‘কনস্পিরেসি থিওরি’ বা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব- শুনতে খুবই চটকদার এবং আকর্ষণীয় লাগে। জমজমাট এসব তত্ত্বের অস্তিত্ব অনেকদিন ধরেই আছে। বিশেষ করে আধুনিক ‘ইন্টারনেট যুগে’ পুরো ইন্টারনেটই ষড়যন্ত্র তত্ত্বে সয়লাব। চাঁদে মানুষের ভুয়া অবতরণ থেকে ফ্ল্যাট আর্থ থিওরি অথবা ইলুমিনাতি, ফ্রিম্যাসনারি ইত্যাদি গোপন ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে পৃথিবী পরিচালিত হওয়া এমন অসংখ্য কন্সপিরেসি থিওরি প্রচলিত আছে নেটিজেনদের মাঝে।
ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের জন্য এক মোক্ষম পটভূমি নিয়ে হাজির হয়েছে কোভিড-১৯ এবং বিশ্বজুড়ে এর প্রভাব। আধুনিক যুগে আগে কখনোই এমন অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে নজিরবিহীন লকডাউন এবং এর কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং মানসিক অস্থিরতাই এসব আজগুবি ধারণা সাধারণ জনগণের একটি বিশাল অংশকে বিশ্বাস করতে প্রভাব ফেলেছে।
কোভিড-১৯ এর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রচারিত ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো চলুন একনজরে দেখে আসা যাক।
উপন্যাসে করোনার ভবিষ্যদ্বাণী
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের একদম শুরুর দিকেই ইন্টারনেটে এই ব্যাপারটি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৮১ সালে ডিন কুন্টজ-এর লেখা ‘The Eyes of Darkness’ নামের একটি উপন্যাসে Wuhan-400 নামের একটি মানবসৃষ্ট ভাইরাস পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার কথা বলা হয়। এমন ভূতুড়ে মিল দেখে নেটিজেনরা মুহুর্তেই ভাইরাল করে ফেলে সেই উপন্যাসের একটি পৃষ্টার ছবি!
প্রশ্ন হচ্ছে, সত্যিই কি এই উপন্যাস করোনাভাইরাসের ভবিষ্যদ্বাণী করেছে? উত্তর হচ্ছে- না। প্রথমত, সায়েন্স ফিকশন এবং অ্যাডভেঞ্চার লেখকরা সবসময়ই ভাইরাসজনিত মহামারিকে থিলার উপন্যাসের প্লট হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আর একজন আমেরিকান লেখক এমন একটি ভাইরাস, যেটা জীবাণু অস্ত্র হিসবে তৈরি হয়েছে, সেটার উৎপত্তিস্থল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের নাম উল্লেখ করবেন সেটাই স্বাভাবিক।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, বইটির প্রথম সংস্করণে ভাইরাসটির নাম ছিল Gorki-400! বলে রাখা ভালো, এই নামটি নেয়া হয়েছে রাশিয়ার একটি শহরের নাম থেকে এবং এই শহরটিই ছিল ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল! ১৯৮৯ সালে উপন্যাসের ২য় সংস্করণে এর নাম পালতে Wuhan-400 করা হয়। লেখক ভদ্রলোক সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন, পতনের দ্বারপ্রান্তে থাকা সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়, বরং চীনই হবে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী!
তবে উপন্যাসের ভাইরাসের মৃত্যুহার ছিল ১০০%। এই তত্ত্ব জেনে উপন্যাসের সাথে মিল না থাকায় নিশ্চয়ই খুশি হবেন সবাই!
নাটের গুরু বিল গেটস
বিলিয়নিয়ারদের মানুষ সবসময়ই সন্দেহের চোখে দেখে। এজন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্বে ‘নাটের গুরু’ হিসেবে তাদের অভিযুক্ত করার ঘটনা খুবই সাধারণ। করোনাভাইরাস নিয়ে তেমনই আজগুবি সব তত্ত্বে বিল গেটসের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা হয়েছে। উদ্ভট সেসব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হলো-
- বিল গেটস গ্লোবাল এলিটদের লিডার। এজন্য শুধু এলিটদের স্বার্থই চিন্তা করেন।
- তিনি জনসংখ্যা কমানোর নামে পৃথিবীকে জনশূন্য করতে চান।
- করোনাভাইসের ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করে তাতে ‘মন-নিয়ন্ত্রক (mind-control) মাইক্রোচিপ’ মিশিয়ে পুরো পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ নিতে চান গেটস!
