আমাদের এই অপরূপ প্রকৃতিতে ছড়িয়ে আছে কত বৈচিত্র্য। কোথাও সবুজের সমারোহ, আবার কোথাও আদিগন্ত ধূসর। কোথাও চলে অবিরাম বৃষ্টির বর্ষণধ্বনি, আবার কোথাও বছরে একবার বৃষ্টির দেখা মিলে কিনা সন্দেহ। প্রকৃতি কোথাও সমতল, উর্বর, শ্যামল মায়াময়। আবার কোথাও সে রুক্ষ, শুষ্ক, মরুময়। কিন্তু এই মরুময়তার মাঝেও প্রকৃতি যেন অনন্য এক রূপ নিয়ে হাজির থাকে ভ্রমণপিয়াসী মানুষদের কাছে।
মরুভূমি বললেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে বিশাল এক বালির প্রান্তর। এই প্রকাণ্ডতাই মরুভূমির প্রধান অলঙ্কার। এর মাঝেও ছড়িয়ে রয়েছে প্রকৃতির নানা জীববৈচিত্র্য। পৃথিবীর সাতটি মহাদেশের সাত বৈচিত্রময় মরুভূমির প্রকৃতি ও তার সৌন্দর্যের খোঁজে আজকের আয়োজন।
১. বলিভিয়ার সালার দে ইয়ুনি (দক্ষিণ আমেরিকা)
১২,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়ায় অবস্থিত মরুভূমি সালার দে ইয়ুনি। বলিভিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের এই মরুভূমি পৃথিবীর দীর্ঘতম লবণাক্ত মরুভূমি। এখানে প্রায় ১০ বিলিয়ন টন লবণ সঞ্চিত আছে। প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার টন লবণ সংগ্রহ করা হয় এই মরুভূমি থেকে।
এই মরুভূমিটি অসম্ভব রকম সমতল আর স্থির। কখনো কখনো এখানে জলের চাদর পড়ে। আর তার উপর যখন সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়, তখন বালির স্তর হয়ে উঠে এক স্বচ্ছ আয়না। এটিই বোধ হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক আয়না। আর তাতে ফুটে ওঠে আকাশের ছবি। এই মরুভূমির আশেপাশে অনেক হ্রদও রয়েছে। এই অঞ্চলে জমে থাকা খনিজের জন্য বিভিন্ন হ্রদের জলের রংও আলাদা দেখায়।
এখানে ট্রেনের এক সমাধিক্ষেত্র রয়েছে, যা এই মরুভূমির আরেকটি প্রধান আকর্ষণ। এক সময় এই অঞ্চলটি ছিল খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। খনিজ আহরণের জন্য এই অঞ্চলে ট্রেন যোগাযোগের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যার মাধ্যমে মালামাল বহনসহ শ্রমিক আনা-নেওয়ার কাজ করা হতো। ১৯৪০ সাল পর্যন্ত এই ট্রেন যোগাযোগ চালু ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে খনির মধ্যকার আকরিক ফুরিয়ে যাওয়ায় ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
তবে এখনও বেশ কয়েকটি ট্রেন এই বিশাল মরুপ্রান্তরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রয়েছে, যেন কারো অপেক্ষায় রয়ে গিয়েছে। সময়ের সাথে সাথে সেসব ট্রেনে ধুলোর আস্তরণ পড়েছে। রোদে, জলে ভিজে ক্ষয়ে গেছে সেগুলো, ট্রেনের চাকা ঢুকে গিয়েছে মাটিতে। এখন শুধু কঙ্কাল হিসেবে এগুলো অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। বর্তমানে ‘ট্রেন সিমেট্রি’ হিসেবে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে স্থানটি পরিচয় পেয়েছে।
