করোনাভাইরাস ভ্যাক্সিন: আর কতদূর?

এ এক অদ্ভুত সময়!

ব্যস্ত শহরগুলো এখন শুনশান। ঢাকা শহর দেখে মনে হয় ঈদের ছুটি চলছে। দোকানপাট বন্ধ। খেলার মাঠে নেই কোনো হইচই, কোলাহল। যেন জাদুকরের কাঠির ছোঁয়ায় সবাই ঘুমিয়ে গেছে। হঠাৎ কোনো ভিনগ্রহবাসি পৃথিবীতে চলে এলে সে অবাক বিস্ময়ে ভাববে, “আরে! এ কোন নিঝুমপুরিতে চলে এলাম? কে কবে ভেবেছিল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ প্রাণী এক আণুবীক্ষণিক জীবের ভয়ে চার দেয়ালের গণ্ডিতে আটকে যাবে।

কিন্তু সেই সময়ই এখন উপস্থিত। করোনাভাইরাস আমাদের পরিচিত এই পৃথিবীকে একনিমিষে পাল্টে দিয়েছে। মহামারী এসেছে, আবার চলেও যাবে। কিন্তু অনেক কিছুই আর আগের মতো থাকবে না।

করোনা ভাইরাস; Image source: WHO

বর্তমান পরিস্থিতি

চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে শুরু হওয়া করোনা মহামারি বিশ্বের প্রায় সব দেশকেই আঘাত করেছে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের (WHO) হিসাবমতে ২১৩টি দেশ এখন পর্যন্ত করোনার থাবায় আক্রান্ত। তাদের ডাটা অনুযায়ী দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষ সংক্রামক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয়েছে দেড় লাখেরও বেশি নাম। আমাদের বাংলাদেশেও প্রতিদিনই নতুন নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। কার্যকরী কোনো ওষুধ না থাকায় এই মহামারীর বিরুদ্ধে প্রধান প্রতিরোধ নিজেকে ঘরে আবদ্ধ রাখা এবং বাইরের জগতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। বিশেষজ্ঞদের মতে যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো ভ্যাক্সিন আবিষ্কার না হচ্ছে ততক্ষন পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে বলার উপায় নেই যে আমরা এই মহামারী থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি।

বিশ্বজুড়ে করোনা ডিজিজ; Image Source: businessinsider.com

ভ্যাক্সিন

করোনা ভাইরাস নিয়ে কিছু লেখা পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, ভ্যাক্সিন এবং প্রতিষেধক নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। ভ্যাক্সিন বস্তুত একটি প্রতিরোধক, যা প্রয়োগ করা হয় সুস্থ মানুষের উপরে যাতে তার ভবিষ্যতে সেই রোগ হবার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। যিনি আক্রান্ত হয়ে গেছেন তার জন্য ভ্যাক্সিন নয়, তাকে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন অ্যান্টিডোট, বা প্রতিষেধক।

কীভাবে কাজ করবে করোনা ভাইরাস ভ্যাক্সিন

ভ্যাক্সিন তৈরির বিভিন্ন উপায় আছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো মৃত জীবাণু ব্যবহার করা, অথবা জীবিত অণুজীব থেকে তার রোগ উৎপাদক অংশটি পৃথক করে তারপর শরীরে প্রবেশ করান। যেভাবেই ভ্যাক্সিন তৈরি করা হোক না কেন, মূল উদ্দেশ্য আমাদের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সামনে ওই জীবাণুটিকে চিনিয়ে দেয়া। ফলে আমাদের শরীর এর বিরুদ্ধে যথেষ্ট পরিমাণে অ্যান্টিবডি প্রস্তুত করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে যখন সত্যিকারের ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া আমাদের রক্তে ঢুকে পড়ে তখন ইমিউন সিস্টেম আগের পরিচিতির জের ধরে খুব দ্রুত অ্যান্টিবডি তৈরি করে ফেলে। ফলে রোগ হবার আগেই আমাদের শরীর নির্দিষ্ট অণুজীবটিকে মেরে ফেলতে সক্ষম হয়।

