প্রতি মাসেই একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে দেহ থেকে রক্তের সাথে জরায়ুর কিছু অংশ (এন্ডোমেট্রিয়াল স্তর) বেরিয়ে যাওয়া- এটি একজন সুস্থ স্বাভাবিক নারীর জীবনে অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা, যাকে পিরিয়ড বলে জানি আমরা। প্রতি মাসেই সেই রক্তক্ষরণ, পেটে ব্যথা, মুড সুইং- সব ক’টাই নারী জীবনের নিয়মিত অংশ হয়ে দাঁড়িয়ে যায় দ্রুতই। কিন্তু সেই নিয়মিত হয়ে যাওয়া অংশটায় যতটা ভালো থাকার কথা, বাংলাদেশের অনেক নারীই তার সিকিভাগও থাকেন না, কিংবা বলা ভালো, থাকতে পারেন না।
অনেক জায়গাতেই দেখা যায়, সোশ্যাল ট্যাবু আর কুসংস্কারের জালে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা সমাজে পিরিয়ড বা মাসিক একটি নিষিদ্ধ শব্দ, যা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলেই জাত চলে যাওয়ার মতো পাপ হবে। এই নিষেধের চক্করে পড়ে এখনও দেশের কিশোরী বা তরুণীদের একটা বিরাট অংশ পিরিয়ড নিয়ে অনেকাংশে অজ্ঞ। ২০১৪ সালের ইউনিসেফ জরিপের ফলাফলে তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ৩৬ শতাংশ কিশোরী প্রথমবার পিরিয়ড হওয়ার আগে জানতোই না এই বিষয়ে!
ভোগান্তির কিন্তু এখানেই শেষ না। কুসংস্কারের সাথে এরপর যুক্ত হয় হেনস্তা করে মজা নেওয়ার বিকৃত মনোভাব। ফার্মেসিতে গিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনলে জোটে দোকানদারদের ভ্রকুটি, আশেপাশের মানুষজনের বাঁকা হাসি আর অশ্লীল সব মন্তব্য ছোঁড়ার প্রতিযোগিতা। শুধু বাইরেই না, নারীরা ঘরেও রেহাই পান না এই অসুস্থ ব্যবহার থেকে। ‘অপবিত্রতা’র দোহাই দিয়ে অনেক সমাজেই মাসিকের সময়ে মেয়েদের থাকতে হয় আলাদা জায়গায়, এমনকি পরিবারের সাথে খাওয়াদাওয়ার সুযোগও বন্ধ হয়ে যায়। সেই সাথে অবহেলা আর তথাকথিত ‘লোকলজ্জা’য় অনেকে তো স্যানিটারি প্যাডের মতো জরুরি জিনিসটাও হাতে পান না। পিরিয়ডের সময় ব্যবহার করতে হয় কাপড়ের টুকরা, যা ভয়াবহ অস্বাস্থ্যকর। আর ফেসবুকের যুগে রমজান মাসে ‘রোজা কেন রাখোনি?’ অথবা ‘সবগুলো রোজা রেখেছো এবার?’ ধরনের ম্যাসেজ দিয়ে সাইবার বুলিয়িং তো আছেই। সব মিলিয়ে এদেশে পিরিয়ড নিয়ে যে অসহনীয় শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় একজন নারীকে, তা অকল্পনীয় বললেও কম বলা হয়।
তবে আশার কথা, মুদ্রার উল্টো পিঠের দৃশ্যটাও এখন দেখা যাচ্ছে আমাদের সমাজে। শিক্ষা আর সচেতনতার যে প্রভাব দেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত, তার ধারাবাহিকতায় এখন পিরিয়ড ব্যাপারটা বেশ ধীরে হলেও নর্মালাইজড হচ্ছে। আগে যেখানে পিরিয়ড শব্দটাই ছিল একটা ট্যাবু, সেখানে এখন আলোচনা হচ্ছে এই বিষয়ে, সচেতন হচ্ছেন নারীরা। আর শুধু নারীরাই নন, পুরুষরাও জানছে এই বিষয়ে।
