গত ১২ অক্টোবর ছিল বিশ্ব ডিম দিবস। ১৯৯৬ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় প্রথম পালিত হয় ‘বিশ্ব ডিম দিবস’। সেই থেকে প্রতি বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার সারা বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে এ দিবসটি। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ‘বিশ্ব ডিম দিবস’ পালন করা হয় ২০১৩ সালে ১৮তম বিশ্ব ডিম দিবসে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সাল থেকে প্রতি বছর বাংলাদেশে বিশ্ব ডিম দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে।
মূলত প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, স্বাস্থ্যবান ও মেধাবী জাতি গঠন এবং সর্বোপরি ডিমের গুণাগুণ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ১৯৯৬ সাল থেকে এ দিবসটি বিশ্ব জুড়ে একযোগে পালিত হয়ে আসছে। ডিমকে বিশ্বে একটি উন্নতমানের ও সহজলভ্য আমিষজাতীয় খাদ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ১৯৬৪ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এগ কমিশন (আইইসি) স্থাপিত হয় । বর্তমানে এই সংস্থার সদস্যসংখ্যা ৮০। সংস্থাটি ১৯৯৬ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় প্রথম ‘বিশ্ব ডিম দিবস’ পালনের আয়োজন করে, যা পরবর্তী সময়ে প্রতি বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার পালিত হয়ে আসছে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারত সহ সারা বিশ্বের ৫৫টিরও বেশি দেশে পালিত হয় ‘বিশ্ব ডিম দিবস’। এবং এর পরিধি ও ব্যাপ্তি সময়ের সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে এই সংস্থাটির সদস্য ৮০টি দেশ। এর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
২০১৩ সালে বাংলাদেশ অ্যানিমেল এগ্রিকালচার সোসাইটি (বিএএএস) ‘ইন্টারন্যাশনাল এগ কমিশন’-এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হয়।
ডিমের পুষ্টিগুণ অনেক। ডিম মানবদেহের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ করে আসছে। ডিমকে বলা হয়, ‘পাওয়ার হাউস অব নিউট্রিশন’ বা পুষ্টির শক্তিঘর। প্রাণিজ প্রোটিনের মধ্যে ডিম হলো আদর্শ প্রোটিন। এখানে সকল ধরনের পুষ্টি উপাদান রয়েছে।
মানবদেহে ডিমের স্বাস্থ্য উপকারিতা
১. মানবদেহে প্রোটিন যোগানদাতা
মানবদেহ গঠনে প্রোটিনের ভূমিকা প্রধান। আর এই প্রোটিন তৈরিতে সাহায্য করে অ্যামিনো এসিড। প্রোটিন তৈরিতে প্রয়োজন পড়ে একুশ ধরনের এমিনো এসিডের। কিন্তু আমাদের শরীর অতি প্রয়োজনীয় নয়টি এমিনো এসিড তৈরি করতে পারে না। আর এজন্যই আমাদের প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট নিতে হয়। খাবারের মধ্যে এই প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট হলো ডিম, যা ঝটপট শরীরে প্রোটিন উৎপাদন করতে সক্ষম।
২. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
ডিম দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। ডিমে আছে আয়রন, জিঙ্ক ও ফসফরাস। এর মধ্যে জিঙ্ক শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। একটি বড় ডিমে রয়েছে প্রায় ২২ শতাংশ আরডিএ বা সেলেনিয়াম। এই সেলেনিয়াম শিশুদের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দেহে বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করে। ডিমে আছে ভিটামিন-ই। এটি কোষ ও ত্বকে উৎপন্ন ফ্রি র্যাডিক্যাল নষ্ট করে দেয় এবং ত্বকের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
৩. হাড় ও দাঁত মজবুত করে
ডিম মানবদেহের হাড় ও দাঁত মজবুত করতে সহায়তা করে। ডিম প্রাকৃতিক ভিটামিন ডি-এর অন্যতম এক উৎস। এটি ক্যালসিয়াম গ্রহণ করতে সহায়তা করে, যা হাড় ও দাঁত মজবুত করে। এছাড়াও ডিমে রয়েছে ফসফরাস। ফসফরাস ও হাড় ও দাঁত মজবুত রাখে।
৪. মস্তিষ্ক গঠন করে
