তা হলো খাবারের ভয়ংকর এক সমন্বয়। এই খাবারের সমন্বয়টি আপনার জন্য ক্ষতিকর, কারণ দুধ এবং সিরিয়াল দুটোতেই রয়েছে দ্রুত হজম করার কার্বোহাইড্রেট। এর ফলে আপনার শরীর কঠিন চাপ বা ধকলের শিকার হতে পারে এবং ব্লাড সুগারের মাত্রাও বেড়ে যেতে পারে। যখন আপনার ব্লাড সুগার স্বাভাবিক মাত্রায় ফিরে আসবে, তখন আপনি ক্লান্তিবোধ করবেন এবং আপনার ফাস্ট ফুড খেতে ইচ্ছে করবে। সিরিয়াল বা ওটমিলের সাথে কমলার জুস খাওয়াও ক্ষতিকর। কারণ কমলার রসে আছে এসিড বা ক্ষার, যা ওটমিল ও সিরিয়ালে থাকা স্টার্চ হজম করার কাজে নিয়োজিত এনজাইমকে ভেঙে ফেলে বা নষ্ট করে ফেলে। এছাড়াও এটি দুধকে ঘন করে তুলে গুরুপাক ও শ্লেষ্মার মতো পদার্থে পরিণত করতে পারে।
কলা ও দুধ
আয়ুর্বেদের মতে, এই খাবার দুটির সংমিশ্রণ সবচাইতে ভারী ও বিষাক্ত। এটি শরীরে এক রকম ভারী ভাব এনে দেয় এবং মনকেও মন্থর করে দেয়। কলা ও দুধ দিয়ে বানানো স্মুদি যদি আপনার খুবই প্রিয় খাবার হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই লক্ষ্য রাখুন যেন কলাটি খুব বেশি পাকা হয়। এছাড়াও হজমের সুবিধার জন্য এতে জায়ফল ও এলাচি যোগ করুন।
Feature Image Source: Simply Recipes