![](https://archive.roar.media/wp-content/uploads/2018/10/Feature-Image-New-copy-3.jpg)
সেলাই মেশিন আবিষ্কারের ইতিহাস ঠিক যেন সুতোর বুননে ঠাসা এক কলঙ্কিত অধ্যায়। ব্যর্থ প্রচেষ্টা, নকশা চুরি, পেটেন্ট ব্যর্থতাসহ এমনকি অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফেরার মতো ঘটনার সম্পৃক্ততা রয়েছে এই ইতিহাসের সাথে।
সেলাই মেশিন আবিষ্কারের এই ঘটনাবহুল এবং কলঙ্কিত ইতিহাস নিয়েই আজকের আয়োজন।
২০ হাজার বছরের পুরনো শিল্প
হাতের সেলাই এবং কারুকাজের ইতিহাস বাদ দিয়ে কখনোই সেলাই মেশিনের অস্তিত্ব চিন্তা করা যায় না। এখন থেকে কমপক্ষে ২০ হাজার বছর আগে মানুষ প্রথমে হাতে সেলাই শুরু করা শুরু করে। প্রাণীর হাড় এবং শিং থেকে প্রথম সুঁচ তৈরি হয়। প্রথমদিকে প্রাণীর পেশির তন্তুকে সুতা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর পরবর্তী ইতিহাস শুধুই অগ্রগতির।
মানুষের অসীম আগ্রহ এবং প্রচেষ্টার ফলে পরবর্তীতে সেলাই শিল্পে নিরন্তর অগ্রগতি এসেছে। সেলাই পদ্ধতিতে নানা পরিবর্তনের ফলে পরিশ্রমও বহুলাংশে লাঘব হয়েছে। ১৮ শতকের শিল্প বিপ্লবের ফলে হাতে সেলাই এবং কারুকাজ প্রক্রিয়ায় রাতারাতি পরিবর্তন আসে এবং চূড়ান্তভাবে মেশিনভিত্তিক সেলাই শিল্পের সূত্রপাত ঘটে।
১৭৫৫ সালে ১ম পেটেন্ট
সেলাই মেশিনের ইতিহাসে চার্লস উইসেন্থালের পেটেন্টকে ১ম পেটেন্ট হিসেবে ধরা হয়। জন্মসূত্রে জার্মান চার্লস সর্বপ্রথম মেশিনে সুচের ব্যবহারের নকশার জন্য একটি ব্রিটিশ পেটেন্ট লাভ করেন। মজার বিষয় হচ্ছে, চার্লস বেশ আগেভাগেই এই পেটেন্ট পেলেও তখন পর্যন্ত সেলাইয়ে ব্যবহার করার জন্য কোনো মেশিন আবিষ্কৃত হয়নি। এছাড়া পরবর্তীতে চার্লসের এই পেটেন্টের কোনো লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
![](https://assets.roar.media/assets/vMXozFpifpbQJTMA_1.jpg)
১৭৯০ সালে ১ম বিস্তারিত নকশা
১৭৯০ সালে সেলাই মেশিনের ১ম নকশা প্রণীত হয়। কাজটি করেন ব্রিটিশ নাগরিক থমাস সেইন্ট। এই মেশিনের পেটেন্ট আবেদনে ‘চামড়া এবং ক্যানভাস সেলাই করার জন্য হাতে পরিচালিত এবং হাতলবিশিষ্ট’ একটি মেশিনের উল্লেখ করা হয়। সেইন্ট এই মেশিনের কোনো প্রোটোটাইপ তৈরি করেছিলেন কি না সেই বিষয়ে জানা না গেলেও পরবর্তীতে ১৮৭৪ সালে উইলিয়াম নিউটন উইলসন এই পেটেন্ট নকশাটি খুঁজে পান। এই নকশা থেকে উইলসন একটি অবিকল প্রতিরুপ তৈরিও করেন। প্রোটোটাইপ মেশিনটি আসলেই কাজ করেছিল।
![](https://assets.roar.media/assets/PHAM2a3qEuiNTpaA_2.jpg)
১৯ শতকের শুরুতে নানা ব্যর্থ প্রচেষ্টা
১৯ শতকের শুরুতে সেলাই মেশিন তৈরির বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়। এক্ষেত্রে, প্রথমে একদিকে সুচ ব্যবহার করে এবং অন্যদিকে ঘূর্ণায়মান হাতল রেখে চেষ্টাগুলো চালানো হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এই নকশা ব্যর্থ হলে নকশায় পরিবর্তন আনা হয় এবং ফলশ্রুতিতে সফলতা আসে।
