অ্যালবামের পাতা উল্টে দুই তিন বছর বয়সের অনেক ছবি সামনে আসে। শিশু বয়সে আপনার বাগানে খেলাধুলার দৃশ্য, কিংবা জন্মের পর আপনার বয়স এক বছর পূর্তির পর বাসায় আয়োজন করা জন্মদিনের অনুষ্ঠান ইত্যাদি। সমস্যা হলো, এগুলোর কোন কিছুই আপনার স্মৃতিতে নেই, না থাকাই স্বাভাবিক। কারণ তিন বছর বয়সের আগে যে মানুষের স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষমতা জন্মায় না, সেটা সবারই জানা।
সেটা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু গত বছরের সব ঘটনা কি আপনার মনে আছে? নিশ্চই সব কিছুই মনে দাগ কেটে স্মৃতিতে স্থায়ী হয়ে বসে থাকে না। কিন্তু কেন থাকে না? আর যেগুলো মনে থাকে, সবটাই যে মনে দাগ কেটেছে বলে মনে আছে তা-ও তো না। বরং অপ্রয়োজনীয় নানা কিছুও তো আমাদের স্মৃতিতে থেকে যায়, মনে থাকে। তাহলে এই স্মৃতি সংরক্ষণ বা মনে থাকা না থাকার মূল ভিত্তিটা আসলে কী? বলাই বাহুল্য, এসব খুঁটিনাটি নিয়ে হয়েছে প্রচুর গবেষণা, যা আলোচনা করতে বসলে আলোচনা শুরু তো হবে কিন্তু শেষ করে ওঠা যাবে না।
সে যা-ই হোক না কেন, আপনি হয়তো ভাবছেন যে এত শত স্মৃতি মনে রাখা না রাখা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কী? এর চেয়ে বরং দরকারি তথ্য সব যদি ঠিকঠাক মাথায় থাকত, তবে কাজকর্মের সময় নানা ঝক্কি পোহাতে হতো না। নিরাশ হবেন না! খটমটে থিওরি বা তত্ত্বজ্ঞান আওড়ানোর জন্যে আজকের এই আলোচনা নয়, বরং বিজ্ঞানসম্মত কিছু কৌশলকে কাজে লাগিয়ে আপনার স্মৃতি শক্তিকে আরো কার্যকর করার কিছু বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করা যাক।
যখন নতুন কিছু মনে রাখার বা সোজা বাংলায় মুখস্থ করার চেষ্টা করছেন, সর্বজনস্বীকৃত পন্থা হলো বারবার সেটা আওড়াতে থাকা বা বারবার সেটা মাথায় আনার চেষ্টা করা। যে কারণে ছোটবেলায় মুখস্থ করার জন্যে আমরা কোনোকিছু বারবার পড়তে থাকতাম, বা পড়েই সাথে সাথে লিখে সেটা মাথায় গেঁথে নেয়ার চেষ্টা করতাম। নিঃসন্দেহে এটি কার্যকর পন্থা, অন্তত ছোটবেলা থেকেই তো এভাবেই চালিয়ে আসছি আমরা।
কিন্তু আপনি যেহেতু এখন আর শিশু নন, ফলে ঐ পন্থায় এখনো কোনো তথ্য মনে রাখতে যাওয়াটা হাস্যকর। তাহলে করণীয় কী? করণীয় হলো- কিছুই না করে দশ পনেরো মিনিট ধ্যান করা। ব্যাপারটা শুনে হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু অবশ্যই তা নয়। যেটা করুন, ঘরের আলো কমিয়ে দিন, ধীর স্থির হয়ে এক জায়গায় বসুন। এরপর দশ পনেরো মিনিট ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকুন। এরপর আপনি আবিষ্কার করবেন যে যে জিনিসটা কিছুক্ষণ আগে আপনি শিখলেন, সেটা এই ধ্যানে কাটানোর পরে আরো ভালোভাবে আপনার স্মৃতিতে এসে পৌঁছেছে।
