বর্তমান বিশ্বে খুবই আলোচিত একটি বিষয় হলো জলবায়ু পরিবর্তন। বিশ্বের রথী-মহারথী থেকে শুরু করে আমজনতা; সবাই এ নিয়ে বেশ চিন্তিত। আন্তর্জাতিক থেকে জাতীয় পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিভিন্ন শিরোনামে প্রায়ই সভা সেমিনার ও গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কোনো কোনো দেশে এই সমস্যা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে জলবায়ু তহবিলও গঠন করা হচ্ছে। প্রত্যেক বছর বছর বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির অংশগ্রহণে ঘটা করে অনুষ্ঠিত হচ্ছে জলবায়ু সম্মেলন। পত্রপত্রিকায়ও সংবাদগুলো বেশ ফলাও করে প্রচারিত হচ্ছে।
কিন্তু এই সম্মেলন কতটা ফলপ্রসূ হচ্ছে? আদৌ কি এর ফলে কোনো সমাধানের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে? বরং প্রতিবছরই জনসংখ্যা সমস্যার মতো প্রকটভাবে সহ্য করতে হচ্ছে জলবায়ু সমস্যার বিরুপ প্রভাবগুলো। এই পৃথিবীর উপর নিয়মিত ভয়াল থাবা বসিয়ে যাচ্ছে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ভূমিকম্প, বন্যা, সাইক্লোন, অগ্ন্যুৎপাতসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
এতে বিপর্যস্ত হচ্ছে জনজীবন, হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে প্রাণের অস্তিত্ব। তবে অপ্রিয় সত্য হলো, এর নেপথ্য আমাদের ভূমিকাই বেশি। সভ্যতার বিকাশের পূর্ব থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত নিজেদের কল্যাণে আমরা স্বার্থপরের মতো বেপরোয়া আচরণ করে চলেছি পৃথিবীর সাথে, প্রাণীকূলের সাথে। নিজেরা ভাল থাকতে গিয়ে দূষিত করছি এই গ্রহটিকে। আর তারই ফলাফল আজ দেখা দিয়েছে প্রকটভাবে।
প্রাকৃতিক পরিবেশ টিকে থাকার প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর ভারসাম্যহীনতায় ভুগছে বর্তমান পৃথিবী। ক্ষতিগ্রস্ত যাচ্ছে ওজন স্তর, পানির স্তর নেমে যাচ্ছে ভূপৃষ্ঠ থেকে আরো গভীরে। এছাড়া জলবায়ু সমস্যার কারণে পৃথিবীর আবহাওয়া ক্রমশ আরো উষ্ণ হয়ে উঠছে। ফলে মানুষসহ পৃথিবীতে বসবাসরত অন্যান্য প্রাণীরও জীবন ধারণে বিরুপ প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। পৃথিবীর তাপমাত্রা উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হয়ে ওঠায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে প্রাণীকূল। হতভাগা সেই প্রাণীগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে সি টার্টল তথা সামুদ্রিক কচ্ছপ।
সামুদ্রিক কচ্ছপ কিংবা সবুজ কচ্ছপ নামে পরিচিত এই জলজ প্রাণীর বৈজ্ঞানিক নাম চেলোনিয়া মায়ডাস। এরা কর্ডাটা পর্বের চেলনিয়া গণের অন্তর্ভুক্ত একটি জলজ প্রাণী। ছোট মাথা ও ঘাড় সম্পন্ন দীর্ঘকায় এই কচ্ছপগুলো আকৃতিতে ১.৫ মিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট হয়ে থাকে। সমুদ্রের বুকে আবাস গড়ে তোলা বিশালকায় এই কচ্ছপগুলো ওজনেও কিন্তু কম নয়। প্রাপ্তবয়স্ক একটি সবুজ কচ্ছপের ওজন সাধারণত ৬৮-১৯০ কেজি তথা ১৫০-৪১৯ পাউন্ড পর্যন্ত হয়ে থাকে।
বিশালাকার এই কচ্ছপগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গ্রীষ্মমন্ডলীয় (Tropical) ও উপক্রান্তীয় (Sub Tropical) মহাসাগরীয় অঞ্চল জুড়ে। ট্রপিক্যাল অঞ্চলাধীন আটলান্টিক মহাসাগর, পশ্চিম আটলান্টিক মহাসাগরীয় অঞ্চল, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকায় এবং আর্জেন্টিনাতেও এদের বিস্তৃতি রয়েছে।