করোনাভাইরাসের জন্যও বেশিরভাগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই পরিক্ষিত এবং বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি অনুসরণ করছে। তবে ব্যতিক্রমও আছে। আমেরিকান কোম্পানি মডার্না ভ্যাক্সিন তৈরিতে ভাইরাসের জেনেটিক কোড বহনকারী বার্তাবাহক আরএনএ (mRNA) ব্যবহার করছে। আমাদের শরীরে এই mRNA ভাইরাসের রোগ সৃষ্টিকারী প্রোটিনের অনুলিপি তৈরি করবে, যা ইমিউন সিস্টেমকে স্টিমুলেট করে অ্যান্টিবডি প্রস্তুত করবে।

বার্তাবাহক আরএনএ; Image source: expii.com

ভ্যাক্সিন প্রস্তুতির ধাপসমূহ

ভ্যাক্সিন প্রস্তুত করে তা মানুষের কাছে নিয়ে আসা এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। ল্যাবে তৈরি প্রত্যেকটি ভ্যাক্সিনকে কঠোর নিয়মকানুন অনুসরণ করে ধাপে ধাপে এর নিরাপত্তা ও কার্যকারিতার প্রমাণ দিতে হয়। প্রথমে তৈরি করা ভ্যাক্সিনের খুব কম সংখ্যকই কিন্তু শেষ পর্যায় পর্যন্ত আসতে সক্ষম হয়।

যেকোনো ভ্যাক্সিন প্রস্তুতির পর প্রথম অবস্থায় তা পশুর উপর প্রয়োগ করা হয়। এই পুরো বিষয়টি প্রি ক্লিনিক্যাল ফেইজের অন্তর্ভুক্ত। এখানে ভ্যাক্সিনের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে। এর পরিমাণ, প্রাণীদেহে ভ্যাক্সিনের প্রভাব এবং আরো অনেক খুঁটিনাটি বিজ্ঞানীরা এই স্তরে পরীক্ষা করেন, যাতে মানবদেহে ক্ষতির সম্ভাবনা কম থাকে।

এরপর ভ্যাক্সিন প্রবেশ করে ক্লিনিক্যাল ফেইজে। এখানে মোটা দাগে তিনটি ধাপ পার হতে হয়।   

প্রথম ধাপ: খুব কম সংখ্যক (সাধারণত ১০০ বা এর চেয়েও কম) মানুষকে ভ্যাক্সিন ইঞ্জেক্ট করে মূলত এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না তা দেখা হয়।

দ্বিতীয় ধাপ: শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী এই পর্যায়ে যুক্ত হন। তাদের উপর ভ্যাক্সিনের সক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়। এতে কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।

তৃতীয় ধাপ: হাজারের অধিক মানুষের উপর ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করা হয়। এখানে ব্যাপকভাবে ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা সফলভাবে প্রমাণিত হলেই কেবল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার কাছে অনুমোদন চাওয়া হয়।

ভ্যাক্সিন ডেভেলপমেন্ট; Image Source: The Association of the British Pharmaceutical Industry

আমরা কোথায় আছি

এই বছর জানুয়ারির ১০ তারিখ চীনা বিজ্ঞানীরা ৩০ হাজার অক্ষর সম্বলিত করোনা ভাইরাসের পরিপূর্ণ জেনেটিক কোড প্রকাশ করেন। এর ফলে সাড়া পৃথিবীতে অন্যান্য গবেষকদের পক্ষে কৃত্রিমভাবে ভাইরাসের কপি তৈরি করা সম্ভব হয়। এর ফলে ভ্যাক্সিন তৈরির সময় সংক্ষেপ করা সম্ভব হয়। কারণ জেনেটিক কোড জানা না থাকলে গবেষকদের সত্যিকারের ভাইরাসের নমুনার জন্য অপেক্ষা করতে হত।

জেনেটিক কোড প্রকাশ পাবার তিন ঘন্টার মধ্যেই মার্কিন কোম্পানি ইনোভিও কম্পিউটার মডেল ব্যবহার করে সম্ভাব্য ভ্যাক্সিনের একটি ব্লুপ্রিন্ট করতে সক্ষম হয়। প্রায় ৮০টির মতো প্রতিষ্ঠান ভ্যাক্সিন তৈরি করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস, নরওয়েভিত্তিক একটি ননপ্রফিট অর্গানাইজেশন এ কাজে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। WHO এর প্রতিবেদন অনুযায়ী এখন পর্যন্ত তিনটি ভ্যাক্সিন ক্লিনিক্যাল স্টেজে রয়েছে, আরো ৬৭টি আছে প্রি-ক্লিনিক্যাল ফেইজে।  

