২০১৮ সালের জুনে, আমেরিকার বোস্টন শহরের একটি রেল স্টেশনে ৪৫ বছর বয়সী এক নারী দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন। ট্রেন থেকে নামার সময় তার পা ট্রেন আর প্ল্যাটফর্মের মাঝখানে আটকে যায়। এতে তার পায়ে মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং অস্থি বের হয়ে আসে। এ সময় তিনি প্রচণ্ড ব্যথায় কান্না করছিলেন। কিন্তু তার যে শুধু পায়ের ব্যথাতেই কান্না পাচ্ছিল, এমন নয়। আশেপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স ডাকার চেষ্টা করে। কিন্তু তখন ঐ নারী তাদের বাধা দেন। বলেন, অ্যাম্বুলেন্সের অনেক খরচ, যা তিনি বহন করতে পারবেন না।
প্রচণ্ড ব্যথার মাঝে তার এই আকুতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। প্রশ্ন ওঠে চিকিৎসা ব্যবস্থায় মাত্রাতিরিক্ত খরচ নিয়ে। নিউ ইয়র্ক টাইমস এ ঘটনা নিয়ে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালে যেখানে মাত্র ২৫ টাকা দিয়ে লেপারস্কোপিক সার্জারি করা সম্ভব, সেখানে এত উন্নত দেশ হওয়ার পরও তাদের চিকিৎসা ব্যয় আকাশছোঁয়া হওয়াটা অবাক করার মতোই। খোদ আমেরিকানরাই যে তাদের ব্যয় বহন করতে পারে না, উপরের ঘটনাটিই তার প্রমাণ। কেন এত ব্যয়বহুল, সেটা জেনে নেয়া যাক তাহলে।
স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থা
অন্যান্য দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থা আলাদা এবং জটিল। সেখানে স্বাস্থ্যখাতকে মানব কল্যাণের চেয়ে একটি মাল্টি বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হিসেবে দেখা হয়। আর এই ব্যবসাটি হয় তাদের বিভিন্ন স্বাস্থ্য বীমা থেকে। বীমা কোম্পানিগুলো চিকিৎসা ব্যয় কমানোর জন্য কাজ করে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে তিন ধরনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চালু আছে। এগুলো হচ্ছে- সরকারি বীমায় চিকিৎসা, বেসরকারি বীমায় চিকিৎসা এবং অল্প কিছু স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। সরকারি বীমার মধ্যে রয়েছে মূলত মেডিকেয়ার এবং মেডিকেইড নামক প্রতিষ্ঠান।
মেডিকেয়ার এবং মেডিকেইডের আগে যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থা ছিল না। তখন ব্লু ক্রস এবং ব্লু শিল্ড চিকিৎসার প্রয়োজনে বীমার ব্যবস্থা করে দিতো। কিন্তু তারা ছিলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। তারা চিকিৎসা ব্যয় কমানোর জন্য কাজ করতো না। তারা শুধুমাত্র জরুরি পরিস্থিতিতে আর্থিক সহায়তা দিতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকান চাকরিজীবীদের নিয়োগকর্তারা তাদের চিকিৎসার জন্য বীমার ব্যবস্থা করার সুযোগ করে দেন। তখন বীমা গ্রহণের পরিমাণ বাড়তে লাগলো। ১৯৪০ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে ১০% থেকে ৬০% আমেরিকান জনগণ স্বাস্থ্য বীমার অধীনে চলে আসে।
স্বাস্থ্য বীমার এই বিপুল চাহিদাই ব্যবসার সুযোগ করে দেয়। তাই তখন বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলো বীমা ব্যবসায় চলে আসে। ১৯৫১ সালে ‘অ্যাটনা এন্ড সিগনা’ কোম্পানিটি ছিল সবচেয়ে বড় বীমা কোম্পানি। ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট জনসন মেডিকেয়ার এবং মেডিকেইড- এই দুই স্বাস্থ্য বীমা প্রতিষ্ঠানের ঘোষণা দেন। মেডিকেয়ার কাজ করে ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়স্ক রোগীদের নিয়ে। অন্যদিকে মেডিকেইড কাজ করে দরিদ্র রোগীদের নিয়ে। বাকিদের বেসরকারি বীমা ব্যবস্থাতে চিকিৎসা নিতে হয়।
বর্তমানে আমেরিকার ৯০ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্য বীমায় চিকিৎসা নিয়ে থাকে। কারো যদি বীমা না থাকে, তবে সে খুব ধনী ব্যক্তি না হলে চিকিৎসা ব্যয় মেটানো কখনোই সম্ভব নয়। কারণ, যাদের বীমা আছে, তাদেরও চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। এসব বীমার কাজের ধরনও অনেক জটিল। কীভাবে তারা কাজ করে, সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক।
যেকোনো বীমায় কয়েকটি অংশ থাকে। এগুলো হচ্ছে- প্রিমিয়াম, ডিডাকটিবল, কোপেমেন্ট এবং কোইনস্যুরেন্স।
প্রিমিয়াম
বেসরকারি বীমাগুলোতে আপনাকে প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ জমা দিতে হয়। বীমাগুলো বিভিন্ন প্ল্যানের হয়। কোনোটিতে প্রিমিয়াম বেশি থাকে, কোনোটিতে কম। প্রিমিয়াম দেয়ার কারণে কিছু সেবা বিনামূল্যে পাওয়া যায়। যেমন- টিকা নেয়া, ডায়বেটিস চেকআপ, ব্রেস্ট স্ক্রিনিং ইত্যাদি।
ডিডাকটিবল
ডিডাকটিবল হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ, যা আপনাকে বীমার কাছ থেকে সাহায্য নেয়ার আগেই জমা দিতে হয়। যেমন- দুর্ঘটনায় আপনার পা ভেঙে যাওয়ায় আপনার অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। এখন যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, তার কিছু অংশ আপনাকে আগেই বীমা কোম্পানির কাছে দিতে হবে। আপনি দেয়ার পর বাকি অর্থের কিছু অংশ দেবে বীমা কোম্পানি। বীমা কোম্পানি আপনার জন্য খরচ করার আগেই আপনি যা দিলেন, তা হচ্ছে ডিডাকটিবল।
ডিডাকটিবল সাধারণত বিভিন্ন অঙ্কের হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে যেকোনো একটি বেছে নিতে হয়। সাধারণত প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ডিডাকটিবল হিসেবে দিতে হয়। ডিডাকটিবলের সাথে আবার প্রিমিয়ামের সম্পর্ক আছে। প্রিমিয়ামের পরিমাণ বেশি হলে ডিডাকটিবল কম হয়, আবার ডিডাকটিবল কম হলে প্রিমিয়াম বেশি হয়। সাধারণত যাদের দীর্ঘমেয়াদী রোগ থাকে, যেমন- ডায়াবেটিস; তারা প্রিমিয়ামে বেশি খরচ করেন। তখন তাদের ডিডাকটিবল কম হয়।
কোইনস্যুরেন্স
ডিডাকটিবলের অর্থ দেয়ার পর বাকি অংশ খরচ করবে বীমা। তবে তারা একা করবে না। এখান থেকেও আপনার কাছ থেকে কিছু নেবে। ডিডাকটিবল দেয়ার পর আপনার চিকিৎসার বাকি যে খরচ, তার কিছু শতাংশ আপনাকে দিতে হবে। এটি হচ্ছে কোইনস্যুরেন্স।
কোপেমেন্ট
ডিডাকটিবলের অর্থ দেয়ার পর কোইনস্যুরেন্স নিতে পারে। আবার কিছু ক্ষেত্রে শতাংশে হিসাব না করে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিতে পারে। একে বলা হয় কোপেমেন্ট। সাধারণত ডাক্তারের কাছে ভিজিটের অর্থ কোপেমেন্টে নেয়া হয়।
সুতরাং এটা খুব স্পষ্ট যে, স্বাস্থ্য বীমা খুবই জটিল একটি প্রক্রিয়া। আর বীমা করার পরও যে পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয়, সেটাও অনেক বেশি। বড় কোনো চিকিৎসার পর হাসপাতাল থেকে রোগীর কাছে অনেক লম্বা বিলের লিস্ট চলে আসে। আর এই বিল শোধ করাই অনেকের জন্য হয়ে ওঠে দুঃস্বপ্ন।
চিকিৎসা সেবা ব্যয়বহুল হওয়ার কারণ
২০১৮ সালের মার্চে ‘জার্নাল অব দ্য আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন’ একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। হার্ভার্ড টি এইচ চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথ, দ্য হার্ভার্ড গ্লোবাল হেলথ ইনস্টিটিউট এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস ২০১৩-১৬ সালের আন্তর্জাতিক ডাটার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আরো দশটি উন্নত দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার তুলনা করে। এতে দেখা যায়, অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসা খাতে ব্যয় অনেক বেশি, চিকিৎসার ফলাফল অন্যদের তুলনায় খারাপ এবং তাদের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের চিকিৎসা নেয়ার পরিমাণ কম। গবেষণা থেকে ব্যয়বহুল চিকিৎসার কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া যায়।
গবেষণায় উঠে এসেছে, যুক্তরাষ্ট্রে হাসপাতালগুলোর প্রশাসনিক খাতে যে খরচ হয়, তা চিকিৎসা খাতের মোট ব্যয়ের ৮%। অন্যান্য দেশগুলোতে যা ১-৩% এর বেশি নয়। প্রশাসনিক ব্যয়ের কারণ ভিন্নরকম বীমার ব্যবস্থা। মেডিকেয়ার, মেডিকেইড ছাড়াও বিভিন্ন বীমার জন্য বিভিন্ন রকম প্রক্রিয়া থাকে। তাই হাসপাতালকে রোগীদের বিল তৈরির কাজও করতে হয় ভিন্নভাবে। এতে ডাক্তার বা হাসপাতালকে চিকিৎসার চেয়ে প্রশাসনিক কাজেই সময় বেশি দিতে দেখা যায়।
ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত দামও চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ার কারণ। আমেরিকায় ফার্মাসিউটিকেলসের পেছনে মাথাপিছু ব্যয় ১,৪৪৩ মার্কিন ডলার। সেখানে অন্যান্য দেশের মাথাপিছু গড় ব্যয় ৭৪৯ মার্কিন ডলার। সবচেয়ে কাছাকাছি সুইজারল্যান্ডে এই ব্যয় ৯৩৯ মার্কিন ডলার। এছাড়া অস্ত্রোপচার ও রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষাগুলোও অন্যান্য দেশের তুলনায় ব্যয়বহুল।
২০১৩ সালে হৃৎপিণ্ডের বাইপাস সার্জারির জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে খরচ হতো ৭৫,৩৪৫ মার্কিন ডলার। অন্যদিকে, নেদারল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ডে এই খরচ ছিলো যথাক্রমে ১৫,৭৪২ ও ৩৬,৫০৯ মার্কিন ডলার। এমআরআই করতে যুক্তরাষ্ট্রে খরচ ১,১৪৫ মার্কিন ডলার, অস্ট্রেলিয়ায় যা ৩৫০ মার্কিন ডলার। এসব খাতে উচ্চমূল্যের কারণ হিসেবে দেখানো হয় যে, এগুলো গবেষণা ও মানোন্নয়নের কাজে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু গবেষকরা এই ব্যাখ্যা সন্তুষ্টজনক মনে করছেন না।
তাছাড়া চিকিৎসকরা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা করতে দেন। অনেক সময় রোগ নিশ্চিত জেনেও চিকিৎসকরা তা দিয়ে থাকেন। কারণ তাদের সবসময়ই রোগীদের মামলায় পড়ার চাপ থাকে। তাই আদালতে যেন লিখিত তথ্য উপস্থাপন করতে পারেন, সে কারণে এটি করে থাকেন। এতে রোগীদেরই খরচ বাড়ে।
চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ার আরেকটি কারণ, চিকিৎসক ও নার্সদের বেশি বেতন। ২০১৬ সালে একজন জেনারেল ফিজিশিয়ানের বছরে গড় আয় ছিল ২,১৮,১৭৩ মার্কিন ডলার। অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করে দেখা যায়, আমেরিকান ডাক্তারদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ। সুইডেন ও জার্মানির ডাক্তারদের এই আয় যথাক্রমে ৮৬,৪০৭ এবং ১,৫৪,১২৬ মার্কিন ডলার।
আমেরিকান নাগরিকরা এসব কারণে ডাক্তারের কাছে খুব কম যায় চিকিৎসার জন্য। হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হলেও যত দ্রুত সম্ভব চলে আসার চেষ্টা করে। কারণ হাসপাতালে এক রাত থাকতেও অনেক খরচ।
শেষ কথা
শেষ করা যাক বোস্টনের সেই নারীকে দিয়ে। বোস্টন শহরের মধ্যেই যদি অ্যাম্বুলেন্সে রোগী নেয়া হয়, বাংলাদেশি টাকায় খরচ পড়বে লক্ষাধিক। তাই তার অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে বাধা দেয়া অমূলক ছিল না। এরকম স্বাস্থ্য খাতের প্রতিটি জিনিস নিয়েই তাদের অনেক হিসাব করে চলতে হয়।
আমেরিকায় চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত এবং তাদের চিকিৎসকরাও অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন। কিন্তু সাধারণ আমেরিকান জনগণের জন্য নিজেদের চিকিৎসা নেয়া এক বিরাট বোঝা। অন্যান্য দেশে যেখানে সমন্বিত চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে, আমেরিকায় স্বাস্থ্য বীমাগুলোর বৈচিত্র্যই চিকিৎসা ব্যবস্থাকে জটিল করেছে। বিভিন্ন সময়ে একে সমন্বিত করার চেষ্টা করা হলেও বীমা কোম্পানিগুলোর বিরোধিতায় তা হয়নি। বিশেষজ্ঞরা কাজ করে যাচ্ছেন কীভাবে এই ব্যয়কে সাধারণ জনগণের সাধ্যের মধ্যে আনা যায় তা নিয়ে। তবে খুব দ্রুতই যে বদলাচ্ছে না, তা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়।