পিসিওএস, বর্তমানে নারীদের শারীরিক সমস্যার মাঝে অন্যতম। পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমকে সংক্ষেপে পিসিওএস বলা হয়। প্রজনন ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতি ১০ জন নারীতে ১ জন নারী এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এর কারণে নারীদের বন্ধ্যাত্বের হার ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ২০-৩০ বছরের মধ্যবর্তী বয়সী নারীরা পিসিওএসের সমস্যায় ভোগেন। বয়ঃসন্ধিকালের পরে বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে যেকোনো বয়সেই পিসিওএস দেখা দিতে পারে, তবে যারা স্থূলদেহের অধিকারী বা পরিবারে মা-বোনের পিসিওএসের সমস্যা আছে বা ছিল, তাদের ক্ষেত্রে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
পিসিওএস-এর বিস্তারিত নিয়েই আজকের এই লেখাটি সাজানো হয়েছে।
পিসিওএস কি?
পিসিওএস নারীদেহে হরমোনজনিত একটি শারীরিক জটিলতা। পিসিওএসের ফলে এন্ড্রোজেন নামক হরমোন, যা সাধারণত পুরুষদের শরীরে অধিক মাত্রায় বিদ্যমান (স্বাভাবিকক্ষেত্রে যা নারীদের শরীরে খুবই সামান্য পরিমাণে উপস্থিত থাকে) থাকে, তা নারীদেহে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষরিত হতে থাকে। নারীদের অনিয়মিত মাসিক বা অতিরিক্ত রক্তস্রাব হতে থাকে। ডিম্বাশয়ে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফলিকলের সৃষ্টি হয় এবং নিয়মিত ডিম্বাণু তৈরি প্রক্রিয়া ব্যহত হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে সিস্ট তৈরি হয়, আবার অনেকক্ষেত্রে দেখা গেছে পিসিওএস থাকা সত্ত্বেও সিস্ট তৈরি হয়নি।
পিসিওএসের লক্ষণসমূহ
অনিয়মিত মাসিক
যেসকল নারী পিসিওএসে আক্রান্ত, তাদের অনিয়মিত মাসিক হয়ে থাকে (বছরে ৮ বারেরও কম), ঘন ঘন মাসিক হতে থাকে (২১ দিন বা তারও কম সময়ের ব্যবধানে), মাসিক হওয়া একদম বন্ধ হয়ে যেতে পারে, আবার কারো ক্ষেত্রে মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তস্রাব হতে পারে।
অনাকাঙ্ক্ষিত লোম
সুস্থ নারীদের দেহে যেসব জায়গায় লোম গজায় না, যেমন- মুখমণ্ডল, চিবুক, গলা, বুক, পিঠ বা অন্যান্য জায়গায়, সেখানে পুরুষদের ন্যায় অতিরিক্ত লোম গজিয়ে থাকে। এই অবস্থাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ‘হিরস্যুটিজম’ বলা হয়ে থাকে। পিসিওএসে আক্রান্ত শতকরা সত্তর ভাগ নারীর ক্ষেত্রে এমনটা হয়ে থাকে।
ব্রণ
মুখমণ্ডল, বুক, বা নিতম্বের উপরিভাগের দিকে প্রচুর ব্রণ হয়ে থাকে।
মাথার চুল পাতলা হয়ে যাওয়া
পুরুষদের মাথায় যেভাবে টাক পড়ে পিসিওএস আক্রান্ত নারীদের ক্ষেত্রেও অনেক সময় এ ধরনের লক্ষণ দেখা যায়।
স্থূলতা
কোনো কারণ ছাড়াই অতিরিক্ত ওজন বেড়ে যায় বা ওজন কমানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়া।
গর্ভধারণে জটিলতা
নিয়মমাফিক চেষ্টার পরও গর্ভধারণ করতে পারে না।
কালচে ত্বক
কাঁধের চারপাশে, স্তনের নীচে বা কুচকির চামড়া কালো হয়ে যায়।
ডিম্বাশয়ের আকার পরিবর্তন
ডিম্বাশয় আকারে বড় হয়ে যায়।
পিসিওএস হওয়ার কারণসমূহ
পিসিওএসের সঠিক কারণ আজও চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাছে অজানাই থেকে গেছে। তবে নিম্নলিখিত কারণসমূহ পিসিওএসের জন্য দায়ী বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।
এন্ড্রোজেন হরমোনের আধিক্য
এন্ড্রোজেন হরমোন মূলত পুরুষদেহে উপস্থিত থাকে (সুস্থ নারীদেহে খুবই সামান্য পরিমাণে থাকে), এবং এই হরমোনের কারণে পুরুষালী অনেক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়ে থাকে। নারীদেহে কোনো কারণবশত এন্ড্রোজেন হরমোন নিঃসরণের আধিক্য দেখা দিলে মাসিক চলাকালে ডিম্বাশয়ে ডিম্বাণু তৈরির প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
অতিমাত্রায় ইনসুলিনের উপস্থিতি
আমরা যে খাবারগুলো খেয়ে থাকি সেগুলো থেকে শক্তি উৎপাদনের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ইনসুলিন হরমোন। অনেক নারীর শরীর প্রকৃতিগতভাবেই ইনসুলিনের প্রতি একধরনের রেজিস্ট্যান্স তৈরি করে রাখে। ফলে ইনসুলিনের এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা বেড়ে যায়। বিশেষত স্থূলকায়, স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাসে অনভ্যস্ত, পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমে অনাগ্রহী এবং পরিবারে কারো ডায়াবেটিস ছিল বা আছে এমন নারীদেহে এই ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স থাকার সম্ভাবনা বেশি।
পিসিওএসের ফলে সৃষ্ট শারীরিক জটিলতা
পিসিওএসের ফলে নানাবিধ শারীরিক জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে:
- বন্ধাত্ব্য।
- মিসক্যারেজ বা প্রিম্যাচিউর নবজাতকের জন্ম হতে পারে।
- স্লিপ এপনিয়া (ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়) হতে পারে।
- পরবর্তীতে গর্ভধারণের সময়ে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে।
- অতিরিক্ত চর্বি জমা হয়ে যকৃত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
- দেহে এলডিএলের (ব্যাড কোলেস্টেরল) মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং এইচডিএলের (গুড কোলেস্টেরল) মাত্রা কমিয়ে দেয়।
- টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- সমবয়সী একজন সুস্থ নারীর তুলনায় পিসিওএস আক্রান্ত নারীর উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি অধিক থাকে। এই উচ্চ রক্তচাপ বিভিন্ন হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের অন্যতম কারণ।
- হতাশা এবং উদ্বিগ্নতা।
- কোনো কারণ ব্যতিরেকে প্রস্রাবে রক্তের উপস্থিতি।
- এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
পিসিওএসে আক্রান্ত একজন নারী কি গর্ভধারণ করতে পারে?
