আফ্রিকা মহাদেশে অবস্থিত পৃথিবীর বৃহত্তম মরুভূমি সাহারা। সেই মরুভূমির পঁয়তাল্লিশ শতাংশ অঞ্চল জুড়ে রয়েছে আফ্রিকার উত্তরের একটি দেশ তিউনিসিয়া। সাহারা মরুভূমির শুষ্ক আবহাওয়ার প্রকোপ রয়েছে দেশটির অধিকাংশ স্থান জুড়ে। তিউনিসিয়ার একটি খুব পরিচিত শহর গাফসা। উত্তর আফ্রিকার রাসায়নিক রপ্তানিকারক হিসেবে দেশটির বেশ খ্যাতি রয়েছে। এই শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে মরুভূমির ধূসর প্রান্তরে ঘটে গেছে এক আশ্চর্যজনক ঘটনা। কেউ বলে অলৌকিক, কেউ বলে অতিপ্রাকৃতিক, কারও মতে ভূগোলের রকমফের। যে যা-ই বলুক না কেন, এর উৎপত্তি কিন্তু আজও অজানা।
মরুভূমির মাঝেই গড়ে উঠেছে কিছু বিচ্ছিন্ন গ্রাম। গ্রীষ্মের দিনে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার ওপরে গরম অনুভূত হয় সেসব এলাকায়। গরমে আর বিশুদ্ধ পানির হাহাকারে খুব কষ্টে এখানকার মানুষের দিন কাটে। তাপের ভয়াবহতায় এক ফোঁটা পানিও যেন এনে দেয় অনেক প্রশান্তি।
গ্রামে তেমন চাষবাস নেই বললেই চলে। ঘরে ঘরে হয় মেষ বা ভেড়ার চাষ। ২০১৪ সালের জুলাই মাসের দিককার ঘটনা, একদিন দুপুরবেলা কয়েকজন মেষপালক বের হয় কিছু মেষ শাবক নিয়ে। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু দলের একজন হঠাৎ চিৎকার করে ওঠাতে সকলের ভাবোদয় ঘটল। কী ব্যাপার দেখতে গিয়ে বাকি ক’জনেরও চক্ষু চড়কগাছ। এ কী দেখছে! নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না তারা। ঠিক আগের দিনও একই সময় তারা এই স্থানে অনেকটা সময় পার করে গেছে। এমন কিছু তো চোখে পড়েনি! অনেক বছর ধরে তারা এই অঞ্চলে বসবাস করছে। এমন কিছুতো কখনো ছিল না এখানে। তারা সকলেই অবাক হয়ে নিজেদের মাঝে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। কারণ ধূসর মরুভূমির এক নির্দিষ্ট প্রান্তর জুড়ে রাতারাতি গজিয়ে গেছে পানিতে পরিপূ্র্ণ একটি লেক! যে লেকের অস্তিত্ব তারা আগের দিন পর্যন্ত জানতো না। যে জায়গায় তারা লেক দেখছে সেখানে ছিল উঁচু উঁচু পাহাড়ের বেষ্টনী। এমন অবাক কাণ্ড দেখে কার না চোখ কপালে ওঠে।
খুব অল্প সময়ের মধ্যে চারিদিকে খবর পৌঁছে গেল। পানির নাম শুনেই যেন সকলেই তড়িঘড়ি করে ছুটে দেখতে আসে সেই লেকটি। আর আসবেই না বা কেন? এমন অলৌকিক ঘটনা নিজের চোখে না দেখে তো আর বিশ্বাস করা যায় না। সকলের চোখেই বিস্ময়ের অভিব্যক্তি। গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও সকলে উপস্থিত। সকলের খুব পরিচিত এই জায়গা। রাতারাতি গজিয়ে ওঠা এই লেককে অনেকে ভৌতিক কর্মকাণ্ড ভেবে দূরে সরে যায়। আবার কারো মতে এ তো সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ। এমন ধূসর মরুভূমিতে গ্রামের লোকের কষ্টের কথা ভেবেই না এই লেকের সৃষ্টি। অনেকেই তাই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে মনের আনন্দে ঝাপিয়ে পড়তে থাকে থৈ থৈ পানির মধ্যে। মনের সব সন্দেহ দূরে ঠেলে দিয়ে যেন অপার আনন্দে ভেসে যেতে থাকে চারিদিক। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।
লেকের চারপাশ ঘিরে রয়েছে অসংখ্য পাথরের পাহাড়। অনেকেই তাই লেকের গভীরতা আন্দাজ করে পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে দিচ্ছে স্কুবা ডাইভ। গ্রামবাসীরা যেন হঠাৎ ঈদের চাঁদ হাতে পাওয়ার আনন্দে মেতে উঠে। হাজারও মুখে তখন আনন্দের প্রতিধ্বনি। পরবর্তীতে এটি ‘লেক ডি গাফসা’ অথবা ‘গাফসা বিচ’ নামে পরিচিতি পায়।
খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকে দ্রুত বেগে। বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে লোক আসে এবং স্থানীয়দের সাক্ষাৎকার নেয়। তেমনি এক কর্মরত তিউনিসিয়ান সাংবাদিক লাখদার সৌদ ফ্রান্স ২৪ টেলিভিশনকে জানান, স্থানীয়দের অনেকেই একে অলৌকিক বলে থাকলেও কেউ কেউ একে অভিশাপ রূপেই দেখছে। প্রথম কিছুদিন পানি পরিষ্কার থাকলেও ধীরে ধীরে এতে শ্যাওলা জন্মে পানি ময়লা হয়ে যাচ্ছে, যা আপাতদৃষ্টিতে অপরিবর্তনীয়। এর ফলে কিছুটা ভয়েরও সৃষ্টি হয়েছে।
মেহদী বিলাল নামে স্থানীয় আরেকজনের সাক্ষাৎকারে জানা যায় যে, বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে তিনি বাড়ি ফিরে আসছিলেন। অনেকটা সময় বিরতিহীন হাঁটার ফলে মরুভূমির বুকে বিশাল লেক দেখে তার মনে হয়েছিল, তিনি বুঝি মরীচিকা দেখছেন। প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাননি তিনি, কেননা বিয়েতে যাওয়ার দিনও তিনি একই রাস্তা দিয়ে গেছেন। তখন এমন কিছু তার চোখে পড়েনি। তার ধারণা, এটি বিজ্ঞানের বাইরে অলৌকিক কিছু।
খবর শুনে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সরেজমিনে তদন্তে আসে। ঘটনাস্থলের চারপাশ পরীক্ষা নিরীক্ষা করেও তেমন কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে না তারা। তবে তারা সন্দেহ পোষণ করে যে, এই পানিতে কোনো তেজস্ক্রিয়তা থাকতে পারে, যা ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। তাই স্থানীয়দের সেই পানিতে গোসল না করার জন্য বার বার সতর্ক করে দেওয়া হয়।
স্থানীয়দের মতে, প্রায় আঠারো মিটার গভীর এবং এক হেক্টর বিস্তৃত এলাকা জুড়ে এই লেকের অবস্থান। স্থানীয় ভূতত্ত্ববিদদের মতে, ভূকম্পনের ফলে পাহাড়ের পাথর সরে গিয়ে এমন পানির প্রবাহ সৃষ্টি করতে পারে। আবার অনেকের মতে, গভীর খাদে বৃষ্টির পানি জমেও এই হ্রদের সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু কারো মতবাদের পক্ষে জোরালো কোনো প্রমাণ নেই। সবই অনুমান নির্ভর যুক্তি।
১৮৮৬ সালে তিউনিসিয়ার দক্ষিণাংশে ফসফেট (ফসফরাসজনিত অম্লীয় লবণ বিশেষ) আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে গাফসা দেশটির খনিজ ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। তিউনিসিয়া বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম ফসফেট রপ্তানিকারী দেশ। স্থানীয় এক পত্রিকা এই তথ্যের সূত্র ধরে উল্লেখ করে যে, স্থানীয় এই অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য ফসফেটের খনি। বিষাক্ত রাসায়নিকের সংস্পর্শে বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারে লেকের পানি। তাই এই পানি মোটেই নিরাপদ নয়।
প্রথম কিছুদিন পানি বেশ পরিষ্কার থাকলেও খুব দ্রুত তাতে শ্যাওলা জন্মে পানির রং ধূসর সবুজ বর্ণের করে ফেলে। তাই এই পানির বিশুদ্ধতা নিয়ে আবার প্রশ্ন জাগে। লেক উদঘাটিত হওয়ার দু’সপ্তাহ পরে গাফসার ‘অফিসিয়াল ফর পাবলিক সেফটি’ জনগণকে লেকের পানিতে গোসল না করার জন্য সতর্ক করে দেয়। তাদের মতে, এই লেকে গোসল করা বেশ বিপদজনক। কিন্তু খুব কম সংখ্যক লোকই এই সতর্কতার কথা কানে তোলে। অসংখ্য মানুষ আজও এই লেকে আসে এবং গোসল করে। দেশ-বিদেশের হাজারো মানুষ ভিড় করে প্রকৃতির এই অপার বিস্ময় দেখার জন্য, যার উৎসের কিনারা আজও সকলের অজানা। এখনও পর্যন্ত এই লেকের পানি প্রসঙ্গে তেমন কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি। এমনই এক অতিপ্রাকৃতিক ঘটনার অবতারণা করতে গিয়েই হয়তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে’ কবিতায় উচ্চারণ করেছিলেন,
মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে
আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে॥
তুমি আছ, বিশ্বনাথ, অসীম রহস্যমাঝে
নীরবে একাকী আপন মহিমানিলয়ে॥