২. নামিব মরুভূমি (আফ্রিকা)
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন মরুভূমির নাম নামিব। নামিব শব্দের অর্থ খোলা জায়গা। ৮০,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত এই মরুভূমি। দক্ষিণ আফ্রিকা, অ্যাঙ্গোলা আর নামিবিয়া- এই তিনটি রাজ্যজুড়ে বিস্তৃত এটি। সাহারার মতো বড় না হলেও বেশ বৈচিত্র্যময় এই মরুভূমি। এখানকার বালিয়াড়িগুলো পৃথিবীতে বিরল। এই মরুভূমির কোনো কোনো বালিয়াড়ি ৩০ মিটার উঁচু, আবার কোথাও কোথাও ৩৯০ মিটার উঁচু।
নামিব মরুভূমির একটি বিশেষত্ব হচ্ছে, এখানে হাতির দেখা মেলে যা পৃথিবীর আর কোনো মরুভূমিতে নেই। মরুভূমির আশ্চর্য জীবজগৎ দেখে পর্যটকরাও তাজ্জব বনে যান। মরুভূমির উষর প্রান্তে অনেক রকম পশুপাখি আর গাছপালার দেখা মেলে। কৃষ্ণ ইমপালা, হাতি, জেব্রা, গন্ডার, সিংহসহ বিচিত্র সব নানা পশুপাখির অভয়ারণ্য এই মরুভূমি।
মরুভূমির গাছগুলোও বেশ বৈচিত্রময়। এখানকার সবচেয়ে পুরনো গাছ ওয়েলউইটসচিয়া মিরাবিলিস। প্রায় ছয় ফুট লম্বা, ২৪ ফুট চওড়া গাছটি ২০০০ বছরের পুরনো। এই গাছের কাণ্ডে দুটি পাতা থাকে। জুরাসিক যুগ থেকে গাছটি নাকি এক রকমই আছে। কুইভার নামের আরেকটি অদ্ভুত গাছের দেখা পাওয়া যায় এখানে। নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রচণ্ড খরার সময় নিজের শরীরের আর্দ্রতা যাতে বেরিয়ে না যায়, তার জন্য সে নিজের ডালপালা ঝড়িয়ে ফেলে।
এই মরুভূমির আরেক উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ হলো হীরা। এই মরুভূমিতে নাকি হীরা পাওয়া যায়। আর তার জন্য দেশ-বিদেশের অনেকে ছুটে আসে হীরার খোঁজে। আর সেসব হীরা প্রধান জায়গাগুলোতে রাখা হয়েছে জোরদার সুরক্ষা ব্যবস্থা, চারদিকে সিসিটিভি ক্যামেরা। সাধারণদের প্রবেশাধিকার নেই এই অঞ্চলগুলোতে। এই অঞ্চলগুলোর মাঝখানে নামিব-নকলাফ্ট নামে একটি জাতীয় উদ্যান আছে। আর এসব কারণে নামিব মরুভূমি বেশ সংরক্ষিত।
৩. অ্যান্টার্কটিকা মরুভূমি (অ্যান্টার্কটিকা)
পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুতে অবস্থিত অ্যান্টার্কটিকার মরুভূমির আয়তন ৫৪ লক্ষ বর্গ মাইল। এই মরুভূমির ৯৮ শতাংশ বরফে ঢাকা। এখানে বছরে দুই ইঞ্চিরও কম বৃষ্টি হয়। মরুভূমির উপকূল অঞ্চলে বছরে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২০ সেন্টিমিটার। মরুভূমির ভিতরের অংশে এই পরিমাণ আরও কম। সে কারণে এই মরুভূমি ভয়ানক ঠাণ্ডা। সবচেয়ে গরমের সময়ে এই অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা থাকে ১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডেরও নিচে।
এই অঞ্চলের কোথাও কোথাও কখনো মাইনাস ১২৯ ডিগ্রিতে তাপমাত্রাও নেমে আসে। তারপরও একে মরুভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তার কারণ, বছরে গড়ে ২৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটারের কম বৃষ্টি হলেই সেই অঞ্চলকে মরুভূমি বলে চিহ্নিত করা হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে সিক্ত এবং সেই সাথে শুষ্ক এই অঞ্চল। পৃথিবীর এক বিশেষ ধরনের মরু হচ্ছে মেরুদেশীয় এই মরুভূমি।