এ কথা অবশ্য অনেক আগে থেকেই সবার জানা যে কোনো বিষয় মনে রাখতে গেলে ধীর-স্থিরভাবে সেটার প্রতি মনঃসংযোগ করতে হয়। সেইসাথে সাম্প্রতিক গবেষণা এটা বলতে চাইছে যে, যখন কোনো বিষয়ে আমরা মনঃসংযোগ করছি তখন Minimal interference বজায় রাখা বা আশেপাশে যতটা সম্ভব কম প্রতিবন্ধকতা রাখা। অর্থাৎ সেইসব কাজ এড়ানো যাতে আপনার মনোযোগ কমে যায়। ফলে যখন মনোযোগ দিতে চাচ্ছেন, তখন এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি বন্ধ করুন, ইমেইল চেক, ওয়েব ব্রাউজিং বা স্মার্টফোন ঘাঁটাঘাঁটি বন্ধ করুন। আপনাকে আপনার মস্তিষ্কে পুরোপুরি মনোযোগ দেয়ার সুযোগ করে দিতে হবে।
স্মৃতিশক্তি বাড়াতে কিছুই না করে চুপচাপ ধ্যান করাটাকে অনেকের কাছেই হয়তো ফাঁকিবাজি বলে মনে হবে। এ সম্পর্কিত গবেষণা কিন্তু বলছে ভিন্ন কথা। এ জাতীয় ধ্যানে আপনার মনে রাখার ক্ষমতা তো বাড়বেই, উপরন্তু ব্যক্তির যদি অ্যামনেশিয়া বা ডিমেনশিয়া জাতীয় রোগ থেকে থাকে, তবে সেটারও উন্নতি সাধন হবে।
মস্তিষ্ককে বিশ্রাম প্রদান করে স্মৃতিশক্তি বর্ধনের এই পদ্ধতি প্রথম যাদের বয়ানে পাওয়া যায়, তারা হলেন জার্মান মনস্তত্ত্ববিদ ইলিয়াস মুলার ও তার ছাত্র আলফোনস পিলজেকার। ১৯০০ সালে এক গবেষণায় তারা যেটা করেন, তা হলো কিছু স্বেচ্ছাসেবকদেরকে কিছু অপ্রাসঙ্গিক নানা রকম তথ্যাদি পড়ে মুখস্থ করতে দিলেন। এরপর তাদেরকে দুটো দলে ভাগ করে ফেললেন। একটা দলকে কোনো বিশ্রাম না দিয়ে সাথে সাথেই আরো কিছু পড়াশোনা চাপিয়ে দেয়া হলো। আরেকটি দলকে ৬ মিনিটের বিশ্রাম দেয়ার পরে বাকি পড়াশোনা করতে বলা হলো।
এরপরে আধঘণ্টা পরে দুই দলকে যখন পরীক্ষার সম্মুখীন করা হলো, দেখা গেলো যে যাদেরকে বিশ্রাম দেয়া হয়েছিলো, তারা যা মুখস্থ করেছিলো তার প্রায় ৫০% মনে রাখতে পেরেছে, অথচ যাদের বিশ্রাম দেয়া হয়নি তারা মোটে ২৮% তথ্য মনে রাখতে পেরেছে। এতে এটাই প্রমাণিত হয় যে কোনো তথ্য আমাদের মগজে ঢোকার সাথে সাথেই তা জেঁকে বসে না, তার জন্যে একটু সময় দেয়া প্রয়োজন।
এই নিতান্তই ঝামেলাবিহীন চেষ্টাতেই আপনার স্মৃতিশক্তি আরো ক্ষুরধার হয়ে উঠবে, তা বোধহয় বিশ্বাস হতে চাইছে না, আসলে বিশ্বাস না হতে চাওয়াই স্বাভাবিক। কারণ আমরা সব সময় ধরেই নিই যে সমস্যার সমাধান সব সময় জটিল কঠিন কিছুর মাধ্যমেই হয়।
এই তত্ত্বের সমর্থনে এবার সমসাময়িক জমানার গবেষণার ফলাফল জানা যাক। ২০০০ সালে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সেরগিও ডেলা সালা তার গবেষণায় একটি যুগান্তকারী ফলাফল পান। তিনিও একই ধাঁচের একটি পরীক্ষা করেন। কিন্তু তার স্বেচ্ছাসেবকরা সবাই ছিলো স্নায়বিক সমস্যার রোগী, যেমন- স্ট্রোকের রোগী। এই গবেষক মুলার ও পিলজেকারের গবেষণার ধরনের উপর ভিত্তি করে রোগীদেরকে নানা তথ্য পড়তে দিলেন। কিছু রোগীকে বিশ্রাম ছাড়াই নানা কাজে ব্যস্ত রাখা হলো, কিন্তু রোগীকে একটা অন্ধকার ঘরে শুয়ে বিশ্রামে পাঠানো হলো।
