পাঁচ বছর বয়সী মাশফিক (ছদ্মনাম) এর সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ থেকে কেউ আন্দাজ করতে পারবে না, কোনো এক ভয়ংকর অসুখ বাসা বেঁধেছে ওর শরীরে। সমবয়সী আর পাঁচটা-দশটা বাচ্চা এই বয়সেই হাঁটতে-চলতে আর কথা বলতে শিখে গেলেও মাশফিকের এ কাজগুলো করতে বেজায় সমস্যা।
ফ্যাকাশে চেহারার ছেলেটির চোখগুলো বসে গেছে অক্ষিকোটরে। চ্যাপ্টা গড়নের মাথা আর লিকলিকে হাত-পা দেখলে যে কেউই তালপাতার সেপাই ভেবে ভুল করে বসবে প্রথমে। তবে শীর্ণকায় ছেলেটি যখন একবার রেগে যায়, তখন তাকে শান্ত করতে প্রাণ বেরিয়ে পড়ার দশা হয় সকলের।
সন্তানের এই অসামঞ্জস্যপূর্ণ দৈহিক গড়ন ও আচরণ যখন আশেপাশের মানুষের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যেতে শুরু করলো, তখন তার বাবা-মা ধর্ণা দিলেন এক শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তিনি জানালেন, মাশফিক এক বিরল ব্যধিতে ভুগছে, যার নাম অ্যাঞ্জেলম্যান সিনড্রোম।
অ্যাঞ্জেলম্যান সিনড্রোম কী?
অ্যাঞ্জেলম্যান সিনড্রোম একটি বিরল জেনেটিক ডিসঅর্ডার, যা আমাদের দেহের নার্ভাস সিস্টেমের ওপর কাজ করে। সেদিক থেকে একে স্নায়বিক রোগও বলা যেতে পারে। ড. হ্যারি অ্যাঞ্জেলম্যান সর্বপ্রথম ১৯৬৫ সালে রোগীর দেহে এ রোগের উপস্থিতি শনাক্ত করেন। তার নামানুসারেই রোগটির নামকরণ করা হয়েছে।
একটি হাসিখুশি চেহারা অনেকের কাছে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার নির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হলেও অ্যাঞ্জেলম্যান সিনড্রোমের রোগীদের বেলায় হিসেবটা একটু আলাদা। এ রোগটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো অন্যান্য যন্ত্রণাদায়ক উপসর্গের উপস্থিতি সত্ত্বেও রোগীর চেহারা এমন ভঙ্গিমা ধারণ করে, যা দেখলে মনে হয় তিনি হেসেই চলেছেন।
পাশাপাশি নিজের শরীরের পেশিগুলোকে অস্বাভাবিকভাবে নড়াচাড়া করাবার কারণে যে কেউই প্রথম দেখায় রোগীকে জীবন্ত পাপেট হিসেবে ভুল করে বসতে পারেন। এ কারণেই অ্যাঞ্জেলম্যান কর্তৃক আবিষ্কারের আগে এর নাম দেয়া হয়েছিলো হ্যাপি পাপেট সিনড্রোম।
প্রকটতা
প্রতি পনেরো হাজারজনে একজন এই বিচিত্র রোগে আক্রান্ত হন। নারী ও পুরুষ উভয়েই সমানভাবে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। রোগটি খুব বিরল এবং এর উপসর্গগুলো খুবই বিচিত্র হওয়ায় অনেকসময় রোগটি সঠিকভাবে শনাক্ত করা চিকিৎসকদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না।
কারণ
অ্যাঞ্জেলম্যান সিনড্রোম একটি জেনেটিক ডিসঅর্ডার। মূূলত একটি জিনের অস্বাভাবিক পরিবর্তনই এই রোগের মূল কারণ। জিনটি হলো UBE3A, যা ক্রোমোসোম-১৫ তে অবস্থিত।
সাধারণত একটি সুস্থ শিশু তার বাবা ও মায়ের কাছ থেকে এই জিনটির একটি করে কপি পেয়ে থাকে, যা বিভিন্ন পেশির সঞ্চালনে ভূমিকা রাখে। মা থেকে আগত UBE3A জিনের কপিটি মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে সক্রিয়তা প্রদর্শন করে।
কোনো কারণে এই জিনটির কোনো অংশ মিসিং হলে, কিংবা জিনে মিউটেশন ঘটলে দেহের নার্ভাস সিস্টেম প্রয়োজনীয় UBE3A প্রোটিন থেকে বঞ্চিত হয়। তখন দেহে অ্যাঞ্জেলম্যান সিনড্রোমের উপসর্গ দেখা যায়। এছাড়াও কোনো কারণে যদি UBE3A জিনের দুটি কপিই বাবার কাছ থেকে চলে অাসে, তখন এই রোগটি দেখা দিতে পারে।