কারা এগিয়ে আছে

– অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল সায়েন্স এজেন্সি এপ্রিলের শুরুতে জানিয়েছে তার গবেষণাগারে অ্যানিমেল টেস্টিং শুরু করেছে।

– ইউএস ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ বায়োটেক কোম্পানি মডার্নার যৌথ প্রয়াসে তৈরি ভ্যাক্সিনের সাংকেতিক নাম mRNA-1273। মার্চের ১৬ তারিখ সর্বপ্রথম জেনিফার হ্যালার নামে একজন নারী স্বেচ্ছাসেবী এই ভ্যাক্সিন গ্রহণের মাধ্যমে হিউম্যান ট্রায়ালের সূচনা করেন।

মানবদেহে ভ্যাক্সিন প্রয়োগ;  Image Source: Ted S Warren/ AP 

– ইনোভিও ফার্মাসিউটিক্যালের প্রস্তুতকৃত ভ্যাক্সিনের কোড নেম INO-4800। এপ্রিলের শুরুতে তারাও ফিলাডেলফিয়া ও মিসৌরির কান্সাস সিটিতে তাদের হিউম্যান ট্রায়াল চালু করেছে।

– বেইজিং ইন্সটিটিউট অফ বায়োটেকনোলজি এবং চীনা বায়োটেক কোম্পানি ক্যানসিনো জানিয়েছে তারাও ক্লিনিক্যাল টেস্টিং পর্যায়ে আছে।

– যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনার ইনস্টিটিউট ২৩ এপ্রিল থেকে হিউম্যান  ট্রায়াল শুরু করেছে। প্রথম স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এলিসা গ্র্যানাটো ট্রায়াল ভ্যাক্সিন (ChAdOx1 nCoV-19) লাভ করেন। এখন পর্যন্ত দুজন স্বেচ্ছাসেবী ভ্যাক্সিন পেয়েছেন। এই ট্রায়ালে ৮ শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী অন্তর্ভুক্ত।  

ইম্পেরিয়াল কলেজ অফ লন্ডন জুন থেকে তাদের ভ্যাক্সিনের দ্বিতীয় ফেইজের ট্রায়াল আরম্ভ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।

– বিশ্ববিখ্যাত জনসন এন্ড জনসন কোম্পানি তাদের এবোলা ভ্যাক্সিনের উপর ভিত্তি করে করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন তৈরি করছে।

– যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি নোভাভ্যাক্স মার্স ডিজিজের মডেল অনুসরণ করে, যা করোনাভাইরাস ডিজিজের অনেকটা অনুরূপ, তাদের ভ্যাক্সিনের পথে অনেকদূর এগিয়ে গেছে।

– জার্মান প্রতিষ্ঠান কিউরভ্যাক তাদের গবেষণায় মডার্নার প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।

আমাদের আর কতদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে

অতীতে একটি ভ্যাক্সিন তৈরি করে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার অনুমোদন নিয়ে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত নিয়ে আসতে ১০-২০ বছর সময়ও লেগে গেছে। তবে বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনেকদূর এগিয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ১২-১৮ মাসের মধ্যে করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন বাজারজাত করা সম্ভব হবে। তবে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক সারা গিলবার্ট আশাবাদী, সেপ্টেম্বরের মধ্যেই তারা ভ্যাক্সিন বানিয়ে ফেলতে সক্ষম হবেন। তবে মনে রাখতে হবে, সাধারণ মানুষের মধ্যে তা আসার জন্য আরো পথ পাড়ি দিতে হবে।  

যদিও ভ্যাক্সিনের কাজ খুব দ্রুত এগিয়ে চলেছে, তারপরেও মনে রাখতে হবে- এই বছরই সাধারণ মানুষ পর্যন্ত ভ্যাক্সিন পৌঁছানোর সম্ভাবনা ক্ষীণ। কাজেই বাড়িতে থাকুন, নিরাপদ থাকুন।

Related Articles

Exit mobile version