এ পরীক্ষার ফলাফল ছিলো পুরো চিকিৎসক সমাজের জন্যে যুগান্তকারী। এটা মাথায় রাখতে হবে যে অংশগ্রহণকারীদের সবাই ছিলো মস্তিষ্কের সমস্যার রোগী। যাদের বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিলো তাদের অনেকেই প্রায় ১৪% থেকে ৪৯% এর মতো তথ্য মনে রাখতে সমর্থ হয়েছে। গবেষকের ভাষায় বিশ্রাম পাওয়া রোগীদের তথ্য মনে রাখার ক্ষমতা প্রায় স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের সমতুল্য বলেই মনে হয়েছে।
ফলাফলে উৎসাহ পেয়ে সেরগিও ডেলা আরো একটি পরীক্ষা করেন এসব রোগীদের নিয়ে। তিনি তাদের কিছু গল্প শোনান এবং গল্প শেষে সাথে সাথেই কিছু প্রশ্ন করেন। সবাই গড়ে ৭% এর মতো ঘটনা মনে রাখতে পেরেছেন। এরপর তাদেরকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম দিয়ে আবার যখন বসা হলো, তখন তারা গল্পের প্রায় ৭৮% মনে করতে পেরেছেন! অর্থাৎ গল্প শোনার পর কিছুক্ষণের বিশ্রাম তাদের মনে রাখার ক্ষমতাকে প্রায় ১১ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
এখানে একটা বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন, তা হলো কিছু পড়া বা জানার পরে ১০ বা ১৫ মিনিট ধ্যান বলতে মূলত মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেয়াকে বোঝানো হচ্ছে। নীরব কোনো জায়গা বেছে নেয়ার মাধ্যমে পত্র-পত্রিকা, কম্পিউটার-স্মার্ট ফোনের মতো বিষয়গুলো সরিয়ে ফেলা। এরপর স্বাভাবিকভাবে বিশ্রাম নেয়া, বিশ্রামকালে আপনার মস্তিষ্ক স্বতঃস্ফূর্তভাবে যা আপনার ভাবনায় আনে আনুক। আপনি যদি জোরপূর্বক অন্য কোনো চিন্তায় ডুব দেন, তাতে আবার সমস্যা। কারণ আরেক গবেষণায় দেখা গেছে এই বিশ্রামকালে যখন গবেষকরা স্বেচ্ছাসেবকদেরকে অতীত বা ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে বলেছেন, এরপরই বিশ্রাম শেষে মূল তথ্য জিজ্ঞাসা করলে তারা খারাপ পারফর্মেন্স দেখিয়েছেন।
এ কথাও বলা প্রয়োজন যে আসলেই এই বিশ্রাম গ্রহণের পন্থাটা কেমন হওয়া উচিত, তা পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে পড়াশোনার পরে এই ১০/১৫ মিনিটের বিশ্রাম যে স্মৃতিকে শক্তিশালী করণে ভূমিকা রেখেছে, তাতে তাদের কোন সন্দেহ নেই। বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের উপর এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে তাদের পড়াশোনায় প্রায় ১০-৩০% উন্নতিও তারা লক্ষ করেছেন। সুতরাং খুব সহজেই প্রয়োগসাধ্য এই পদ্ধতি গ্রহণেনিশ্চয়ই কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।
ফিচার ইমেজ- Getty images