লক্ষণ
এ সিনড্রোমে আক্রান্ত প্রতি দশজনের সাতজনই আগ্রাসী মনোভাব দেখিয়ে থাকে। এসব আগ্রাসী আচরণের ভেতরে পড়ে, অন্যের চুল ধরে টানা, কামড় দেয়া, লাথি ঘুষি মারা ইত্যাদি। এছাড়াও অপরকে আঘাত দেবার পাশাপাশি রোগী নিজের দেহের প্রতি অসহিষ্ণু মনোভাব দেখিয়ে থাকে। নিজের চুল ধরে টানা, দেয়ালে মাথা ঠোকা, জিহ্বা কামড়ে ধরা এগুলোর ভেতরে অন্যতম।
অতিমাত্রায় চঞ্চল হয়ে ওঠার কারণে এ রোগীদের মধ্যে মনোযোগের অভাবও লক্ষ্য করা যায়। কোনো কাজে একাগ্রতার অভাব দেখানো এবং নির্দেশনাবলীর অপেক্ষা না করেই কাজ শুরু করে দেয়া অমনোযোগীতার সংকেত বহন করে।
অবাক করা ব্যাপার হলো, এই সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুরা অন্যসব স্বাভাবিক শিশুর মতোই আপাত সুস্থ শরীরে জন্মগ্রহণ করে। তবে জন্মের দুই থেকে তিন বছরের মাথায় এদের শরীরে কিছু শারীরিক অসামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হতে শুরু করে। এগুলো হলো:
- উঁচু চিবুক, গভীর অক্ষিকোটর, চওড়া মুখমন্ডল (ম্যাক্রোস্টোমিয়া) বিশিষ্ট চেহারার অধিকারী হওয়া।
- কথা বলা, খাওয়া কিংবা চিবানোর সময় জিহবা বেরিয়ে আসা।
- দাঁতের মাঝখানে বড় বড় ফাঁকের সৃষ্টি হওয়া।
- মাথার পৃষ্ঠভাগ সমতল হয়ে পড়া। (Brachycephaly)
- আঙ্গুলের মাথা সরু হয়ে যাওয়া।
- মেরুদণ্ড বেঁকে যাওয়া। (Scoliosis)
- চুল, চোখের মণি এবং ত্বকের রং বিবর্ণ হয়ে যাওয়া। (Hypopigmentation)
এছাড়াও রয়েছে:
- জন্মের তিন বছর থেকেই মস্তিষ্কের আকার ছোট হতে শুরু করা। (Microcephaly)
- ঘন ঘন খিঁচুনির আক্রমণ হওয়া।
- কোনো ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মাত্রাতিরিক্ত সাড়া প্রদান। (Hyperreflexia)
- হাতে পায়ে খিল ধরা, দেহের ভারসাম্য ধরে রাখতে না পারা।
- অনেক দেরিতে হাঁটতে শেখা, পেশি নড়াচড়ায় অসুবিধা অনুভব করা।
- ধড়ের আশপাশের মাংসপেশির দৃঢ়তা কমে যাওয়া। (Truncal hypotonia)
- শরীরের অন্যান্য মাংসপেশি, যেমন- পা এবং উরুর মাংশপেশী শক্ত হয়ে যাওয়া। (hypertonia).
- ঠিকমতো খাবার চর্বন এবং গলধঃকরণ করতে না পারার কারণে গ্যাস্ট্রো ইসোফ্যাজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজের দেখা দেয়া।
- পাকস্থলি এবং অন্ত্রের পেশিগুলোর কাজে সমন্বয়হীনতার সৃষ্টি। ফলে বমি, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্যের দেখা দেওয়া।
প্রাপ্তবয়স্ক দেহে অ্যাঞ্জেলম্যান সিনড্রোম
অ্যাঞ্জেলম্যান সিনড্রোম রোগীদের জীবনকাল অন্যসব স্বাভাবিক মানুষের মতোই হওয়ায় আক্রান্ত শিশুদের বেশিরভাগকেই বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে উঠতে দেখা যায়। একজন অ্যাঞ্জেলম্যান সিনড্রোম রোগীর বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তার উপসর্গগুলো বৈচিত্র্য হারাতে শুরু করে এবং সেগুলো পুরু ত্বক এবং অস্থিসার টিস্যুর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
তবে কারো কারো মধ্যে খিঁচুনি, অবধারণগত বিলম্ব এবং বাক-অক্ষমতার মতো উপসর্গগুলো থেকেই যায়। এসকল প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও অনেক রোগীকে আশেপাশের তত্ত্বাবধানে কর্মজীবন ও পারিবারিক জীবনে অবদান রেখে চলতে দেখা যায়।
রোগনির্ণয়