- ১৮১০ সালে বলথাসার ক্রেমস নামের একজন ব্যক্তি সেলাইয়ের জন্য একটি মেশিন তৈরি করেন। তার এই মেশিন ঠিকঠাক সেলাই করতে ব্যর্থ হয় এবং তিনি পরবর্তীতে তার মেশিনের নকশার পেটেন্ট থেকে বিরত থাকেন।
- ১৮১৪ সালে জোসেফ মাদারস্পারজার নামের একজন অস্ট্রিয়ান দর্জি সেলাই মেশিন তৈরি করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। তিনি সেলাই কাজে ব্যবহারের জন্য বেশ কয়েকটি যন্ত্র তৈরি করেন এবং পেটেন্টও করান। কিন্তু তার সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
- ১৮১৮ জন অ্যাডামস এবং জন নোলস নামের দুই মার্কিন নাগরিক আমেরিকায় প্রথম সেলাই মেশিন তৈরি করেন। কিন্তু এই যন্ত্র কয়েক বিট কাপড় সেলাই করার পরেই ভেঙে যায়।
![](https://assets.roar.media/assets/qimpUHeoODTpEaWp_3.jpg)
১৮৩০ সালে প্রথম সফল প্রচেষ্টা
থমাস সেইন্টের নকশার প্রায় ৪০ বছর পরে প্রথম কোনো কার্যকরী সেলাই মেশিন পৃথিবীতে আসে। বার্থেলেমি থিমোনিয়ার নামের এক ফরাসি দর্জি এই মেশিনটি তৈরি করেন। তিনি নকশার পেটেন্ট করানোর পরে তার এই যন্ত্রকে ক্রেন্দ্র করে একটি পোশাক সেলাই কারখানাই খুলে বসেন। এমনকি তিনি তার কারখানায় ফরাসি সেনাবাহিনীর জন্য ইউনিফর্ম তৈরির ফরমায়েশও পেয়ে যান। কিন্তু তার পেশার অন্যান্য লোকজন এক বিপত্তি তৈরি করে। কাজ হারানোর ভয়ে তারা থিমোনিয়ারের কারখানায় আগুন লাগিয়ে দেয়। কোনোক্রমে প্রাণে বেঁচে যান বার্থেলেমি থিমোনিয়ার। কিন্তু তার সেলাই কারখানাটি আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়।
![](https://assets.roar.media/assets/649Rbtso4LK4m5E3_5.jpg)
![](https://assets.roar.media/assets/6GDC03IhVI0RcAGq_4.jpg)
নৈতিকতা বনাম টাকা
১৮৩৪ সালে ওয়াল্টার হান্ট আমেরিকায় প্রথম কার্যকরী সেলাই মেশিন তৈরি করেন। কিন্তু তিনি এই মেশিনের ব্যবহারের বিষয়ে বেশ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সেলাই শিল্পে মেশিনের সম্ভাব্য ব্যবহারে যে বহু মানুষ তাদের কাজ হারাবে- এই বিষয়টি তাকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। ফলাফল হিসেবে হান্ট তার মেশিনের নকশার পেটেন্ট করানো থেকে বিরত থাকেন।
![](https://assets.roar.media/assets/mblUFCORR0nyqegc_6.jpg)
১৮৪৪ সালে জন ফিশারের উদ্যোগ
এ পর্যন্ত সেলাই মেশিন তৈরির যাবতীয় প্রচেষ্টা মূলত কয়েকটি অসংলগ্ন অংশবিশেষের সমন্বয় ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এই সেলাই মেশিন প্রকৃতপক্ষে ঠিকঠাক কাজ করতো না। ১৮৪৪ সালে জন ফিশার নামের একজন ইংরেজ এই সেলাই যন্ত্রে ব্যবহৃত অংশগুলোর মধ্যে সমতা আনেন। তিনি তার তৈরি সেলাই যন্ত্রের নকশার জন্য পেটেন্ট আবেদনও করেন, কিন্তু পেটেন্ট অফিসে কোনো এক জটিলতার কারণে ফিশার তার নকশার পেটেন্ট পেতে ব্যর্থ হন।
এলিয়াস হউ এবং তার ‘লকস্টিস’
পরবর্তীতে আরেক মার্কিন নাগরিক এলিয়াস হউ ফিশারের নকশায় কিছুটা পরিবর্তন এনে একটি সেলাই যন্ত্র তৈরি করেন। তার নকশার পেটেন্ট থেকে পাওয়া তথ্যমতে, যন্ত্রনির্ভর সেলাই এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে সেলাইয়ে ব্যবহৃত সুতা মূলত দুটো থ্রেড থেকে আসে। সেলাইয়ে ব্যবহৃত সুচের মাথায় একটি ছিদ্রে একটি থ্রেডের সুতা এবং কাপড়ের নিচে থেকে অন্য থ্রেডের সুতা আসে। এই সেলাই প্রক্রিয়ার নাম দেওয়া হয় ‘লকস্টিস‘।
