নতুন বছরের ৩রা জানুয়ারি ভারতের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তরফ থেকে কোভিড মোকাবেলার জন্য দুটি ভ্যাক্সিনের অনুমোদন দেয়া হয়। একটি ছিল অ্যাস্ট্রাজেনেকা আর অক্সফোর্ডের তৈরি করা টিকা, যা কোভিশিল্ড নামে বাজারে আসে। কোভিশিল্ড নিয়ে অনুমোদনের আগের দুদিন সরকার নিয়োজিত বিশেষজ্ঞ প্যানেল অত্যন্ত সতর্কভাবে যাচাই-বাছাই করার পরেই ভারতীয়দের উপর এই টিকা প্রয়োগের পক্ষে মতামত দেয়। তাদের প্রতিবেদন যে কোভিশিল্ডের অনুকূলে তা প্রকাশ পাবার পরপরই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে ইংল্যান্ডের পর অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভারতেও কোভিড টিকা নিয়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। কিন্তু অনেকেই যে বিষয়ে অবাক হয়েছেন সেটি হলো ভারতের তৈরি কোভ্যাক্সিনকেও একই দিনে অনুমোদন দেয়া।
কোভ্যাক্সিন ভারত বায়োটেকের তৈরি কোভিড প্রতিরোধী টিকা। ভারত বায়োটেক হায়দ্রাবাদভিত্তিক একটি জৈব প্রযুক্তি কোম্পানি যারা কাজ করে মূলত স্বাস্থ্যখাতে টিকা ও ওষুধ তৈরি নিয়ে গবেষণা করে। ডায়রিয়া, জিকা, চিকুনগুনিয়াসহ কিছু রোগের টিকা প্রস্তুতিতে তাদের ভূমিকা রয়েছে। কোভিড ভ্যাক্সিন তৈরিতে তারা জোট বেধেছিল ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর) এবং পুনেতে অবস্থিত জাতীয় ভাইরোলজি ইন্সটিটিউটের (National Institute of Virology) সাথে। তারা ডিসেম্বরের ৭ তারিখ প্রাথমিক কিছু ফলাফলের উপর ভিত্তি করে সরকারি অনুমোদন চেয়ে বসে। এবং আশ্চর্যজনকভাবে তা পেয়েও যায়।
কোভ্যাক্সিনের বৈজ্ঞানিক নাম BBV152। এটি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে মৃত করোনাভাইরাসের একটি প্রজাতি, NIV-2020-770, যার মধ্যে ছিল করোনাভাইরাসের চিহ্নিত একটি মিউটেশন, D614G mutation। এই মিউটেশন নিয়ে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা বেশ কাজ করেছেন, এবং ভারত বায়োটেক দাবি করেছে তাদের ভ্যাক্সিন এই মিউটেশনের বিরুদ্ধে কাজ করতে সক্ষম।
কোভ্যাক্সিনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভাইরাস তৈরিতে বেছে নেয়া হয় আফ্রিকান গ্রিন মাঙ্কির কিডনি। টিকা তৈরিতে ফাইজার, মডার্না ব্যবহার করেছে ভাইরাসের এমআরএন’এ, যা সম্পূর্ণই নতুন। অন্যদিকে অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ড প্রথাগত পদ্ধতিতে ভাইরাসের অংশবিশেষ দিয়ে তাদের টিকা বানিয়েছে। ভারত বায়োটেক নতুন কিছুর দিকে না গিয়ে প্রচলিত প্রযুক্তি অনুসরণ করেছে, যা কোভিডের একটি ভাইরাস নিয়ে তাকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় নিষ্ক্রিয় করে সেটি টিকা হিসেবে ব্যবহারের উপযুক্ত করে তোলা। এই মৃত বা নিষ্ক্রিয় ভাইরাস যখন শরীরে প্রবেশ করানো হয় তখন সেটি আমাদের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে সক্রিয় করে তোলে, যার ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয় অ্যান্টিবডি। এই অ্যান্টিবডি আমাদের পরবর্তী ভাইরাস আক্রমণের বিরুদ্ধে রক্ষা করতে সহায়তা করে।
সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে ভারত বায়োটেক টিকা প্রস্তুতে সরাসরি মৃত বা নিষ্ক্রিয় করোনাভাইরাস ব্যবহারের পথ বেছে নিয়েছে। এজন্য জাতীয় ভাইরোলজি ইন্সটিটিউট তাদেরকে সেই ভাইরাস সরবরাহ করে। মে মাসের ৯ তারিখ ভাইরাস পাবার পর প্রথমে মানুষ ব্যতিত অন্য প্রাণীর উপর পরীক্ষা চালায়। এই ফলাফল জমা দিয়ে মাত্র দেড় মাসের মাথায় তারা ঔষধ প্রশাসন থেকে মানব পরীক্ষা চালানোর অনুমোদন পেয়ে যায়।
দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা শেষে ভারত বায়োটেক ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তাদের ফলাফল প্রকাশ করে, যদিও এর আগে তাদের তথ্য কিন্তু নিরপেক্ষভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়নি। এই পদ্ধতিকে বলা হয় পিয়ার রিভিউ, যেখানে প্রকাশিতব্য নিবন্ধ নিরপেক্ষ বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ সুচারুরূপে বিশ্লেষণ করেন। বলা বাহুল্য, এভাবে প্রকাশিত যেকোনো নিবন্ধের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। তবে এটাও ঠিক- করোনাভাইরাসের অতিমারির সময় অনেক সময়েই দ্রুত তথ্য প্রকাশ করতে পিয়ার রিভিউ ছাড়াই অনেক কিছু প্রকাশ করা হচ্ছে।
ভারত বায়োটেকের পরীক্ষার জন্য বেছে নেয়া হয়েছিল ৩৮০ জন ভারতীয়কে, যাদের মনোনীত করা হয় ভারতের নয়টি প্রদেশ থেকে। প্রতিটি প্রদেশে একটি নির্দিষ্ট ক্লিনিকে চালানো হয় পরীক্ষা। মাংসপেশিতে প্রয়োগের মাধ্যমে ভ্যাক্সিন প্রয়োগের সূচনা হয়। বিশ্বের অন্যান্য অনুমোদিত করোনা টিকার মতো এখানেও দুটি ডোজ ব্যবহার করা হয়, যা প্রয়োগ করা হয় এক মাসের ব্যবধানে। প্রথম ধাপের পরীক্ষায় কোভ্যাক্সিন করোনার বিরুদ্ধে রক্তে যথেষ্ট পরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি করে বলে দাবি করা হয়, যা দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষায় বজায় থাকে। টিকা প্রদানের পর সুরক্ষা তৈরি হতে তিন মাসের মতো সময় লাগে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও ছিল সামান্য।
প্রথম আর দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষার ফলাফল জমা দিয়ে ভারত বায়োটেক পেয়ে যায় তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার অনুমতি। কোনো ওষুধ বা টিকা অনুমোদনের পথে সর্বশেষ হলো তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা। তৃতীয় ধাপের জন্য ভারত বায়োটেকের পরিকল্পনা ভারতজুড়ে ২৫টি ক্লিনিকে প্রায় ২৬,০০০ স্বেচ্ছাসেবক যুক্ত করা। তারা এই কাজে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সম্ভবত জানুয়ারির মধ্যেই তারা তাদের তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা শেষ করতে পারে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার এমনকি অন্তর্বর্তীকালীন ফলাফল পাবার আগেই কোভ্যাক্সিন অনুমোদন দেয়া নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি এত দ্রুততার সাথে ভারত বায়োটেক এর আগের ধাপগুলি পার হয়ে এসেছে যে সেখানেও সন্দেহের অবকাশ রয়ে গেছে। তবে প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা বরাবরই নিজেদের ভ্যাক্সিনের ব্যাপারে আশাব্যাঞ্জক কথা বলে এসেছেন। তাদের একজন পরিচালক সাই প্রসাদ ২০২০ সালের অক্টোবরের শেষদিকে দাবি করেন যে পরীক্ষার প্রথম দুই ধাপে কোভ্যাক্সিনের কোনো বড় রকমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি, যদিও এর স্বপক্ষে জনসমক্ষে বড়সড় কোনো প্রমাণ তারা হাজির করতে পারেনি। প্রসাদ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের কাছে এ কথাও বলেন যে, প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের শতকরা ৯০ ভাগের বেশি লোক টিকা দেয়ার পর সুরক্ষা পেয়েছেন।
সাই প্রসাদের পর একই বছরের নভেম্বরের ২১ তারিখ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে যে তাদের ভ্যাক্সিন শতকরা ৬০ ভাগ কার্যকারিতা দেখায়। স্মরণ রাখতে হবে, এই দাবি ছিল দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে, যা কার্যকারিতা মাপার মাপকাঠি হিসেব আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষায় প্রধান উদ্দেশ্য থাকে ওষুধ বা ভ্যাক্সিনের নিরাপত্তা যাচাই, কার্যকারিতা বিষয়ে দ্বিতীয় ধাপে কিছুটা ধারণা পাওয়া গেলেও তা জোর দিয়ে বলার মতো কিছু নয়। কিন্তু ভারত বায়োটেক এই ভিত্তিতেই ২০২১ সালের জুন মাস নাগাদ বাজারে টিকা আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করে। তবে ভারতীয় বিজ্ঞানীরাই তাদের দাবির ব্যাপারে সন্তুষ্ট ছিলেন না।
মজার ব্যাপার হলো তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা না করেই ভারত বায়োটেক তাদের ভ্যাক্সিন অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করে। অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ডের ক্ষেত্রে যেমন দুদিন আলোচনা করা হয়েছিল, ভারত বায়োটেকের ব্যাপারে তা করার জন্য কোনো সরকারি কমিটি গঠনের কথা শোনা যায়নি। বিশ্লেষকরা এমনকি ভাবেনওনি যে অ্যাস্ট্রাজেনেকার সাথে কোভ্যাক্সিনও অনুমোদন দেয়া হবে।
ভারতের ঔষধ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা ভি জি সোমানি তাদের সিদ্ধান্তের পেছনে সাফাই গেয়েছেন এই কথা বলে যে কোভ্যাক্সিন অত্যন্ত নিরাপদ এবং আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে বলে প্রমাণিত হয়েছে। করোনা অতিমারি এবং ভারতে রোগীর ক্রমবর্ধমান সংখ্যার দিকে ইশারা করা তিনি জনস্বাস্থ্যে একাধিক ভ্যাক্সিনের দরকার বলে মন্তব্য করেন, যেগুলো করোনার মিউটেশনের বিপক্ষেও কাজ করতে সক্ষম।
কোভ্যাক্সিনকে শতভাগ কার্যকর প্রত্যয়ন করে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে সামান্য জ্বর আর ব্যথার কথা উল্লেখ করেন। তবে সবচেয়ে অভিনব ব্যাপার হচ্ছে যেখানে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা অনুমোদন দেয়া হয়েছে জরুরি ব্যবহারের জন্য, সেখানে কোভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রে অনুমোদনের জন্য একটি বিশেষ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, এটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মতো করে (Clinical Trial Mode) ব্যবহারের জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছে। এটা ঠিক যে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের আগে কর্তৃপক্ষের অনুমতির ব্যাপার আছে, কিন্তু ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মতো করে বাজারজাতকরণের অনুমোদন সম্ভবত এর আগে কেউ কোনোদিন শোনেনি।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের এমন অদ্ভুত শব্দগুচ্ছ ভারতীয় বিশেষজ্ঞদেরকেই বিভ্রান্ত করে দিয়েছে। ভেলরের ক্রিশ্চিয়ান মেডিক্যাল কলেজের (সিএমসি) অণুজীববিজ্ঞানের প্রথিতযশা অধ্যাপক, গগনদ্বীপ ক্যাং টাইমস অফ ইন্ডিয়ার সাথে এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেন, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মতো করে ওষুধ বলতে কর্তৃপক্ষ কী বোঝাচ্ছে সেই বিষয়ে তার কোনো ধারণাই নেই। তিনি এর আগে এমন কিছু দেখেননি বা শোনেনওনি। তড়িঘড়ি করে কোভ্যাক্সিন বাজারে ছাড়ার তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন, ভারত বায়োটেক এখন পর্যন্ত কার্যকারিতার কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্যই তো হাজির করতে পারেনি, তারা কীভাবে অনুমোদন পায়?
চারদিক থেকে সমালোচনার জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন ব্যাখ্যা করেন- ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মতো করে বলে বোঝানো হয়েছে যে যাদেরকেই কোভ্যাক্সিন দেয়া হবে তাদের প্রত্যেককে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে, যা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে করা হয়। তবে মনে রাখতে হবে, কোভিড ভ্যাক্সিন যারাই পাবে তাদেরকে সরকারি তথ্যকেন্দ্রে নাম লিপিবদ্ধ করতে হবে, তা কোভিশিল্ড বা কোভ্যাক্সিন যা-ই হোক না কেন। সুতরাং কোভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত পর্যবেক্ষণ ঠিক কীভাবে এই প্রক্রিয়ার থেকে আলাদা তা পরিষ্কার নয়।
তবে হর্ষ বর্ধনের ব্যাখ্যা বিতর্ক না থামিয়ে উস্কে দিয়েছে মাত্র। ভারতের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নজরদারি করা প্রতিষ্ঠান All India Drug Action Network কার্যকারিতার স্বপক্ষে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা ব্যতিরেকেই কোভ্যাক্সিন বাজারে আনার সিদ্ধান্তে অস্বচ্ছ এবং প্রশ্নসাপেক্ষ বলে অভিহিত করেছে। এতে ঔষধ কর্তৃপক্ষের ব্যাপারে মানুষের মধ্যে শঙ্কা ও অবিশ্বাস সৃষ্টির ব্যাপারেও তারা সতর্ক করে দেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেও কোভ্যাক্সিনের অনুমোদনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন একে ভারতের জন্য একটি মাইলফলক বলে। তার সমর্থকেরাও একে ভারতীয় প্রযুক্তির বিজয় বলে আনন্দ প্রকাশ করে যাচ্ছেন। ভারত বায়োটেকের প্রধান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষার পরেই ভারতে বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় ওষুধ অনুমোদনের নিয়ম রয়েছে, কোভ্যাক্সিন সেই প্রক্রিয়াই অনুসরণ করেছে।
প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ডক্টর কৃষ্ণা এলা কৃষ্ণা সংবাদ মাধ্যমে দাবি করেছেন তাদের টিকার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করা হয়নি, যথেষ্ট প্রমাণ সাপেক্ষেই তারা কোভ্যাক্সিনকে মানুষের ব্যবহারযোগ্য বলে মনে করছেন। তারা ফেব্রুয়ারির ভেতরেই তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার অন্তর্বর্তীকালীন ফলাফল প্রকাশ করবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দেন। কৃষ্ণা এলার কথা থেকে জানা যায়- তাদের হাতে ইতোমধ্যেই বিশ মিলিয়ন ডোজ আছে, এবং ২০২১ সালের শেষ নাগাদ তারা ৭০০ মিলিয়ন ডোজ তৈরির আশা রাখেন। এর মধ্যে ২০০ মিলিয়ন ডোজ বানাবে হায়দ্রাবাদে তাদের ফ্যাক্টরি আর বাকিগুলো ভারতের অন্যান্য শহরে তৈরি হবে।
কোভ্যাক্সিন নিয়ে ভারতের স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক প্রেম আনন্দ মুরুগান বেশ কিছু পয়েন্ট তুলে ধরেছেন। মাত্র পঞ্চাশ দিন (মে’৯-জুন’২৯) ব্যবধানে প্রাণীদেহে পরীক্ষা শেষ করে কোভ্যাক্সিন মানুষের শরীরে প্রয়োগের অনুমতি তার কাছে সন্দেহজনক। কারণ সাধারণভাবে প্রাণীদেহে পরীক্ষা শেষ করতে আরো অনেক বেশি সময় লাগে, এবং মে মাসে জাতীয় ভাইরোলজি ইন্সটিটিউট থেকে ভাইরাস পাবার পরেই কেবল ভারত বায়োটেকের পক্ষে পরীক্ষা শুরু করা সম্ভব হয়েছিল। করোনা অতিমারির মধ্যে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে কিছুটা দ্রুত পদ্ধতি অনুসরণ করা হলেও অন্যান্য দেশের ভ্যাক্সিনের জন্য প্রাণীদেহে পরীক্ষায় কোভ্যাক্সিনের থেকে অনেক বেশি সময় লেগেছিল।
ভারত বায়োটেক প্রাণীদেহে পরীক্ষার ব্যাপারে সেপ্টেম্বরে একটি লেখা প্রকাশ করে, যেখানে তারা জুনের ৬ তারিখ থেকে এই পরক্ষা আরম্ভ করেছিল বলে জানায়। মুরুগান একে আরো সন্দেহজনক আখ্যা দেন, কারণ তাহলে ধরে নিতে হবে মাত্র ২৩ দিনে এই তারা শুধু এই পরীক্ষা সমাপ্তই করেনি, সব কাগজপত্র তৈরি করে প্রশাসনের কাছে জমাও দিয়েছে। একে গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে তোলা যেতে পারে!
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চের কোভ্যাক্সিন আবিষ্কার ও উৎপাদনে জড়িত থাকাকে কোনো কোনো নিন্দুক দ্রুত অনুমোদনের কারণ বলে ইঙ্গিত করেছেন। ২০২০ সালের ২রা জুলাই আইসিএমআর পরিচালক বারলাম ভারগভ ১২টি হাসপাতালকে জুলাইয়ের ৭ তারিখের মধ্যে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য প্রস্তুত থাকার কথা বলেন, তিনি আগস্টের ১৫ তারিখের মধ্যে জনসাধারণের উপর কোভ্যাক্সিন প্রয়োগের সূচনা করা হবে বলেও মত দেন। কোভ্যাক্সিন সম্পর্কে তখন কোনো তথ্যই জানা ছিল না, ফলে এমন টাইম টেবিল স্বাভাবিকভাবেই তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি করে। আইসিএমআর নিজেদের সাফল্য জাহির করতে কোভ্যাক্সিন অনুমোদনে তাড়াহুড়ো করছে কিনা এই নিয়ে প্রচুর কথা ওঠে।
আকাশ শেঠি আর গায়ত্রি লাহা নামে দুজন স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক কোভ্যাক্সিনের প্রথম ধাপের পরীক্ষার ব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারেন যে যেসব ক্লিনিকে পরীক্ষা করা হয়েছিল, সেগুলোর কয়েকটিতে কোনো নৈতিকতা কমিটি বা এথিকস কমিটির কাছ থেকে পূর্বানুমতি নেয়া হয়নি, যা যেকোনো কিনিক্যাল ট্রায়ালের পূর্বশর্ত। অন্যান্য অনেক ক্লিনিকে এথিকস কমিটি ভারত বায়োটেকের পরীক্ষা পর্যালোচনার জন্য যথেষ্ট দক্ষতা রাখত না। চারটি হাসপাতাল: গিল্লুরকার, লিভান রেখা, প্রখর আর রানা মূলত বেসরকারিভাবে পরিচালিত ছোট ক্লিনিক যাদের গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই এবং তারা কোনো অ্যাকাডেমিক ইন্সটিটিউশনও নয়।
কোভ্যাক্সিনের দাম কেমন হবে সেই বিষয়ে ভারত বায়োটেক কিছুটা ধারণা দিয়েছে। কোভিশিল্ড ২৫০-৩০০ রুপি দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, অন্যদিকে কোভ্যাক্সিনের প্রথম চালান ৩৫০ রুপিতে বাজারে ছাড়া হবে। তবে পর্যায়ক্রমে এই দাম কমে আসবে বলে তারা আশ্বাস দিয়েছেন। তৃতীয় বিশ্বের জন্য স্বল্পমূল্যের বিকল্প হিসেবে কোভ্যাক্সিনের ভাল সম্ভাবনা আছে। তবে মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে কার্যকারিতা বিষয়ে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের রাখঢাক। তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা ছাড়াই বাজারে আনায় এর উপর প্রচুর মনোযোগ থাকবে, ফলে সামান্য সমস্যাই অনেক বড় আকার ধারণ করতে পারে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে কর্তৃপক্ষ বলছে কোভ্যাক্সিন শুধু সেসব ক্ষেত্রেই দেয়া হবে যেখান কোভিশিল্ড দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বা কোভিশিল্ড কার্যকর হবে বলে মনে হবে না, কিন্তু তারপরেও তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার ফলাফল হাতে না পেয়ে কোভ্যাক্সিন অনুমোদন ঠিক হয়নি বলেই বিশেষজ্ঞদর একটা বড় অংশ মনে করেন। একে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার করা হচ্ছে বলে বিরোধী দলগুলো ইতোমধ্যে অভিযোগ করছে। সামনের দিনগুলোই বলে দেবে এই সিদ্ধান্ত কতটা সফল বা ব্যর্থ।