আবার এই অঞ্চলের কোনো কোনো অংশের শুকনো উপত্যকাগুলোয় কোনো বরফের আচ্ছাদন নেই। সেখানে নেই আর্দ্রতার কোনো ছিটেফোঁটাও। অন্যদিকে ঘণ্টায় ২০০ মাইল বেগে মাঝেমধ্যে ঝড়ো হাওয়াও বয়ে যায় এই মরুভূমিতে।
এসবের জন্য এই মরুভূমির আবহাওয়া অনেক শুকনো। তাই বিজ্ঞানীরা একে মরুভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তবে এই মরুভূমির অত্যন্ত কঠোর প্রতিকূল পরিবেশও প্রাণহীন নয়। গাছপালা, মানুষ না থাকলেও পেঙ্গুইন, সিল ও অন্য কিছু জীব আছে এখানে।
৪. থর মরুভূমি (এশিয়া)
ভারত-পাকিস্তানের সীমান্ত জুড়ে বিস্তৃত থর মরুভূমি। আয়তনের দিক দিয়ে এটি বিশ্বে ১৮তম উপমহাদেশীয় মরুদেশ। ভারতের রাজস্থান, হরিয়ানা, পাঞ্জাবের দক্ষিণাঞ্চল, গুজরাটের উত্তরাংশ এবং পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের পূর্বাংশ ও পাঞ্জাবের দক্ষিণ-পূর্ব অংশ জুড়ে বিস্তৃত এটি।
প্রায় ৭৭,০০০ বর্গ মাইল এলাকায় প্রসারিত থর জনঘনত্বের দিক দিয়ে এক নম্বর। এখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৮৩ জন লোক বাস করে, যেখানে সাহারা মরুভূমিতে বাস করে মাত্র ১ জন। এই অঞ্চলজুড়ে প্রায় ১৬ কেটি মানুষের বসবাস। আর তাই থরকে গ্রেট ইন্ডিয়ান ডেজার্ট নামে অভিহিত করা হয়।
ছয় মিলিয়ন বছরের পুরনো ডাইনোসরের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে এই মরুভূমিতে। রুক্ষ মরুভূমিতে রঙের অভাব পুষিয়ে দেয় এখানকার মানুষেরা। তাদের বাহারি পাগড়ি, বিচিত্র পোশাক, নারীদের রঙচঙে ঘাঘরা, বাহারী গয়নায় যেন এই মরুভূমিতে চলে রঙের উৎসব।
৫. চিহুহুয়ান মরুভূমি (উত্তর আমেরিকা)
উত্তর আমেরিকা মহাদেশের বৃহত্তম মরুভূমি হলো চিহুহুয়ান মরুভূমি। ৩ লক্ষ ৯০ হাজার বর্গ মাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই মরুভূমির ৩০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চল এবং ৭০ শতাংশ মেক্সিকোর উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত।
চিহুহুয়ান মরুভূমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস, অ্যারিজোনা ও নিউ মেক্সিকো এবং মেক্সিকোর চিহুহুয়া, দুরঙ্গো, কোওহুলা, জ্যাকটেকাস ও নুয়েভো লিওন রাজ্যগুলোর মধ্যে পড়েছে। উত্তর আমেরিকা মহাদেশের প্রায় ১.৫ শতাংশ এলাকা এই মরুভূমির অন্তর্গত।
এই মরুভূমির উপকণ্ঠে বেশ কয়েকটি পর্বতশৃঙ্গ থাকায় এই মরুভূমিতে বৃষ্টিপাতের হার তুলনামূলকভাবে বেশি। আর এ কারণে একে ‘বৃষ্টি ছায়া মরুভূমি’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। বিভিন্ন প্রকারের জীববৈচিত্রের জন্য এই মরুভূমি বেশ প্রসিদ্ধ। এখানে তিনশরও বেশি ক্যাকটাস প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া যায়।
