রিয়াজ সাহেব (কাল্পনিক নাম) কয়েকদিন ধরে মনোযোগ দিয়ে খবর দেখছেন। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে মাঙ্কিপক্স নামে কী এক অসুখ নিয়ে খুব মাতামাতি চলছে, তিনি বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারছেন না। গুটিবসন্ত/স্মলপক্স, জলবসন্ত/চিকেন পক্স ইত্যাদির নাম শুনেছেন। গল্প-উপন্যাসে গুটিবসন্তের প্রকোপে গ্রাম উজাড় হয়ে যাবার কথা পড়েছেন, স্কুলে পড়ার সময় ভুগেছেন জলবসন্তে। কিন্তু মাঙ্কিপক্স, মানে বানরবসন্ত? সে আবার কী?
মাত্রই করোনার আঘাত একটু একটু করে সামলে নিতে শুরু করছে বিশ্ব। এর মধ্যেই নতুন এই আপদ। রিয়াজ সাহেব একটু শঙ্কিত বটে। করোনার শুরুতে ব্যাপারটা পাত্তা দেননি তিনি, ফলাফল- পুরো পরিবার দুবারের মতো ভুগেছে। মাঙ্কিপক্সের সময় একই ভুল করতে চান না। সঠিক তথ্যের জন্য শরণাপন্ন হলেন এক ডাক্তার বন্ধুর। তিনি তাকে বিশদভাবে সব বুঝিয়ে বললেন। কী বলেছিলেন তিনি? চলুন, আমরাও জেনে আসি।
কী এই মাঙ্কিপক্স?
মাঙ্কিপক্সকে বলা হয় জুনোটিক রোগ (zoonotic diseases), যার মানে এই রোগটি পশুপাখির হয়। সেখানে থেকে মানুষে ছড়াতে পারে। নামের সাথে পক্স দেখে অনুমান করা যায়- আমাদের পরিচিত পক্স ভাইরাসের গোত্রীয় এটি। তবে গুটিবসন্তের সাথেই এর মিল বেশি।
প্রায় ৩-৪ হাজার বছর আগে থেকেই মানবদেহে রোগ সৃষ্টি করতে শুরু করে স্মলপক্স। তবে মাঙ্কিপক্সের ইতিহাস অত পুরনো নয়। একই গোত্রীয় হলেও এর রোগের প্রকোপও জ্ঞাতিভাইয়ের থেকে কম, ফলে মৃত্যুর ঘটনাও দুর্লভ।
গবেষণায় দেখা গেছে- স্মলপক্সের টিকা দিলে তা শতকরা ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রে মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধ বা রোগের মাত্রা কমিয়ে রাখতে পারে। ১৭৯৬ সালে এডওয়ার্ড জেনারের হাত ধরে ব্যাপকভাবে স্মলপক্স ভ্যাক্সিনেশনের যাত্রা আরম্ভ হয়, সেই ধারার সাফল্যে ১৯৮০ সালে এই রোগ নির্মূল হয়েছে বলে ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এরপর স্বাভাবিকভাবেই ভ্যাক্সিনেশনের হার দ্রুত কমে যায়।
১৯৮০ সালে স্মলপক্স ভ্যাক্সিনেশনের হার ছিল ৮০%, আজকের দিনে সেই হিসেব গিয়ে ঠেকেছে ৩০% বা এর কমে। অনেক দেশে তো যুবক বয়সের জনসংখ্যার ৮০% স্মলপক্সের টিকা পায় না বা নেয় না। এরা কিন্তু মাঙ্কিপক্সের ঝুঁকিতে থাকে।
ঠিক এই কারণে গবেষকরা ধারণা করেন- স্মলপক্স চলে যাবার ফলে যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে, মাঙ্কিপক্স কোনো না কোনো সময় তা দখল করে বসতে পারে। তবে রোগ হিসেবে স্মলপক্সের মতো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার ক্ষমতা এখনও তার নেই, যদি না তেমন কোনো মিউটেশনের ঘটনা ঘটে।
মাঙ্কিপক্সের উৎপত্তি
কিন্তু মাঙ্কিপক্স কেন? বানর থেকে রোগ ছড়ায় বলে? নাকি শুধু বানরের হয় বলে? সত্যি কথা হচ্ছে- এমন কিছু নয়, কারণ আজও বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন ঠিক কোন পশু মাঙ্কিপক্সের জীবাণুর উৎস, আর কোন প্রক্রিয়াতেই বা তা সংক্রমিত হয়।
তাহলে মাঙ্কিপক্স নামটি এলো কোথা থেকে? ১৯৫৮ সালে প্রথম এই রোগ আবিষ্কৃত হয় ডেনমার্কে, সিঙ্গাপুর থেকে আনা ম্যাকাও প্রজাতির বানরের মধ্যে। গবেষণার জন্য এই ম্যাকাওগুলো আনা হয়েছিল। বানরে প্রথম দেখতে পাওয়ায় এর নাম হয়ে যায় মাঙ্কিপক্স।