সাধারণ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শারীরিক গঠন ও ব্যবহারই অ্যাঞ্জেলম্যান সিনড্রোম রোগীদের চিহ্নিত করে তোলে। তবে উপসর্গ পর্যবেক্ষণের ওপর অধিক নির্ভরশীল হলো মিসডায়াগনোসিসের সম্ভাবনা বেড়ে যায়, কেননা রোগটির উপসর্গের সাথে অন্যান্য জেনেটিক ডিসঅর্ডারের উপসর্গেরও মিল রয়েছে। তাই পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্য ডিএনএ মিথাইলেশন টেস্টের সহায়তা নেয়া হয়ে থাকে।
চিকিৎসা
সত্যিটা হলো, গবেষকরা এখন পর্যন্ত এ সিনড্রোমের স্থায়ী কোনো নিরাময় কৌশল বের করতে পারেননি। তবে সিনড্রোমের উপসর্গগুলো যাতে রোগীর পরবর্তী জীবনের পথচলাকে কন্টকাকীর্ণ করে তুলতে না পারে, সেজন্যে অাগেভাগেই বিভিন্ন থেরাপির সহায়তা নেয়া হয়ে থাকে। এগুলো হলো:
ফিজিক্যাল থেরাপি: ফিজিক্যাল থেরাপির চর্চা অ্যাটাক্সিয়া এবং পেশির আড়ষ্টভাব কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখে। এ চিকিৎসায় থেরাপিস্ট প্রথমে চিহ্নিত করেন রোগীর শরীরের কোন কোন অংশে কাঁপুনি এবং ঝাঁকুনি অনুভূত হচ্ছে। এরপর তিনি সে অনুযায়ী বিভিন্ন শারিরীক কসরতের প্ল্যান রচনা করেন। এসকল কসরত অনুশীলনের ফলে রোগীর পেশি সুগঠিত হয়, দেহের কাঠামো এবং ভারসাম্য সুসংহত হয়।
স্পিচ থেরাপি: এ প্রক্রিয়ায় একজন স্পিচ থেরাপিস্ট বিভিন্ন ইশারা, ইঙ্গিত এবং ছবির মাধ্যমে রোগীর যোগাযোগজনিত বাঁধাগুলো দূর করার প্রচেষ্টা চালান। বিশেষ করে যেসকল শিশুর মধ্যে শৈশবে এ রোগের উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে, তাদের জন্য এ চিকিৎসা খুবই ফলপ্রসূ হিসেবে দেখা দেয়।
অকুপেশনাল থেরাপি: অ্যাঞ্জেলম্যান সিনড্রোমের একজন রোগী কীভাবে নিজের প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে নিজের দৈনন্দিন জীবনের কাজগুলো সম্পাদন করবেন, সেব্যাপারে সহায়তা করে এই থেরাপিটি। এ থেরাপিতে বিভিন্ন উপকরণের দরকার হয়, যেগুলো রোগীকে একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবনযাপন করতে উপযোগী করে তোলে। যেমন- বিভিন্ন ধরনের পরিধেয় ব্রেস রোগীকে শারীরিক সাপোর্ট যোগায় এবং চলাফেরায় সাহায্য করে।
সার্জিক্যাল থেরাপি: অনেক ক্ষেত্রে বেঁকে যাওয়া মেরুদণ্ড, দাঁতের মধ্যকার ফাঁক ঠিক করতে চিকিৎসকের ছুরি-কাঁচির নিচে যেতে হয় রোগীকে। এছাড়াও অন্ত্রের চিকিৎসায় nissen fundoplication নামের একধরনের সার্জারইর শরণাপন্ন হতে হয় অনেককে।
বিহেভিয়ার মডিফিকেশন: অ্যাঞ্জেলম্যান সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগীদের ঝোঁকপ্রবণতা, খাম-খেয়ালিপনা এবং আত্মঘাতী মনোবৃত্তি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিহেভিয়ার মডিফিকেশনের প্রয়োজন পড়ে। এই থেরাপি প্রয়োগের ফলে রোগীর অপাঙক্তেয় আচরণ ও ব্যবহার কমে আসে।
এছাড়াও রোগের উপসর্গগুলো প্রশমন করতে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এগুলো হলো:
অ্যান্টি কনভালসেন্ট: রোগীর খিঁচুনির প্রকটতা উপশম করতে।
মটিলিটি ড্রাগস: খাদ্য দ্রুত পরিপাক করতে।
ল্যাক্সাটিভস: কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে।
প্রোটন-পাম্প ইনহিবিটরস (PPI): অ্যাসিড রিফ্লাক্সের মাত্রা কমিয়ে আনতে।
সিডেটিভস এবং মেলাটোনিন হরমোন: রোগীর রাতের সুনিদ্রা নিশ্চিত করতে।
রিস্পেরিডন: রোগীর অমনোযোগিতা ও আগ্রাসী আচরণ দমন করতে।