৬. ইউক্রেনের ওলেশকি স্যান্ডস (ইউরোপ)
ইউরোপে সেই অর্থে মরুভূমির দেখা মেলে না, কারণ তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভর করে মরুভূমির যোগ্যতা নির্ধারিত হয়। আর এজন্য ইউরোপে যেসব মরুভূমির কথা জানা যায় সেগুলোকে সেমি ডেজার্ট বা মধ্যম সারির মরুভূমি হিসেবে অভিহিত করা হয়। তেমনই এক মরুভূমি ওলেশকি। উর্বর কৃষি জমির জন্য ইউক্রেনের সুনাম বিশ্বব্যাপী। তাই অনেকের কাছে এখানে মরুভূমি থাকা অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। তবে এই ইউক্রেনেই রয়েছে ইউরোপের সবচেয়ে বড় মরুভূমি ওলেশকি।
১০ মাইল জুড়ে বিস্তৃত এই মরুভূমি। এখানকার তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের কারণে ভূ প্রকৃতিবিদগণ এই মরুভূমিকে মধ্যম সারির মরুভূমি হিসেবেই চিহ্নিত করেন। ১৯ শতকে এটি কাহরসন অঞ্চলের অধীনে ছিল। তখন মেষপালকরা তাদের পশুদের মূলত মরুভূমিতে জন্মানো প্রাকৃতিক ঘাস খাওয়ানোর জন্য এই অঞ্চলে বসবাস করতে থাকে।
তবে ২০ শতকের দিকে ইউক্রেন সরকার আরো বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে মরুময়তা যাতে বৃদ্ধি না পায়, তার লক্ষ্যে মরুভূমির চারপাশে এক লক্ষ হেক্টর এলাকা জুড়ে ব্যাপকহারে গাছ লাগানোর কর্মসূচী হাতে নেয়। মরুভূমির বুকে এক খণ্ড সবুজ দেখার জন্য পর্যটকদের তাই কমতি নেই। তবে এই মরুভূমির বেশ কিছু জায়গায় ল্যান্ড মাইন পোতা থাকায় সেখানে পর্যটকদের প্রবেশাধিকার নেই।
৭. সিম্পসন মরুভূমি (অস্ট্রেলিয়া)
মরুর রং লাল হতে পারে, তা কি ভাবা যায়? অস্ট্রেলিয়ার উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্যের কুইন্সল্যান্ড জুড়ে বিস্তৃত এই সিম্পসন মরুভূমি। এটি অস্ট্রেলিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম মরুভূমি। ২ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই মরুভূমি।
এই মরুভূমির এক আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর রং লাল। আর এই লাল রঙের জন্য একে ডাকা হয় ‘দ্য বিগ রেড নামে’। এই মরুভূমির বালির রংটাই লাল। এখানেই অবস্থিত কুইন্সল্যান্ড মুঙ্গো থিরি ন্যাশনাল পার্ক, যেটি অনেকে কাছে পরিচিত সিম্পসন ডেজার্ট ন্যাশনাল পার্ক হিসেবেও। এখানে ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সমান্তরাল বালিয়ারির সারি দেখতে পাওয়া যায়।
পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ বালিয়াড়ি দেখা যায় এই মরুভূমিতে। পশ্চিম থেকে পূর্বে বালিয়াড়িগুলো ৩-২০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে, যা ২০০ কিলোামটার পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে। এখানকার সবচেয়ে দীর্ঘাকার সমান্তরাল বালিয়াড়ি ন্যাপানারিকা, যার উচ্চতা ৪০ মিটার।
ফিচার ইমেজ: Reddit