বিল গেটসকে নিয়ে উপরের এবং আরো সব কন্সপিরেসি থিওরির উৎস হিসেবে কাজ করে একটি ভিডিও। ২০১৫ সালে ভ্যাঙ্কুবারে জনপ্রিয় টেড বক্তৃতায় তাকে একটি ভয়ানক সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে দেখা যায়,
যদি আগামী কয়েক দশকে এমন কোনো ঘটনা যদি ঘটে যেখানে এক কোটি মানুষ মারা যাবে, তবে সেটা যুদ্ধের কারণে হবে না, বরং এটা হবে সংক্রামক ভাইরাস দ্বারা ঘটিত মহামারির কারণে।
পাঁচ বছর আগের সেই দূরদর্শী বক্তৃতা তখন তেমন মানুষ দেখেনি এবং সেভাবে গুরুত্বও দেয়নি। তবে কোভিড-১৯ মহামারির পর থেকেই এই ভিডিও লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখতে থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, গেটসের সেই ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি ইবোলা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎ মহামারি মোকাবেলার কথা বলেছেন এবং জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার কথাও বলেছেন। মানবজাতি যে এরকম বৈশ্বিক মহামারি প্রতিরোধের জন্য তৈরি নয়, তার সেই দাবীই বরং পরবর্তীতে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
জীবাণু অস্ত্র করোনা
শুরুর থেকেই “বায়োলজিক্যাল ওয়েপন বা জীবাণু অস্ত্র হিসেবেই সৃষ্টি করা হয়েছে করোনাভাইরাস”- এমন দাবী করতে শুরু করে ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা। শুধু সাধারণ মানুষ নন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কেউ কেউও এরকম দাবী করতে থাকেন। কখনও চীনকে দায়ী করা হয়েছে। আবার কখনও যুক্তরাষ্ট্র চীনকে শায়েস্তা করার প্রকল্প হিসেবে কোভিডের সৃষ্টি করার দাবী করা হয়েছে। যদিও এর স্বপক্ষে কখনোই প্রমাণ দেয়া হয়নি।
করোনাভাইরাস যে মানবসৃষ্ট নয় বরং প্রাকৃতিক, এটা বিভিন্ন নিরপেক্ষ এবং আলাদা আলাদা গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।
উহানের ল্যাব ‘ফসকে’ ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস
সম্ভবত এই থিওরি কোভিড-১৯ সংক্রান্ত ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মধ্যে সর্বাধিক ‘জনপ্রিয়’। উহানের এক ল্যাবে ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছিলেন চীনা বিজ্ঞানীরা। তারপর কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে ল্যাব থেকে ফসকে বেরিয়ে পড়ে করোনাভাইরাস! তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী।
এই তত্ত্বের জ্বালানী হিসেবে কাজ করেছে উহানে অবস্থিত ‘উহান ইন্সটিটিউট অব ভাইরোলজি’। প্রসঙ্গত, এই ল্যাবটি চীনের একমাত্র লেভেল-৪ বায়ো ল্যাবরোটরি। লেভেল-৪ হচ্ছে সর্বোচ্চ স্তরের নিরাপত্তা সম্বলিত ল্যাব। সেখান থেকে কোনো ভাইরাসের ‘লিক’ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই নগণ্য।
করোনাভাইরাসের উৎস সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত না হওয়া গেলেও বাদুড় থেকে অন্য কোনো প্রাণীর মাধ্যমে ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে বলে ধারণা করেন বিশেষজ্ঞরা।
ফাইভ-জি প্রযুক্তি
কোভিড-১৯ সম্পর্কিত কন্সপিরেসি থিওরির মধ্য সবচেয়ে অদ্ভুত এবং হাস্যকর হচ্ছে ফাইভ-জি প্রযুক্তির মাধ্যমে ভাইরাস ছড়ানোর দাবী! ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার গতি বাড়ছে ভাইরাসের এবং এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হবে পৃথিবীর জনসংখ্যা! এই তত্ত্বের নেতা হিসেবে পরিচিত ডেভিড আইক এমনই দাবী করে থাকেন। তবে ভাইরাসের মতো একটি বায়োলজিক্যাল জিনিস ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের সাহায্যে কীভাবে সংক্রমিত হতে পারে সেটা ব্যাখ্যা করতে পারেননি এই তত্ত্বের সমর্থকেরা! আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, পৃথিবীর মাত্র ৩৪টি দেশে যেখানে ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক প্রচলিত, সেখানে পৃথিবীর সব দেশে করোনাভাইরাস ছড়ালো কীভাবে? ডেভিড আইক নামের ভদ্রলোক নিশ্চয়ই এই প্রশ্নের জবাব দিতে চাইবেন না!
সবই টাকার খেলা?
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, পৃথিবীর সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা হতে পারে ভ্যাক্সিন তৈরি করা। তাহলে কি কোনো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ভ্যাক্সিন নিয়ে কোটি কোটি টাকার ব্যবসার জন্য করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে? এমন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথাও মাঝে মাঝে শোনা যায়।
তবে শুনতে দারুণ আকর্ষণীয় মনে হলেও এই ধরনের পরিকল্পনা কোনো কোম্পানির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।কারণ, ভ্যাক্সিন তৈরি করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ ও পরিশ্রমের কাজ।
সার্স মহামারির সময়কার কথা। টেক্সাসের একদল বিজ্ঞানী সার্স ভাইরাসের ভ্যাক্সিন নিয়ে কাজ করছিলেন। সম্ভাবনাময় সেই ভ্যাক্সিনের পেছনে ঢালা হয় প্রচুর অর্থ এবং শ্রম। তবে ভ্যাক্সিন তৈরির কাজ শেষ হওয়ার আগেই কমতে থাকে মহামারির প্রকোপ। কিছুদিন পর প্রায় পুরোপুরি উধাও হয়ে যায় ভাইরাস।
ফলাফল? গবেষণা বন্ধ হয়ে যায়। আর প্রচুর অর্থ, সময় আর শ্রমের পুরোটাই গচ্ছা যায়!