![](https://assets.roar.media/assets/R6bH5MbI07rLNiFF_8.png)
এলিয়াস তার সেলাই যন্ত্রের নকশা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বিপণন করার জন্য ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। ইংল্যান্ডে বেশ কিছুদিন থাকার পরে তিনি তার নিজের দেশে ফেরত আসলে দেখতে পান, অনুমতি ছাড়াই অনেকেই তার নকশা ব্যবহার করে ইতোমধ্যে সেলাই মেশিন তৈরি করে ব্যবহার করছে। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আইজাক মেরিট সিঙ্গার।
আইজাক সিঙ্গার এবং পেটেন্ট কলঙ্ক
আইজাক মেরিট সিঙ্গারকে আধুনিক সেলাই মেশিনের পথিকৃৎ বলা হয়। তিনি ‘সিঙ্গার কোম্পানি’ নামে যে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন তা আজ ইলেকট্রনিক্স জগতে স্বগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। সিঙ্গার কোম্পানির সবচেয়ে প্রথম এবং পুরনো পণ্য হচ্ছে সিঙ্গার সেলাই মেশিন। আজকের দর্জি দোকানে যেসব সনাতন সেলাই মেশিন দেখা যায়, সেগুলো মূলত আইজাক সিঙ্গারের নকশায় অনুপ্রাণিত। সুন্দর, সুসজ্জিত এবং ঐতিহ্যবাহী এই সেলাই মেশিনে পায়ের প্যাডেল এবং উপর-নিচ সুচের ব্যবহার রয়েছে। আইজাক সিঙ্গার মূলত তার নকশায় হউ, হান্ট এবং থিমোনিয়ারের নকশার সুন্দর এক সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। অনুমতিবিহীন নকশা ব্যবহারের জন্য পরবর্তীতে তাকে হউ আদালতে হাজির করেন।
পেটেন্ট মামলায় এলিয়াস হউ জিতে যান। সিঙ্গার যদিও নিজের পক্ষে এই যুক্তি দেখান যে, তিনি ওয়াল্টার হান্টের নকশা অনুসরণ করেছেন। কিন্তু আদালত হান্টের নকশার কোনো পেটেন্ট না থাকার কারণে এই যুক্তি খারিজ করে দেন। জরিমানা হিসেবে এলিয়াস হউ সিঙ্গার কোম্পানির লভ্যাংশের একটি অংশ পাবেন বলে আদালত সিদ্ধান্ত প্রদান করে।
![](https://assets.roar.media/assets/vwyB5K6B36Pw50Q8_9.jpeg)
হেরে যাবার পরেও সিঙ্গার এবং তার প্রতিষ্ঠিত I.M. Singer & Co কোম্পানির ইতিহাস শুধুই লাভের। হউ এবং সিঙ্গার দুজনেই মাল্টি-মিলিয়নিয়ার হিসেবে মারা যান। আজ সিঙ্গার কোম্পানি কিন্তু শুধু সেলাই মেশিন নয়, বরং আরও নানা ইলেকট্রনিক পণ্য সম্ভারের জন্য সবার কাছে এক সুপরিচিত নাম।
হাতে সেলাইয়ের পরিবর্তে সেলাইয়ে মেশিন তৈরিতে বহু উৎসাহী মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তাদের নানা প্রচেষ্টা নানা সময়ে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু থেমে থাকেনি সেলাই যন্ত্র তৈরির এই প্রচেষ্টা। এসব উৎসাহী এবং পরিশ্রমী মানুষদের কল্যাণেই আজ আমরা আধুনিক এক বস্ত্রশিল্প উপভোগ করছি। প্রাচীন সময়ের প্রাণীর চামড়া দিয়ে লজ্জা নিবারণ আর এখনকার বস্ত্র শিল্প এবং আধুনিক সেলাই প্রযুক্তির মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব।