হইয়া বাছিউ: এক রহস্যময় ভূতুড়ে বনের ইতিবৃত্ত

সময়টা যখন বিজ্ঞানের, তখন আশেপাশের ঘটে যাওয়া সব ঘটনাগুলোকে যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণ অনিবার্য। নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা কাজ করে চলেছেন প্রতিটি ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটনে। খুব সাধারণ ঘটনা, যেমন- ‘আটার সাথে পানি মেশালে কেন তাপ অনুভূত হয়’ থেকে শুরু করে অস্বাভাবিক ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান- সবক্ষেত্রেই গবেষণা করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা।

বিজ্ঞানের সকল সম্ভাব্য কারণকে উপেক্ষা করে গুরুতর রহ্যস্যকে ধারণ করে যুগের পর যুগ দাঁড়িয়ে রয়েছে এক বিশাল বন। নানারকম অদ্ভুত ঘটনার ঘটনাস্থল এই বন। ঘটনাগুলোর বর্ণনা শুনে ঠিক সাধারণ বিষয় বলে মেনে নেয়া যায় না, বরং কোনো এক অস্বাভাবিক বিষয়ের দিকেই ইঙ্গিত করে। বিজ্ঞানীরা বছরের পর বছর বহু চেষ্টা করেও এর রহস্যের কোনো কূল-কিনারা করতে পারেননি। যার ফলে অসংখ্য গাছ-গাছালিতে ঘেরা বনটি ‘ওয়ার্ল্ড’স মোস্ট হন্টেড ফরেস্ট’ হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে সকলের কাছে। আজকে আপনাদেরকে কিছু সময়ের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে সেই ভৌতিক বনের দৃশ্যপটে।

হইয়া বাছিউ; Image Source: gapyear.com

রোমানিয়ার ট্রান্সসিলভানিয়ায় অবস্থিত ক্লাজ নাপোকা শহরে হইয়া বাছিউ নামক একটি বন অবস্থিত। এই বনে প্রায়শ ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অতিপ্রাকৃত ঘটনা বনটিকে ভৌতিক ও রহস্যময় করে রেখেছে। প্রায় ২৫০ হেক্টর জায়গার উপর বনটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই বনের গাছগুলোর আকৃতিও কিছুটা অস্বাভাবিক, কেমন যেন ডালে ডালে প্যাঁচানো সব  গাছ। অশরীরী কোনো কিছুর উপস্থিতি, অদ্ভুত কিছুর আবির্ভাব, আলোর বলয় সহ এমন অনেক কিছুরই বর্ণনা পাওয়া যায় এলাকাবাসী এবং বন পরিদর্শনে আসা লোকদের কাছ থেকে।

বনের গাছ; Image Source: gapyear.com

বনে ঘুরতে আসা প্রায় সকলের কাছ থেকেই শোনা যায়, তারা বনে থাকার পুরো সময়টা জুড়েই এক ধরনের অস্বাভাবিক মানসিক উদ্বিগ্নতায় ভুগে থাকেন। শুধু তা-ই নয়, তারা অনুভব করেন, কেউ তাদেরকে প্রতিনিয়ত চোখে চোখে রাখছে। ১৯৬৮ সালে এই বনটি সর্বপ্রথম বিশ্ববাসীর কাছে তার রহস্য নিয়ে পরিচিত হয় এমিল বার্নিয়া নামক এক ব্যক্তির তোলা ছবির মাধ্যমে। এই বনে ভ্রমণের প্রাক্কালে এমিল বার্নিয়া একটি ইউএফও দেখেন বলে দাবি করেন এবং সাথে সাথেই তিনি তা ক্যামেরাবন্দী করে ফেলেন। ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কিছুদিন পরেই জীববিজ্ঞানী আলেক্সান্ডু শিফট সেখানে অনেক পরীক্ষা নিরিক্ষা করেন এবং আশেপাশের এলাকাবাসীদের সাথে কথা বলেন। এলাকাবাসীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা এমন গোলাকৃতির তীব্র আলোর বলয় বন থেকে উর্ধ্বাকাশের দিকে মাঝে মাঝে যেতে দেখেছেন। ২০০২ সালে সর্বশেষ ইউএফও দেখেছিলেন দু’জন ক্লাজবাসী। তারা বনের খুব কাছাকাছি প্রতিবেশী শহর মানাস্তুরে থাকেন। তারা সিগারেটের মত লম্বা, প্রায় ৫০ মিটার দীর্ঘ একটি অতি উজ্জ্বল আলোকবস্তু বন থেকে আকাশের দিকে ছুটে যেতে দেখেছিলেন। প্রায় ২৭ সেকেন্ডের জন্য তারা বস্তুটিকে দেখতে পেয়েছিলেন।

Image Source: theeventchronicle.com

কথিত আছে, একবার এক মেষপালক প্রায় ২০০টি মেষশাবককে ঘাস খাওয়ানোর জন্য এই বনে প্রবেশ করেছিল। আশ্চর্যজনকভাবে তারা আর কখনো ফিরে আসেনি, একেবারে গায়েব হয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনার পরে অনেকেই এই বনে প্রবেশ করতে যথেষ্ট পরিমাণ ভয় পায়। তাদের মাঝে একধরনের ভীতি কাজ করে, একবার এই বনে কেউ গেলে হয়ত আর ফিরে আসবে না কোনোদিন। এরপরেও সাহস করে যারা গেছেন, তারা মাথা ঘোরা, মাথাব্যথা, বমিভাব, গায়ে ফোস্কা পড়া, আঁচড়, শরীরের বিভিন্ন স্থানে পুড়ে যাওয়া সহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক অসুবিধার শিকার হয়েছেন।

