বেশ কিছুদিন ধরেই X (ছদ্মনাম) স্কুলে যেতে চাইছে না। শুধু কি তা-ই? স্কুলের নাম শুনলেই দৌড়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়ছে মায়ের অাঁচলের নিচে। তবে এর পেছনে একটা কারণও অাছে। X ভীষণ বোকাসোকা ও অালসে। অন্তত X এর মা-বাবার ভাষায় তো তা-ই। ক্লাসের সবচেয়ে গবেট ছেলেটি কে, তা জিজ্ঞেস করলে তার দিকে অাঙুল তুলে দেখিয়ে দিতে কারো তেমন একটা বেগ পেতে হয় না। চেয়ারে ঠিকমতো বসতে পারা থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছুতেই ছেলেটির সমস্যা। এমনকি ক্লাসে টিচার ঠিক কী বিষয় নিয়ে অালোচনা করছেন, সেটি X এর ঠাহর করে উঠতেই ক্লাসের সময় পেরিয়ে যায়। ওর অারো কিছু সমস্যা রয়েছে। সে কথা বলার সময় তোতলায়, হাঁটাচলা করার সময় বারবার জিনিসপত্রের সাথে হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে যায়।
শুরুতে এগুলোকে মনোসংযোগের ঘাটতি এবং নির্বুদ্ধিতা অ্যাখ্যা দিয়ে উড়িয়ে দিলেও দিন দিন এই সমস্যাগুলো বেড়েই চললো। সেই সাথে যোগ হলো দাঁত না মাজা এবং জুতোর ফিতে বাঁধতে না পারার মতো সমস্যাগুলোও। বাবা-মা বুঝতে পারলেন, X এর এমন অাচরণ সাধারণ নির্বুদ্ধিতা বলে উড়িয়ে দেয়ার অার কোনো সুযোগ নেই। তারা পড়িমরি করে ছুটলেন এক শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে৷ খুলে বললেন সব কথা। সবকিছু শুনে আর কিছু পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, X অাসলে ডিসপ্রেক্সিয়ায় ভুগছে।
ডিসপ্রেক্সিয়া কী?
‘Dyspraxia’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ‘Praxis’ থেকে, যার অর্থ হলো কিছু করা বা সম্পাদন করা। অন্যদিকে ‘dis’ শব্দটির অর্থ হলো অক্ষমতা। অর্থাৎ ‘Dyspraxia’ শব্দের অর্থ হলো কোনোকিছু করার অক্ষমতা।
ডিসপ্রেক্সিয়া শিশুদের সূক্ষ্ম অথবা স্থূল কার্যবিষয়ক অঙ্গ সঞ্চালন ব্যবস্থার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। ডিসপ্রেক্সিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের দাঁত মাজতে, জুতোর ফিতে বাঁধতে, হাতে কোনো বস্তু ধরে থাকতে, কোনো জিনিস সরাতে অথবা গোছাতে বা একই ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকতেও অসুবিধে হয়। ডিসপ্রেক্সিয়ায় আক্রান্ত শিশুর এমন সব সূক্ষ্ম বা স্থূল কাজ করতে অসুবিধে হয়, যাতে হাতের বা পায়ের মাংসপেশির সমন্বয় অনিবার্য।
বেশিরভাগ ডিসপ্রেক্সিয়ায় আক্রান্ত শিশুর মধ্যে ডিসলেক্সিয়া, ডিসক্যাল্কুলিয়া বা অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডারের উপসর্গও থাকে।
ইতিহাস
ডিসপ্রেক্সিয়ার ইতিহাসটা খুব একটা পুরনো নয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে কলিয়ের এই রোগটিকে ‘কনজেনিটাল ম্যালাড্রয়েটনেস’ নামে অভিহিত করেন। তবে ১৯৩৭ সালে মার্কিন নিউরোসাইকিয়াট্রিস্ট অরটন গিলিংহ্যাম রোগটিকে সর্বপ্রথম সবার গোচরীভূত করেন এবং তাকেই অাবিষ্কর্তার সম্মান দেয়া হয়। তিনি একই রোগকে একটি উন্নয়নমূলক বৈকল্য হিসেবে চিহ্নিত করেন।
তবে রোগটির নাম তখনো অাবিষ্কার হয়নি। ১৯৭২ সালে জিন অাইরেস একে ‘ডিসঅর্ডার অফ সেন্সরি ইন্টিগ্রেশন’ নামে অভিহিত করেন। অার ১৯৭৫ সালে স্যাসন গুব্যে এর নাম দেন ‘ক্লামজি চাইল্ড সিনড্রোম’। ডিসপ্রেক্সিয়া শব্দটির প্রচলন হয় ১৯৮০ সালে।
ডিসপ্রেক্সিয়ার অারো কয়েকটি নাম অাছে। এগুলো হলো- Developmental Apraxia, Disorder of Attention and Motor Perception (DAMP), Motor Learning Difficulties, Perceptuo-motor Dysfunction, Sensorimotor Dysfunction.
