একটি শিশুর জন্ম তার পরিবারের জন্য অবশ্যই অত্যন্ত আনন্দ এবং খুশির সংবাদ। হাসপাতালে বেঞ্জামিন বেঞ্জি স্টাসি নামের শিশুটি জন্মগ্রহণ করার পর তার পরিবারের মধ্যেও আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। কিন্তু বিশেষ একটি কারণে শিশুটির জন্মগ্রহণের সংবাদটি শহরে বেশ আলোড়নের সৃষ্টি করে। কারণ বেঞ্জি স্টাসি সম্পূর্ণ সুস্থ শরীরে জন্মগ্রহণ করলেও তার পুরো শরীরের রঙ ছিল নীল, অন্য সব মানুষের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন!
ছোট্ট বাচ্চাটির শরীরের এই বিচিত্র রঙ নিয়ে হাসপাতালের ডাক্তারেরা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাদের কাছে বিষয়টি খুবই বিচিত্র এবং নতুন। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে শিশু বেঞ্জিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে দ্রুত লেক্সিংটনে অপেক্ষাকৃত ভালো একটি হাসপাতালে হস্তান্তর করা হয়। শিশুটির শরীরের এই ভিন্ন রঙে নিয়ে হাজারো রকমের মেডিকেল পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হয়। পুরো সময়টা ধরে শিশু বেঞ্জির শারীরিক অবস্থার কোনো অবনতি বা পরিবর্তন হলো না। কোনো ধরনের শারীরিক সমস্যা খুঁজে না পেয়ে মা-বাবার অনুমতিসাপেক্ষে ঠিক করা হলো, শিশুটির শরীরের রক্ত পরিবর্তন করা হবে। অবশেষে বেঞ্জির বাবা সবাইকে বললেন, তার এক দাদির শরীরের রঙ ঠিক এমনই ‘নীল’ ছিল। তিনি মৃত্যু অবধি অন্য সব মানুষের মতোই সুস্থ এবং স্বাভাবিক ছিলেন।
কয়েক সপ্তাহ পার হওয়ার পর বেঞ্জির শরীরের প্রচণ্ড নীল রঙ আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে শুরু করলো। একপর্যায়ে পুরো শরীরের রঙ অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এলো। শুধুমাত্র নখ এবং ঠোঁটে নীল রঙের কিছুটা প্রভাব রইলো এবং পরবর্তীতে শুধুমাত্র প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় এই নীল রঙ নজরে পড়তো। শিশু বেঞ্জির বিষয়ে ডাক্তাররা সিদ্ধান্তে আসলেন যে, একটি ‘অদ্ভুত এবং দুষ্প্রাপ্য’ জিনের প্রভাবে তার শরীর এমন নীল হয়েছে। অ্যাপালাসিয়ান অঞ্চল থেকে এই বিচিত্র জিনের উদ্ভব। অতীতে এই জিনের প্রভাবে ঐ অঞ্চলের একটি পরিবারের কয়েক প্রজন্মের বেশ কিছু মানুষ নীল রঙের হয়েছিল।
মার্টিন ফুগেট: কেনটাকি অঞ্চলের ১ম নীল ত্বকের মানুষ
১৮২০ সাল। মার্টিন ফুগেট এবং তার স্ত্রী অ্যাপালাসিয়ান কেনটাকি’র ক্রিক অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন। ১ম সন্তান জ্যাকারিয়াহ সম্পূর্ণ নীল শরীর নিয়ে জন্মগ্রহণ করলে এই দম্পতি রীতিমতো ভয় পেয়ে যান। সুস্থ এবং স্বাভাবিক এই দম্পতি শরীরের রঙ নীল হওয়ার জন্য দায়ী এক বিচিত্র ধরনের জিনগত বৈশিষ্ট্য বহন করছিলেন। যদিও তাদের শরীরের রঙ নীল কিনা এই বিষয়ে কোনো তথ্যগত রেকর্ড পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে এই দম্পতি ৭ সন্তানের জন্ম দেন, যাদের মধ্যে ৪ জন দেহের রঙই ছিল নীল।