পিসিওএসে আক্রান্ত মানেই কিন্তু এই নয় যে সেই নারী কখনো গর্ভধারণ করতে পারবে না। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে অনেক নারী পরবর্তীতে গর্ভধারণে সক্ষম হয়ে থাকে। পিসিওএস আক্রান্ত একজন নারীর দেহে হরমোনের অসামঞ্জস্যতার কারণে ডিম্বাণুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং ওভুলেশনের সময় ডিম্বাণুটি স্বাভাবিক নিয়মে নিঃসৃত হতে পারে না। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছ থেকে পরামর্শ এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ অনিবার্য।
মেনোপজের পরে কি পিসিওএসের লক্ষণসমূহ দূর হয়ে যায়?
অনেকের ক্ষেত্রে ‘হ্যাঁ’, আবার অনেকের ক্ষেত্রে ‘না’। পিসিওএসের ফলে শরীরে অনেক পরিবর্তন ঘটে এবং নানা ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হয়। অনেক নারীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে মেনোপজের আগে তাদের মাসিক স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আবার অনেকের ক্ষেত্রে লক্ষণসমূহ আগের মতোই রয়ে গেছে, কারণ পিসিওএসের ফলে দেহে সৃষ্ট হরমোনের যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয় তা বয়স বাড়ার সাথে সাথে একই রকমই থেকে যায়।
কীভাবে পিসিওএস নির্ণয় করা হয়?
পিসিওএস নির্ণয়ের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। তবে চিকিৎসকরা লক্ষণসমূহ পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি নিম্নলিখিত পরীক্ষাগুলো করানোর ব্যাপারে পরামর্শ প্রদান করেন।
শ্রোণিদেশের পরীক্ষা
প্রজননতন্ত্রের অঙ্গাণুসমূহ পরীক্ষা করে থাকেন; সেখানে কোনো ধরনের মাংসপিণ্ড বা অস্বাভাবিকতার উপস্থিতি রয়েছে কিনা।
রক্ত পরীক্ষা
হরমোনের মাত্রা চেক করার জন্য রক্ত পরীক্ষা করানো হয়ে থাকে— এন্ড্রোজেন, ইনসুলিন, কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা।
আল্ট্রাসাউন্ড
আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে ডিম্বাশয়ের আকার-আকৃতি এবং জরায়ুর আবরণী প্রাচীরের পুরুত্ব দেখা হয়। দণ্ডের ন্যায় একটি ডিভাইস যোনীপথে প্রবেশ করিয়ে এই পরীক্ষাটি করা হয়ে থাকে।
পিসিওএসের চিকিৎসা
পিসিওএসের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। সাধারণত এর চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী হয়ে থাকে। ব্যক্তিভেদে লক্ষণসমূহ এবং বিভিন্ন মেডিক্যাল টেস্টের প্রাপ্ত ফলাফলের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা প্রদান করা হয়ে থাকে। চিকিৎসাপদ্ধতি দু’রকম হতে পারে:
জীবনধারণের পদ্ধতিতে পরিবর্তন
ওজন কমানো এবং পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম।
ঔষধ
নিয়মিত মাসিকের জন্য চিকিৎসক আপনাকে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন সম্বলিত জন্ম নিরোধক বড়ি সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন। এর ফলে এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস পাবে, অতিরিক্ত রক্তস্রাব কমে আসবে এবং অবাঞ্ছিত লোম ও ব্রণ কমাতেও সহায়তা করবে। ডিম্বাণু তৈরির প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখতে আপনার চিকিৎসক ক্লোমিফেন, মেটফরমিন, লেট্রোজোল, গোনাডোট্রপিন এই ঔষধগুলো প্রদান করে থাকতে পারেন।
শরীরের অবাঞ্ছিত লোম দূরীকরণে বার্থ কন্ট্রোল পিল, স্পাইরোনোল্যাকটোন বা ইলেকট্রোলাইসিস সেবনের পরামর্শ প্রদান করতে পারেন।
সচেতনতা আপনাকে সম্ভাব্য সমস্যা থেকে সহজেই মুক্তি দিতে পারে। তবে সমস্যা সমাধানে অবশ্যই উপযুক্ত চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।