মানব মাঙ্কিপক্সের সন্ধান মেলে প্রায় একযুগ পরে, তৎকালীন জায়ারের (বর্তমান ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো) বুকেন্দা গ্রামে। নয় বছর বয়সী এক শিশুর মাঝে অনেকটা গুটিবসন্তের মতো লক্ষণ নিয়ে মাথা জাগায় মাঙ্কিপক্স। তখন স্মলপক্সের হার সবে কমতে শুরু করেছে। পরবর্তীকালে জায়ারে সেই অভাব পূরণ করে মাঙ্কিপক্স। এখন তো সেখানে এটি সাধারণ এক রোগে পরিণত হয়েছে।
জায়ার থেকেই আফ্রিকার অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে এই রোগ। ২০১৭ সালে নাইজেরিয়াতে বড় আকারে মাঙ্কিপক্সের প্রকোপ দেখা দেয়। পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রথম এর আবির্ভাব ঘটে ২০০৩ সালে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসকেরা এই অসুখ দেখতে পান। উৎস হিসেবে চিহ্নিত হয় পোষা প্রাণী হিসেবে বিক্রির জন্য ঘানা থেকে আনা রোডেন্ট জাতীয় একদল প্রাণী। এদের থেকে কুকুর, এবং কুকুর হয়ে মানুষে ছড়ায় মাঙ্কিপক্স।
নিশ্চিত ও সন্দেহভাজন মিলিয়ে ৪৭ জন রোগী সনাক্ত হয়। তবে কেউই মারা যাননি। তাদের সংস্পর্শে আসা সবাইকে স্মলপক্সের ভ্যাক্সিন নিতে অনুরোধ করে কর্তৃপক্ষ।
যুক্তরাজ্যে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে নাইজেরিয়া থেকে আসা দুজন যাত্রীর মাঝে মাঙ্কিপক্সের জীবাণু পাওয়া যায়। একই বছর ইসরায়েল, আর পরের বছর সিঙ্গাপুরে নাইজেরিয়া থেকে আসা লোকদের দেহে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়।
বর্তমান পরিস্থিতি
২০২২ সালে পশ্চিমা দেশগুলোতে নতুন করে শুরু হয়েছে মাঙ্কিপক্সের উপদ্রব। ৭ মে নাইজেরিয়া থেকে আগত পর্যটকের দেহে নির্ণীত হয় মাঙ্কিপক্স। ১৪ মে যুক্তরাজ্যের একটি স্বাস্থ্য সংস্থা (UK Health Security Agency) আরো দুজন রোগীর তথ্য জানায়। তবে এই দুজন যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী, এবং সম্প্রতি আফ্রিকা ভ্রমণের কোনো ইতিহাস তাদের নেই। এমনকি মাঙ্কিপক্সের কোনো রোগীর সাথে তাদের সাক্ষাতের তথ্যও পাওয়া যায় না।
সেই থেকে এই আর্টিকেল লেখা পর্যন্ত (২২ মে ২০২২; রাত ১১টা) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে অনুযায়ী ১৩টি দেশে ৯২ জন রোগীর মাঙ্কিপক্স নিশ্চিত হয়েছে। ২৮টি কেস পরীক্ষাধীন। আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে আছে অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, স্পেন, সুইডেন, যুক্তরাজ্য, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র।
মাঙ্কিপক্স তো আফ্রিকাতে ব্যাপক আকারেই আছে, তারপরও বিজ্ঞানীরা শঙ্কিত কেন? মূল কারণ আফ্রিকার বাইরে এভাবে রোগ ছড়ানো আগে দেখা যায়নি। অতীতে যেসব রোগী পাওয়া গেছে, সবক্ষেত্রেই তারা আফ্রিকা থেকে রোগ বয়ে এনেছিলেন। কিন্তু বর্তমানের কেসগুলোতে আফ্রিকা ভ্রমণের ইতিহাস নেই। ফলে ঠিক কীভাবে মাঙ্কিপক্স তাদের মাঝে এলো তার উত্তর এখনও অজানা।
কানাডার ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরাল প্যাথোজেনেসিস এবং মাঙ্কিপক্স বিশেষজ্ঞ জ্যাসন কিন্দ্রাচুকের মতে, এখন যা হচ্ছে তা অভূতপূর্ব। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে রিপোর্ট আসছে, কিন্তু রোগতত্ত্বের বিচারে এমন কোনো সার্বজনীন ফ্যাক্টর পাওয়া যাচ্ছে না যার সাহায্যে বলা যেতে পারে যে এই কারণে এসব জায়গায় মাঙ্কিপক্সের বিস্তার ঘটছে।
কোনো মিউটেশন কি দায়ী হতে পারে? বলা কঠিন, কারণ গবেষণা চলমান। এখন অবধি পাওয়া তথ্য অবশ্য তেমন কিছু নির্দেশ করে না। হার্ভার্ড টি এইচ চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথের রোগতত্ত্ববিদ উইলিয়াম হ্যানাজের (William Hanage) ভাষায়- ২০১৮ সালে পশ্চিম আফ্রিকাতে যে মাঙ্কিপক্স জীবাণুর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গিয়েছিল, পশ্চিমা দেশগুলো সেই জীবাণুরই মুখোমুখি। তবে জিনগত ভিন্নতা আছে কিনা তা বিশ্লেষণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না।
সংক্রমণ
ধারণা করা হয়- রক্ত, পুঁজ, লালা ইত্যাদির সাথে সরাসরি সংস্পর্শ পশুপাখির মধ্যে মাঙ্কিপক্স বিস্তারের অন্যতম কারণ। ইঁদুর, বানর, নানা প্রজাতির রোডেন্ট এদের মাঝেই এই রোগ বেশি দেখা যায়। তবে নির্দিষ্ট কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পশু থেকে মানুষে মাঙ্কিপক্স বিস্তৃত হয় তা নির্ণীত হয়নি এখনও। মানুষের মধ্যে কাশি-কফ, পুঁজ, রক্ত ইত্যাদির মাধ্যমে মাঙ্কিপক্স ছড়ায় বলে প্রমাণ মেলে।
বর্তমানে মাঙ্কিপক্সের যে প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে, তার অন্যতম একটি দিক হলো মানুষ থেকে মানুষে দ্রুত এই জীবাণু সংক্রমিত হচ্ছে। উইলিয়াম হ্যানাজের মতে- এটি দুর্লভ, কারণ আফ্রিকার বাইরে এমন ঘটনা দেখা যায়নি আগে।
রোগের লক্ষণ
মাঙ্কিপক্স জীবাণু মানবশরীরে প্রবেশের পর চুপচাপ থাকে ৫-২১ দিন পর্যন্ত (incubation period), এই সময় নিজেদের বংশবৃদ্ধি করে এরা। যখন রক্তে জীবাণুর মাত্রা নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছে, তখন আরম্ভ হয় নানা সমস্যা।
সাধারণত, জ্বর থেকে সূচনা হয় শারীরিক অসুস্থতার। পাশাপাশি দেখা দেয় মাথাব্যথা, ঘাড়ব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা, এবং লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া (গলা বা গাল ফুলে যেতে পারে)। জ্বরের ১-৩ দিন পর চামড়ায় উঠতে থাকে পক্সের ফুসকুড়ি। মুখ আর হাত-পায়ে বেশি হয় এই ফুসকুড়ি।
মাঙ্কিপক্স সাধারণত মারাত্মক কোনো রোগ নয়। ভোগায়, তবে ২-৪ সপ্তাহের মধ্যে শরীর ভাল হয়ে যায়। মৃত্যুর ঘটনা অত্যন্ত দুর্লভ, ১-১০% ক্ষেত্রে হতে পারে। তবে ছোট বাচ্চাদের ঝুঁকি একটু বেশি।
রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা
চিকিৎসক রোগী দেখে মাঙ্কিপক্স নির্ণয় করতে পারেন। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয়। ফুসকুড়ি থেকে রস অথবা অন্যান্য উপাদান নিয়ে জীবাণু চিহ্নিত করা সম্ভব।
চিকিৎসা বলতে বিশ্রাম, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, পর্যাপ্ত পানি পান, জ্বরের জন্য ওষুধ এগুলি। রোগীর দেহে অন্য কোনো ইনফেকশন শনাক্ত হলে তার চিকিৎসাও দিতে হবে। মাঙ্কিপক্স জীবাণুর জন্য কার্যকর হয় এমন কোনো অ্যান্টিবায়োটিক এখনও আবিষ্কৃত হয়নি, যদিও ইউরোপিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এজন্য টেকোভিরিম্যাট (tecovirimat) নামে একটি ওষুধের অনুমোদন দিয়েছে। স্মলপক্স টার্গেট করে এটি তৈরি করা হয়েছিল।
প্রতিরোধের থেকে প্রতিকার সবসময়েই উত্তম। স্মলপক্স ভ্যাক্সিনেশন পুনরায় প্রচলনের মাধ্যমে মাঙ্কিপক্স নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। রোগীর সংস্পর্শে আসা লোকদের জরুরি ভিত্তিতে এই টিকা দেয়া যেতে পারে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে যারা কাজ করেন তাদের ঝুঁকি বেশি, ফলে তাদেরকে প্রথমেই এই টিকার আওতায় আনা যায়। পাশাপাশি, তাদের জন্য ভালমানের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর (মাস্ক, গ্লাভস ইত্যাদি) ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।