একই ধরনের জিনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে এই দম্পতির সন্তানদের ক্ষেত্রে অন্য রঙ নিয়ে জন্মগ্রহণ করার ২৫ শতাংশ সম্ভাবনা ছিল। যদি মার্টিন তার শরীরে ব্যতিক্রমধর্মী ২ প্রকারের জিন বহন করতেন, তবে এই সম্ভাবনা ছিল ৫০ শতাংশ। যেহেতু ৭ সন্তানের মধ্যে ৪ জন দেহই ছিল নীল। ধারণা করা হয়, মার্টিন তার শরীরে হয়তো ২ ধরনের ‘রেসিসিভ জিন’ বহন করছিলেন।
অ্যাপালাসিয়ান অঞ্চলটি প্রত্যন্ত এবং দুর্গম হবার কারণে এখানে সমগোত্রীয় বিয়ের বিষয়টি প্রচলিত ছিল। এই ফুগেট পরিবারের পরবর্তী কয়েকটি প্রজন্মের মধ্যে সমগোত্রীয় বিয়ে সম্পন্ন হলে তাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে নীল রঙের দৃষ্টান্ত দেখতে পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে তাদের সকলের মধ্যেই কমবেশি ‘রেসিসিভ জিনের’ অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
লুনা ফুগেট বেঞ্জির দূর সম্পর্কের দাদি হতেন। এই ভদ্রমহিলা আগে থেকেই আপাদমস্তক নীল রঙের কারণে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। শুধুমাত্র তার ঠোঁট কিছুটা কালো রঙের ছিল। বিচিত্র শারীরিক বৈশিষ্ট্যের হওয়া সত্ত্বেও লুনা ছিলেন সম্পূর্ণ সুস্থ এবং স্বাভাবিক একজন মানুষ। পরবর্তীতে লুনা ১৩ সন্তানের জন্ম দেন এবং তিনি প্রায় ৮৪ বছর জীবিত ছিলেন।
ফুগেট পরিবারের নীল ত্বক রহস্য
সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা এই পরিবারের খবর শুনে বেশ উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ১৯৬০ সালে মেডিসন ক্যাওইন নামের একজন হেমাটোলোজিস্ট ডাক্তার এই বিচিত্র পরিবারের সাথে দেখা করতে সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার উদ্দেশ্য ছিল, এই পরিবারের নীল রঙ্গের মানুষদের সাথে দেখা করে তাদের শরীরের স্বাভাবিক রঙ ফিরিয়ে আনার জন্য একটি প্রতিষেধক জাতীয় কিছু তৈরি করা।
ডাক্তার মেডিসন পাহাড়-পর্বত সংকীর্ণ এই অঞ্চলে অবশেষে পরিবারটির অস্তিত্ব খুঁজে পান। স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে তিনি দেখতে পান যে, নীল রঙের হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে ফুসফুস বা হৃৎপিণ্ডজনিত কোনো শারীরিক সমস্যা নেই। শুধুমাত্র নীল রঙ ব্যতীত তারা সম্পূর্ণ সুস্থ এবং স্বাভাবিক মানুষ। নানা পরীক্ষা- নিরীক্ষা শেষে মেডিসন এই পরিবারের সদস্যদের রক্তে নীল হিমোগ্লোবিনের কারণ খুঁজে পান। তিনি দেখতে পান–
মেথেমোগ্লোবিন প্রবাহের আধিক্যের কারণে এই মানুষগুলোর ক্ষেত্রে ‘মেথেমোগ্লোবিনেমিয়া’ নামের এক ধরনের শারীরবৃত্তীয় ঘটনার সৃষ্টি হয়। এই ‘মেথেমোগ্লোবিন প্রবাহ’ যদিও ঝুঁকির কোনো কারণ নয়, কিন্তু এই অতিরিক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক হিমোগ্লোবিনের রঙ নীলে পরিবর্তন করে দেয়।
মেথেমোগ্লোবিনেমিয়া’র কারণ হিসেবে মূলত ‘ড্যায়াফোরেজ’ নামক এক ধরনের এনজাইম দায়ী। এই এনজাইমের কারণেই হেমোগ্লোবিনের রঙ লাল হয়ে থাকে। ফুগেট পরিবারের কিছু সদস্যের শরীরে এই এনজাইম না থাকার কারণে তাদের শরীরে নীল রঙ প্রাধান্য পায়। মেডিসন তাদের এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। কিন্তু তখন তাদের শরীরের মেথেমোগ্লোবিনকে স্বাভাবিক হিমোগ্লোবিনে পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি।
অবশেষে সমস্যার সমাধান
মেথেমোগ্লোবিনকে স্বাভাবিক হিমোগ্লোবিনে পরিবর্তনের জন্য একটি বিশেষ পদ্ধতি উন্মোচিত হলো। পন্থাটি হচ্ছে- বিশেষ একটি ডাই ব্যবহার। ‘মেথিলিন ব্লু’ নামক ‘বিশেষ নীল ডাই’ এর ব্যবহার নীল রক্তকে লাল করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। পরবর্তীতে অন্য আরেকটি পন্থা পাওয়া গেল। এই পন্থাটি হচ্ছে- নীল রঙের মানুষের চিকিৎসায় এসকরবিক এসিডের ব্যবহার।
কিন্তু তখন প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই মানুষগুলোকে চিকিৎসায় আগ্রহী করাটা মোটেই কোনো সহজ বিষয় ছিল না। অবশেষে একটি পরিবার এগিয়ে এলো। তারা চাইছিল না যে, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এভাবে নীল রঙ নিয়ে পৃথিবীতে আসুক। ‘মেথিলিন ব্লু’ নামক বিশেষ নীল ডাই প্রয়োগে এক মিনিটের মধ্যেই তাদের শরীরে রাতারাতি এক পরিবর্তন পাওয়া গেল।
পরবর্তীতে ডঃ মেডিসন ঐ পরিবারের সবাইকে ‘মেথিলিন ব্লু’ উপাদানসমৃদ্ধ ওষুধ খেতে পরামর্শ দিলেন। ক্রমান্বয়ে তাদের শরীরের রঙে পরিবর্তন আসতে শুরু করলো। অনেকের মূত্রের সাথে নীল রঙ বেরিয়ে আসতে শুরু করলো। তারা ভাবলেন, হয়তো নীল রঙ তাদের শরীর থেকে মূত্রের সাথে বেরিয়ে যাচ্ছে। অ্যাপালাসিয়ান অঞ্চলটিতে সেই পরিবারের কেউ আজ আর বসবাস করে না। আজ তারা হয়তো মূল জনস্রোতের এক অংশ। আজ হয়তো তাদের পরবর্তী প্রজন্ম বিভিন্ন শহরে আধুনিক জীবনযাপন করছেন। তবে ব্যতিক্রমী নীল শরীর নিয়ে নয়, স্বাভাবিক শারীরিক রঙ নিয়ে।
পরিণত বেঞ্জি
শিশু বেঞ্জি আজ আর শিশু নয়। পূর্ব কেনটাকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি লাভ করে বেঞ্জি পরবর্তীতে বিয়ে করেন। তিনি এখন আলাস্কার ফেয়ারবাঙ্কে বসবাস করছেন। পরিচিত বন্ধু মহলের বাইরে অপরিচিত অনেকেই হরহামেশাই তাকে তার ঠোঁট এবং আঙ্গুলের নখের অদ্ভুত নীল রঙের কারণ জিজ্ঞাসা করেন। আর বেঞ্জামিন বেঞ্জি স্টাসিকে হয়তো হেসে হেসে তার নখ এবং ঠোঁটের নীল রঙের কারণ ব্যাখ্যা করতে হয়।
ফিচার ইমেজ – allthatinteresting.com