মেষশাবকের পাল আর ফিরে আসেনি; Image Source: hoiabaciuforest.com

অনেক ক্ষেত্রে মানুষ বনে প্রবেশের পর নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এরপর যখন তারা ফিরে আসেন, তারা কিছুতেই মনে করতে পারেন না বিগত সময়টুকুতে তাদের সাথে কী ঘটেছিল বা তারা কোথায় গিয়েছিলেন। একবার পাঁচ বছর বয়সী একটি মেয়ে ঘুরতে ঘুরতে বনে প্রবেশ করে এবং রীতিমতো গায়েব হয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার কোনো হদিস মেলেনি। ঠিক পাঁচ বছর পর ঐ মেয়েটি অক্ষত অবস্থায় সেই একই অমলিন পোশাকে বন থেকে বেরিয়ে আসে। তার কাছে যখন জানতে চাওয়া হয় সে কোথায় গিয়েছিল, এতদিন কোথায় ছিল- মেয়েটি কিছুই বলতে পারেনি। গত পাঁচ বছরের কোনো কিছুই সে স্মরণ করতে পারেনি।

বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, এই বনে অস্বাভাবিক মাত্রায় তেজস্ক্রিয় বিকিরণ, মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ ও ইনফ্রারেড বিকিরণ হয়ে থাকে। এছাড়াও এখানে চুম্বকীয় ও তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের বেশ কিছু বিচ্যুতি রয়েছে। বনের ঠিক মাঝখানে এমন একটি জায়গা রয়েছে, যেখানে কখনো কোনো ঘাস বা অন্যান্য কোনো গাছ-গুল্ম জন্মাতে দেখা যায়নি। বিজ্ঞানীরা এখানকার মাটি নিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন, কিন্তু পরীক্ষা করে এমন কোনো পদার্থের উপস্থিতি সেখানে পাওয়া যায়নি, যার কারণে কোনো উদ্ভিদের জন্ম এবং বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে। স্থানীয় বাসিন্দারা এই জায়গাটিকে ভূতুড়ে ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু বলে থাকেন। তাদের ধারণা, কোনো অশরীরী কিছু বা অতৃপ্ত আত্মার বাস এ জায়গায়।

এই সেই নিষ্ফলা জায়গা; Image Source:

‘৯০ এর দশকেও এখানে ঘটে যাওয়া একটি ভূতুড়ে ঘটনার কথা লোক মুখে শোনা যায়। এই বনের আশেপাশেই কোনো এক জায়গায় সেনাবাহিনীর ট্রেনিংয়ের জন্য ক্যাম্প করা হয়েছিল। ট্রেনিং চলার প্রাক্কালে কিছু সৈন্য এক জায়গা থেকে গাড়ি করে তাদের ক্যাম্পে ফিরছিলেন। পথিমধ্যে তাদের সাথে দেখা হয় বয়স্ক এক লোকের, কোথাও হয়ত যাচ্ছিলেন তিনি। জিজ্ঞেস করে তারা জানতে পারেন যে, তিনিও ঐ একই দিকে যাবেন। অতঃপর সৈন্যরা তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে পুনরায় রওনা দিলেন। ঢাল বেয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর সৈন্যরা হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখেন, পেছনের সিটে কেউ বসে নেই, যেন হাওয়ার সাথে মিলিয়ে গেছে সেই বৃদ্ধ মানুষটি। এই ঘটনার পরপরই তদন্ত করা হয়। কিন্তু পরে সেই ব্যক্তিকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি বা রহস্যেরও কোনো কূল-কিনারা করা যায় নি।

Source:hoiabaciuforest.com

এমন ভূতুড়ে ঘটনাবলীর কারণস্বরূপ এলাকাবাসীরা বলে থাকেন, রোমানিয়ার বেশ কিছু চাষীকে নাকি অন্যায়ভাবে এই বনে হত্যা করা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে। তাদের অতৃপ্ত আত্মাগুলো হয়ত এই বনে আটকে রয়েছে। রহস্যময় আলোর কুন্ডলী, বনের গাঢ় স্তব্ধতা ভেদ করে অদৃশ্য রমণীর কন্ঠস্বর এবং কখনো বা হাসির আওয়াজ- এ সকল ঘটনা প্রায়শই এলাকাবাসী প্রত্যক্ষ করে থাকেন। বনের গাছগুলোর মাঝ দিয়ে মাঝে মাঝে সারি সারি আলোকরশ্মি বেরিয়ে আসতে দেখেন স্থানীয়রা। এত আলোকরশ্মির কারণে সেই জায়গার তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু থার্মাল ডিটেক্টর দিয়ে মেপে তাপমাত্রার কোনো তারতম্য পরিলক্ষিত হয়নি।

বছরের পর বছর যে রহস্যকে আগলে রেখেছে এই বন, তার স্বরূপ উন্মোচনে বিজ্ঞানীরা লেগে রয়েছেন দিনের পর দিন। কিন্তু কোনোভাবেই রহস্যের জালটাকে ঠিক ছিন্ন করতে পারছেন না। সকল নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আজও ভৌতিকতার ঘন অন্ধকারে ঢাকা পড়ে রয়েছে ট্রান্সসিলভানিয়ার এই বনটি।

ফিচার ইমেজ: goldenbattles.com

Related Articles

Exit mobile version