পিরিয়ড যে শুধুমাত্র নারীর জীবনের একটি অংশ নয়, পাশাপাশি পুরুষের জীবনেও যে এর একটি প্রভাব পড়ে, এবং পুরুষের যে এই সময়টাতে বিশেষ দায়িত্ব থাকে- এই বিষয়গুলোও বুঝতে শুরু করেছেন পুরুষরা। আগে দেখা যেতো, মেয়ের মাসিকের সময় শুধুমাত্র মা অথবা বোনই সামাল দিতেন বিষয়টা, হোক সেটা স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে আনা কিংবা আলাদা যত্ন নেওয়া। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এখন বাবারাও হয়ে উঠছে সচেতন। আগে যেখানে দেখা যেতো পরিবারের পুরুষ সদস্যরা পিরিয়ড সংক্রান্ত যেকোনো কিছুতেই ইচ্ছাকৃত উদাসীনতা বা অস্বস্তির একটা চিহ্ন দেখাতেন, অনেক পরিবারেই এখন সে জায়গায় এসেছে পরিবর্তন। দেখা যায় বাবা নিজে থেকেই খবর রাখছেন মেয়ের, মাসিকের সময় জিজ্ঞেস করছেন শারীরিক অবস্থার কথা। ভাই না চাইতেই নিজে থেকেই বোনকে এনে দিচ্ছে প্রয়োজনীয় স্যানিটারি ন্যাপকিন, স্বামী ক্যালেন্ডারে দাগিয়ে বা মোবাইল অ্যাপে রিমাইন্ডার দিয়ে মনে রাখছেন স্ত্রীর মাসিকচক্রের দিন তারিখ, নিচ্ছেন আলাদা যত্ন।
বিষয়টি যে শুধু পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তা নয়। পিরিয়ড নিয়ে পুরুষদের মধ্যে যে ট্যাবু সামাজিকভাবে দেখা যায়, তাও আস্তে আস্তে ভাঙছে। ছেলেরা এখন বান্ধবীদের অস্বস্তি দেখলে নিজেই প্রশ্ন করে পিরিয়ডের বিষয়ে, সেই প্রশ্নে বিকৃত মজার বদলে থাকে সহানুভূতি আর সহায়তার সুর। আগের মত কটুক্তি ছুড়ে দিয়ে বিকৃত আত্মতৃপ্তি পাওয়ার যে মানসিকতা, তা কমে আসছে একটু একটু করে। এখন পিরিয়ড নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় খোলাখুলি আলোচনা হচ্ছে, ফলে অনেক কিছু শিখতে পারছেন নারী পুরুষ উভয়েই, পিরিয়ড সংক্রান্ত স্বাস্থ্যঝুঁকিও কমছে উল্লেখযোগ্য হারে।
তবে ট্যাবু ভাঙা, কুসংস্কার দূর করা, মানুষকে সচেতন করা- এসব একদিনের কাজ নয়, কাজটি একা কারো পক্ষে করাটা সম্ভবও না। বিশেষত পিরিয়ড চলাকালীন স্যানিটারি ন্যাপকিনের বদলে কাপড়ের টুকরা বা তুলা ব্যবহারের কারণে যে বিরাট স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্ভাবনা থাকে- এই বিষয়টিই বোঝানো অনেক সময় সম্ভব হয় না সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে, বোঝালেও তাদের সামর্থ্য হয় না ন্যাপকিন ব্যবহারের। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে মাসিক চলাকালীন নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখার লক্ষ্যে এগিয়ে এসেছে সেনোরা। শুধু সাশ্রয়ী মূল্য ও প্রয়োজন অনুসারে স্যানিটারি ন্যাপকিন যোগান দিয়েই নয়, পিরিয়ড সংক্রান্ত ট্যাবু ও নীরবতা ভাঙার প্রয়াসের মাধ্যমে সেনোরা এগিয়ে এসেছে সচেতনতা বৃদ্ধিতেও। পিরিয়ড শুধু মেয়েদের বিষয় নয়, এসময় ছেলেদেরও এগিয়ে আসতে হবে, হতে হবে আরো বেশি সংবেদনশীল ও সহমর্মী- এমন বার্তা ছড়িয়েছে তারা। এই লক্ষ্যে বিশেষ স্কুল প্রোগ্রামের অধীনে সচেতনতা বৃদ্ধি, কাউন্সেলিং, ডাক্তারি পরামর্শসহ নানাবিধ পদক্ষেপের মাধ্যমে ২০২০ সালের মধ্যেই অন্তত ৬০ লাখ কিশোরী ও তরুণীদের কাছে সচেতনতার বার্তা নিয়ে পৌঁছে গিয়েছে সেনোরা।
তবুও, এখনও পর্যন্ত, বাংলাদেশের একটা বড় অংশের কাছে পিরিয়ড একটি সোশ্যাল ট্যাবু। এই অংশের কাছে পৌঁছাতে হবে, বোঝাতে হবে কীভাবে এই অযৌক্তিক ট্যাবুর কারণে ঘটতে পারে প্রাণহানি। আর এই পৌঁছানোর দায়িত্ব কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা শুধু সেনোরার মতো ব্র্যান্ডের একার নয়, এই দায়িত্ব আমার, আপনার, আমাদের সবার।