এদের স্বভাব পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, এই কচ্ছপগুলো ডিম পাড়ার জন্য সৈকত এবং বসবাসের জন্য অগভীর উপকূলীয় অঞ্চল বেছে নেয়। এরা এদের বিচরণ ক্ষেত্র নির্বাচনের সময় সর্বদা সুগন্ধি সামুদ্রিক ঘাস আচ্ছাদিত অঞ্চল বেছে নেয়। কিন্তু অবুঝ প্রাণীরগুলো জানে না যে, মানব সৃষ্ট জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে তাদের অস্তিত্ব আজ সংকটের মুখে পড়েছে! সেদিন আর বেশি দূরে নয় যেদিন সবুজ কচ্ছপের জীবন্ত জীবাশ্ম খুঁজে বেড়াতে হবে প্রাণীবিজ্ঞানীদের।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবের ফলে সবুজ কচ্ছপগুলোর ৯৩ শতাংশই হবে স্ত্রী প্রজাতির। ফলে এই প্রাণীগুলোর পুরুষ প্রজাতির মারাত্মক অভাব দেখা দিবে। গত মাসে প্রকাশিত গ্লোবাল চেঞ্জ বায়োলজি নামক একটি জার্নালে এই রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়। এই তথ্যটি পাঠকদের শুধু অবাক করে দিতেই সক্ষম নয়, পাশাপাশি তাদের চিন্তায় একটি প্রশ্নেরও সাময়িক আবাসন গড়ে দিতে সক্ষম। আর প্রশ্নটি হলো, প্রাণীর লিঙ্গ নির্ধারণ যেখানে ক্রোমোজোমের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে আবহাওয়া পরিবর্তনের স্ত্রী ও পুরুষ কচ্ছপের সংখ্যার তারতম্যের কারণ কী?
কারণ, অন্যান্য সরীসৃপ এবং মৎস্য প্রজাতির প্রাণীদের লিঙ্গ নির্ধারণ ক্রোমজোম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও সামুদ্রিক কচ্ছপের ক্ষেত্রে তা একদমই প্রয়োজ্য নয়। কারণ কচ্ছপের ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারিত হয় মূলত ডিমের বহির্ভাগের তাপমাত্রার উপর ভিত্তি করে। উষ্ণতা পরিবেশে সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম থেকে নারী কচ্ছপ এবং শীতলতা পরিবেশে পুরুষ কচ্ছপের জন্ম হয়। বর্তমানে পৃথিবীতে বসবাসরত সামুদ্রিক কচ্ছপের ৫২ শতাংশ হলো নারী। এ থেকে বোঝা যায়, লৈঙ্গিক অনুপাতের দিক দিয়ে বর্তমানে সবুজ কচ্ছপে বেশ ভারসাম্য বিরাজ করছে।
কিন্তু এই ভারসাম্য কতদিন স্থিতিশীল থাকে সেটাই চিন্তার বিষয়। কেননা পৃথিবীর তাপমাত্রা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকলে এই ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রাই কচ্ছপ প্রজাতিকে নিকট ভবিষ্যতে অস্তিত্বের সংকটে ফেলবে। কারণ এভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকলে কচ্ছপের আবাসস্থলের পরিবেশ আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। আর এর ফলে সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম থেকে পুরুষ প্রজাতির কচ্ছপের তুলনায় স্ত্রী প্রজাতির কচ্ছপই বেশি জন্মাবে। স্ত্রী প্রজাতির কচ্ছপ বেশি জন্মানোর ফলে কচ্ছপের বংশবিস্তারও দ্রুত বাড়তে থাকবে। আর এর ফলে নারী কচ্ছপের সংখ্যা আরো বাড়তে থাকবে এবং পুরুষ প্রজাতির কচ্ছপের সংখ্যা ধীরে ধীরে শূন্যের কোটায় নামতে থাকবে।