ডিমের মধ্যে মানবমস্তিষ্ক কোষ গঠনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কলিন থাকে, যা মস্তিষ্ক উন্নয়নে প্রধান সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
৫. দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে
ডিমে বিদ্যমান বিভিন্ন ভিটামিন হচ্ছে ভিটামিন এ, বি৫, বি১২, বি৬, ডি, ই, কে। ভিটামিন-এ দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে। ডিমের ক্যারোটিনয়েড, ল্যুটেন ও জিয়েক্সেনথিন বয়সকালের চোখের অসুখ ম্যাকুলার ডিজেনারেশন হওয়ার সম্ভাবনা কমায়। এই একই উপাদান চোখের ছানি কমাতেও সাহায্য করে।
৬. ওজন কমায়
অনেকেই ওজন বেড়ে যাবে, এই ভয়ে ডিম খান না কিন্তু পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিদিন সকালে নাস্তায় একটি ডিম মাসে প্রায় ৩ পাউন্ড পর্যন্ত ওজন কমাতে পারে। ডিমে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান রয়েছে। তাই সকালে একটি ডিম খেলে সারাদিনের অতিরিক্ত ক্ষুধা কমে যায়। আর এটি ওজন কমাতে ভূমিকা রাখে। ডিমে অনেক কম কার্বোহাইড্রেট থাকে। তাই সকালের নাস্তায় একটি সিদ্ধ ডিম ওজন কমাতে অনেক সাহায্য করে।
৭. হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
অনেকেই হৃদরোগের ভয়ে বা রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডিম খান না। কিন্তু ডিম খাওয়ার সাথে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং ডিম স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। উচ্চমাত্রায় কোলেস্টেরল আমাদের দেহের নানা ক্ষতি সাধন করে। কিন্তু সব কোলেস্টেরলই খারাপ নয়। আমাদের দেহের এলডিএল হলো মন্দ কোলেস্টেরল, যা দেহের ক্ষতি করে ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। কিন্তু ডিমে রয়েছে ভালো কোলেস্টেরল এইচডিএল, যা দেহের ক্ষতি সাধন করে না। বরং এটি দেহের মন্দ কোলেস্টেরল দূর করতেও সহায়তা করে। তাই নিয়মিত ডিম খেলে হৃদরোগের সম্ভাবনা বাড়ে না, বরং কমে যায়।
এছাড়াও ডিমের আরো অনেক গুণাগুণ রয়েছে। ডিম হচ্ছে প্রাণিজ আমিষের সহজলভ্য এক উৎস। সারা বিশ্বে যে খাদ্যটি সবচেয়ে বেশি পরিমাণে খাওয়া হয়, সেটি হচ্ছে ডিম। সারা বিশ্ব জুড়ে খাদ্যতালিকায় সবচেয়ে বেশি থাকে ডিম। বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ডিম।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ডিম প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আশার খবর এই যে, বাংলাদেশে গত ১০ বছরে ডিম উৎপাদন বেড়েছে ৩ গুণ। আর এতে চাহিদার পাশাপাশি ডিমের যোগানও বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণেই অন্যান্য ভোজ্য পণ্যের ন্যায় ডিমের দাম তেমন বাড়েনি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে ১,৪৯৩,৩১,০০,০০০ ডিম উৎপাদিত হয়েছে। অথচ ১০ বছর আগে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেশে ডিম উৎপাদিত হয়েছিল মাত্র ৫৬৫,৩২,০০,০০০। সারা বিশ্বে ডিম উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে চীন। বিশ্বের ৪০ শতাংশ ডিমের যোগান আসে চীন থেকে!
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একেকজন প্রতি বছর গড়ে ২৫০টি ডিম খায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই সবচেয়ে বেশি ডিম খাওয়া হয়ে থাকে। আজ থেকে ৬০ বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বছরে জনপ্রতি গড়ে ৩৮৯টি ডিম খাওয়া হতো। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর মতে, সুস্থ থাকার জন্য বছরে জনপ্রতি ডিম খাওয়া প্রয়োজন অন্তত ১০৪টি। বাংলাদেশের মানুষ বছরে ডিম খায় গড়ে ৫০ থেকে ৫৫টি। ডিম দিবস উদযাপনের মাধ্যমে মানুষকে ডিমের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে সচেতন করলে ও ডিম খাওয়ায় আগ্রহী করে তুলতে পারলে এ সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে বলে আশা করেন বিশেষজ্ঞরা।