কারণ
ডিসপ্রেক্সিয়া হওয়ার সঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি। পর্যবেক্ষণ করে দেখা গিয়েছে যে, স্নায়ুকোষের কোনো এক অজ্ঞাত সমস্যার কারণে মস্তিষ্ক মাংসপেশিগুলোকে সমন্বয় সম্বন্ধিত সঠিক সংকেত পাঠাতে পারে না।
তবে কিছু কিছু নিয়ামক ডিসপ্রেক্সিয়াকে ত্বরান্বিত করে থাকে। এগুলো হলো-
১. নিউরনের বিকাশে ঘাটতি: বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, জিনগত বা অপুষ্টিজনিত কারণে মস্তিষ্কের নিউরনগুলোর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে ডিসপ্রেক্সিয়া দেখা দেয়।
২. বংশগতি: বাবা বা মায়ের এই সমস্যাটি থাকলে সন্তানের ডিসপ্রেক্সিয়া হওয়ার অাশংকা বৃদ্ধি পায়।
৩. পজিটিভ ফ্যামিলি হিস্ট্রি: পরিবারের কোনো সদস্যের ডিসপ্রেক্সিয়া থেকে থাকলে ডিসপ্রেক্সিয়া হওয়ার অাশংকা বৃদ্ধি পায়।
উপসর্গ
১. স্থূল কার্যবিষয়ক অঙ্গসঞ্চালন ক্ষমতা (Gross Motor Skills) সংক্রান্ত উপসর্গ
• কোনো বস্তুকে হাত দিয়ে অাঁকড়ে ধরে থাকতে অসুবিধা বোধ করা।
• খেলাধুলা বা ব্যায়াম করার সময় শারীরিক ভারসাম্য বজায় রাখতে না পারা।
• বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ড, যেমন- হাঁটা, লাফানো, বল ছোঁড়া বা ধরা, সাইকেল চালানো ইত্যাদিতে অসুবিধা হওয়া।
• হাঁটাচলা করার সময় বারবার জিনিসপত্রের সাথে হোঁচট খেয়ে পড়া বা এমনভাবে বারবার ধাক্কা খাওয়া, যাতে জিনিসগুলো উল্টে পড়ে যায়।
• চোখ আর হাতের ভালো সমন্বয় প্রয়োজন এমন খেলায় বা কাজে (যেমন: ক্যারাম, তীরন্দাজী) অংশগ্রহণ করতে অসুবিধা হওয়া।
২. সূক্ষ্ম কার্যবিষয়ক অঙ্গ সঞ্চালন ক্ষমতা (Fine Motor Skills) সংক্রান্ত উপসর্গ
• বোতাম লাগানো, আঙুল দিয়ে পেন্সিল ধরা বা কাঁচি দিয়ে কিছু কাটার মতন এমন সব কাজ, যার জন্য উন্নতমানের সূক্ষ্ম কার্যবিষয়ক অঙ্গ সঞ্চালন ক্ষমতা প্রয়োজন, সেগুলো করতে না পারা।
• ছোট বস্তু, যেমন খেলনা ঘর বানানোর টুকরো বা জিগস পাজলের ছোট ছোট অংশ, নিয়ে কাজ করতে অসুবিধা বোধ করা।
৩. বাকশক্তি (Verbal) সংক্রান্ত উপসর্গ
• কণ্ঠস্বর পরিবর্তন হয়ে যাওয়া।
• কণ্ঠের অস্বাভাবিক রকমের উচু কিংবা নিচু হয়ে যাওয়া।
• কথা বলার গতি পরিবর্তন হয়ে যাওয়া।
• স্পষ্ট উচ্চারণ করে স্বাভাবিক গতিতে কথা বলতে না পারা।
• খুব ধীর গতিতে কথা বলা।
• কথা বলার সময় তোতলানো।
৪. যোগাযোগ (Communication) সংক্রান্ত উপসর্গ
• কাজকর্মে দক্ষতা হ্রাস পাওয়া।
• কথাবার্তা বলার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দেয়া।
• দলভিত্তিক ক্রীড়ায় অংশগ্রহণে অস্বস্তি বোধ করা।
• দৈনন্দিন জীবনে পরিপার্শ্বের সাথে যোগাযোগ করতে অস্বস্তি লাগা।
৫. স্মৃতিশক্তি এবং একাগ্রতা (Memory and Attention) সংক্রান্ত উপসর্গ:
• স্কুলে এবং বাড়িতে বিভিন্ন কাজের ধারাবাহিকতা মনে রাখতে এবং সঠিকভাবে করতে না পারা। যেমন স্কুলের বইপত্র গুছিয়ে ব্যাগে রাখা, গৃহকার্য সম্পন্ন করা, টিফিন নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
• শূন্যস্থানের আপেক্ষিকতা সম্পর্কে ধারণার অস্পষ্টতা।
• সঠিকভাবে কোনো বস্তুকে শূন্যস্থানে রাখতে বা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে সরাতে অসুবিধা বোধ।
রোগ নির্ণয়
কোনো পরীক্ষার মাধ্যমে ডিসপ্রেক্সিয়া হয়েছে কি না বলা সম্ভব না। অকুপেশনাল থেরাপিস্টের মতো কোনো বিশেষজ্ঞ পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে নির্ধারণ করতে পারেন যে ডিসপ্রেক্সিয়া হয়েছে কি না।
বিশেষজ্ঞ নিম্নলিখিত সংকেতগুলোর ভিত্তিতে রোগ নির্ধারণ করেন –
• কার্যবিষয়ক অঙ্গ সঞ্চালন ক্ষমতার বিকাশে বিলম্ব।
• কার্যবিষয়ক অঙ্গ সঞ্চালন ক্ষমতার দুর্বলতা (যা সেরেব্রাল পালসির মতো অন্য কোনো স্নায়বিক ব্যাধির কারণে নয়)
চিকিৎসা
অকুপেশনাল থেরাপি: এর সাহায্যে বিভিন্ন উদ্দেশ্যমূলক কাজ, শারীরিক ব্যায়াম, বিশেষ সহায়ক সামগ্রীর ব্যবহার, নৈপুণ্য প্রশিক্ষণ, রোগীর পারিপার্শ্বিক অবস্থার উন্নয়ন এবং বিকল্প কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে রোগীকে দৈনন্দিন কাজে সর্বাধিক স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করে।
স্পিচ থেরাপি: এটি হচ্ছে বিশেষ একধরনের চিকিৎসাব্যবস্থা, যার সাহায্যে কথা বলতে অক্ষম অথবা স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে না, এমন রোগীদের চিকিৎসা করা হয়। ডিসপ্রেক্সিয়ার কারণে যারা স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে না, তাদের প্রাণ খুলে কথা বলার সুযোগ এনে দেয় স্পিচ থেরাপি। স্পিচ থেরাপিস্টরা ডিসপ্রেক্সিক শিশুদের কিছু কায়দা-কানুন শিখিয়ে দেন ও চর্চা করিয়ে থাকেন।
পারসেপচুয়াল মোটর ট্রেনিং: এটি অক্যুপেশনাল বা ফিজিক্যাল থেরাপিস্টরা করে থাকেন। অাক্রান্ত শিশুর ভাষাগত দক্ষতা, দৃষ্টি, শ্রবণ, অনুধাবন ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে এই প্রশিক্ষণের দরকার হয়।
করণীয়
• অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্ট বা শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে দেখা করে তাদের পরামর্শ নেওয়া।
• ডিসপ্রেক্সিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের নিজের চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি বা সমস্যা ব্যক্ত করতে অসুবিধা হতে পারে। তাই অভিভাবকের করণীয় হলো শিশুর সাথে আলোচনার মাধ্যমে নিজের সমস্যা ব্যক্ত করার জন্য উৎসাহিত করা।
• শিশুটিকে সহজ কাজকর্মের মাধ্যমে শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকার জন্য উৎসাহিত করা। এতে তার আত্মবিশ্বাস বাড়বে।