সামুদ্রিক কচ্ছপের এমন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সম্প্রতি ভাবিয়ে তুলেছে বর্তমান বিশ্বের প্রাণী বিজ্ঞানীদের। ফলে কচ্ছপ সম্পর্কিত এই আশংকা কতটা যুক্তিযুক্ত সে বিষয়ে তারাও বিস্তর গবেষণা শুরু করছেন। তারই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রের এক্সটার ইউনিভার্সিটির এবং পর্তুগালের মেরিন অ্যান্ড সায়েন্স সেন্টারের বিজ্ঞানীগণ যৌথভাবে কচ্ছপের বড় চারণক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত আফ্রিকার গিনি বিসাউয়ে কচ্ছপের একটি বাসা থেকে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করে কাজে লেগে যান।
তারা এই সংগৃহীত তথ্যগুলোর উপর ভিত্তি করে কয়েকটি মডেল তৈরি করেছেন। তাদের এই মডেল থেকে প্রাপ্ত ধারণানুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার কারণে শতাব্দীর শেষের দিকে সামুদ্রিক কচ্ছপের মধ্যে স্ত্রী প্রজাতির সম্ভাব্য সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ৭০ থেকে নব্বই শতাংশে। সম্প্রতি জাতিসংঘের আইপিপিসি প্রতিবেদনে এটি প্রকাশ পায়। ইকোলোজি এন্ড কনজারভেশন সেন্টারের মেরিন ইকোলোজিস্ট ড. রিতা এ বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এবং বাসস্থান অসুবিধার কারণে সামুদ্রিক কচ্ছিপ তাদের দৈনন্দিন জীবনে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরো প্রকট আকার ধারণ করতে পারে।
তার ভাষ্যমতে, ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক তাপমাত্রা বিজগোস দ্বীপপুঞ্জ, গিনি-বিসাউ অঞ্চলে আগামী ২১০০ সালের মধ্যে যে একটি বিপর্যয় ডেকে আনছে এই আশঙ্কা মোটামুটি শতভাগ নিশ্চিত। এছাড়া ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার ফলে স্ত্রী প্রজাতির কচ্ছপের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এই অতিরিক্ত তাপমাত্রা ডিমের মৃত্যুহার বৃদ্ধির জন্যও দায়ী, যা কচ্ছপ প্রজাতিকে বিলুপ্তির পথে আরো একধাপ এগিয়ে নিতে সক্ষম।
তবে অপরাধীর কাঠগড়ায় শুধু তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে সামুদ্রিক কচ্ছপ বিলুপ্তির একমাত্র কারণ হিসেবে দাঁড় করানো হয়নি। এর পাশাপাশি আরো কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার কারণে একসময় মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করবে। ফলে বেড়ে যাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। আর এর ফলে তলিয়ে যাবে সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন কেন্দ্রের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, যা সামুদ্রিক কচ্ছপের বিলুপ্তির নেপথ্যে একটি শক্তিশালী প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে ।
তবে এই মূহুর্তে সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ হচ্ছে, ইতোমধেই বন্য সামুদ্রিক কচ্ছপের মধ্যে অত্যাধিক হারে নারী কচ্ছপ জন্মের প্রবণতা দেখা দিয়েছে। গত বছর একটি গবেষণায় দেখা যায়, গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের উত্তরাঞ্চলে শিশু কচ্ছপের ৯৯.১ শতাংশই নারী, যা দেখে বোঝা যায়, ২১০০ শতকে সামুদ্রিক কচ্ছপের ৯০ শতাংশ নারী হওয়ার আশঙ্কা যেন ঘাড়ের উপর গরম নিঃশ্বাস ফেলছে, যা সামুদ্রিক কচ্ছপের অস্তিত্বের জন্য অশনী সংকেত।
প্রাণীজগত সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো