Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জাপানের প্রাচীনতম ধর্ম শিন্তোর খুঁটিনাটি

জাপান পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ দেশ, যা উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত। জাপানের প্রধান দ্বীপের সংখ্যা ৪টি। এছাড়া প্রায় ৪,০০০ এর মতো ছোটখাট দ্বীপ রয়েছে।

জাপানের জনসংখ্যা ১২ কোটি ৬০ লক্ষাধিক। ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্পকলা, সংস্কৃতি- প্রতিটি ক্ষেত্রেই জাপান ধরে রেখেছে স্বকীয়তা, জায়গা করে নিয়েছে কৌতূহলজাগানিয়া মানুষের মনে। দেশটির পপ সংস্কৃতির কথা না বললেই নয়। মাঙ্গা, অ্যানিমে ও উত্তেজনাময় ভিডিও গেমসের সমাহার শুধু জাপানেই পাওয়া সম্ভব। কিন্তু জাপানিদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য কিন্তু সবার চোখেই ধরা পড়েছে, তা হলো তাদের নিয়মতান্ত্রিক জীবন, সুনিপুণ কলাকৌশলে সমৃদ্ধ প্রতিটি কাজ ও কলুষমুক্ত চিন্তাচেতনা। কীভাবে তারা এরকম জীবনযাত্রায় পারদর্শী হলো? এর পেছনের কারণটাই বা কী? এসকল প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আগে জানতে ও বুঝতে হবে শিন্তো ধর্ম সম্পর্কে।

শিন্তো ( Shinto) ধর্ম 

শিন্তো হলো জাপানের প্রাচীনতম ধর্ম, যার উৎপত্তি ইয়াওই যুগে। ২০০ খ্রিস্টপূর্ব – ২৫০ খ্রিস্টাব্দ (অনেকে বলেন ৩০০ খ্রিস্টপূর্ব – ২৫০ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত সময়কে বলে ইয়াওই যুগ। এ যুগ জাপানি সংস্কৃতিতে বিভিন্ন নতুন ও প্রয়োজনীয় জিনিসের যোগানদাতা। আধুনিক জাপানের ভিত তৈরি হয় এই যুগে। এছাড়া ধানের চাষ ও বিভিন্ন কাজ সম্পাদনের জন্য ধাতব যন্ত্রের প্রচলন শুরু হয় এই সময়। ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সামরিক কার্যক্রমের জন্য অস্ত্রশস্ত্রের উৎপাদন জরুরি হয়ে পড়ে।

Image Courtesy: 手机搜狐网

শিন্তো ধর্মে তাদের ঈশ্বরের আদলে তৈরি কোনো মূর্তি বা ভাস্কর্য নেই। ধর্মটির উৎপত্তি কে করেছিল বা কীভাবে হয়েছিল সেই সম্পর্কেও বিশেষ কিছু জানা যায় না। এটি এমন এক ধর্ম যা প্রতিষ্ঠাতা ছাড়া বহু যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে। প্রকৃতি ও বিশুদ্ধতার প্রতি শ্রদ্ধা ও নমনীয়তা শিন্তো ধর্মের মূল কথা। জাপানি শিন্তোতে নেই কোনো কঠোর নিয়ম এবং আচার-অনুষ্ঠান, বরং এটি একটি জীবনপদ্ধতি। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সাথে সততা ও বিশ্বস্ততার মতো গুণাবলীর উপর জোর দিতে শেখায় শিন্তো। শিন্তোর অনুসারীদের উদ্দেশ্যে হলো “মাকোতো নো কোকোরা” তথা কলুষতা ও অরাজকতা থেকে মুক্তি লাভ করে স্বাধীন ও সুন্দর মনের অধিকারী হয়ে ওঠা। 

শিন্তো ধর্মের বিশ্বাসসমূহ

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে শিন্তো ধর্মে কোনো প্রতিষ্ঠাতা ও ঈশ্বরের মূর্তি নেই, তবে অনুসারীগণ কামিদের প্রচণ্ড ভক্তি করেন। এই কামি (Kami) হলো শিন্তো ধর্মের মূল আকর্ষণ। ধর্মটির অনুসারীদের বিশ্বাস ইজানাগি ও ইজানামি (Heaven & Earth) থেকে জাপানের অসংখ্য দ্বীপ ও কামির জন্ম।  

এখন কামির কথায় আসি। কামি হলো একপ্রকার দেবতা যারা বিভিন্ন জীব ও জড় পদার্থে বসবাস করে। এদের সংখ্যা আনুমানিক ৮ মিলিয়ন, যা জাপানে ইনফিনিটি সংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করে। শিন্তোকে বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘কামির পথ’। কামিরা বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে পারে, যেমন- পাহাড়-পর্বত, গাছপালা, নদী-নালা, আসবাবপত্র, এমনকি মানুষ ও পশুপাখিও। তাই প্রকৃতির সকল কিছুর প্রতি জাপানিরা শ্রদ্ধা ও যত্ন প্রকাশ করে, কারণ তারা কামিদের প্রতি রুদ্ধ মনোভাব দেখাতে চায় না বা তাদের কষ্ট দিতে চায় না।

তবে মজার ব্যাপার হলো, যদিও কামিদের দেবতা বা ঈশ্বরতুল্য গণ্য করা হয়, তারা সবসময় ভালো বা শুভ শক্তির পক্ষে থাকেন না। কিছু কিছু কামি অশুভ শক্তির প্রতীক। এরা মানুষের ক্ষতি করতে চায়। তাই এদের বিশুদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন রকম ভোগ ও আচার-অনুষ্ঠান পালনের রীতি রয়েছে শিন্তো ধর্মে। কামিরা অলৌকিক শক্তির অধিকারী। তাই তারা মানুষের কামনা-বাসনা পূরণে সক্ষম। এমনকি, প্রাকৃতিক ঘটনা, যেমন- বৃষ্টি, বায়ুপ্রবাহ, ঝড় ইত্যাদি কামিদের শক্তির প্রতিফলন বলে মনে করে জাপানিরা। কামিরা যদিও ভালো ও খারাপ দুই রকম হতে পারে, তবে ভালো কামির সংখ্যাই তুলনামূলক বেশি। 

Image Courtesy: coredake!ミステリー

বিশ্ববিখ্যাত অ্যানিমেটর হায়াও মিয়াজাকি তার অ্যানিমেগুলোতে চরিত্রের প্রয়োজনে বিভিন্ন কামির উদাহরণ আমাদের সামনে ফুটিয়ে তুলেছেন। জাপানি সংস্কৃতিতে কামির প্রভাব যে অনেক তা আমরা এ থেকেই বুঝতে পারি। তার ১৯৯৭ সালের অ্যানিমে  প্রিন্সেস মনোনোকে-তে আমরা Forest God বা অরণ্যের কামির ঝলক দেখতে পাই। তার আরেকটি ছবি স্পিরিটেড অ্যাওয়ে-র শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখা মেলে হাজারো স্পিরিট বা কামির। হায়াও মিয়াজাকি ছাড়া অন্য অ্যানিমেটররাও যুগ যুগ ধরে অ্যানিমেশন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কামিদের কেন্দ্র করে অনেক অ্যানিমে বানিয়েছেন। জেনে অবাক হবেন যে, যারা ঈশ্বরে বিশ্বাসী নয় বা শিন্তো ধর্ম অনুসরণ করে না, তারাও কামিদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন। 

কামিদের খুশি করার জন্য শিন্তো ধর্মে হরেক রকম উৎসব পালিত হয়। তা নিয়ে একটু পরেই আলোচনা করা হবে। তবে তার আগে চলুন জেনে নেয়া যাক শিন্তোর চারটি মৌলিক ভিত নিয়ে।

১) পরিবার: ঐতিহ্য ও আচার-অনুষ্ঠানের মূল হচ্ছে পরিবার। তাই পরিবার গঠন ও এর নিয়মকানুন অবশ্যই গুরুত্বের সহিত দেখতে হবে। 

২) প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা: শিন্তো ধর্মাবলম্বীদের কাছে প্রকৃতি বেশ স্বর্গীয়। কামিরা বসবাস করে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানে। তাই প্রকৃতিকে যত্নের সহিত লালন করা বাঞ্ছনীয়।

৩) আচারের জন্য নিজেকে পরিশুদ্ধ করা: কামির পূজা করার স্থান হচ্ছে মন্দির। আর মন্দিরে প্রবেশের আগে সবাইকে আধ্যাত্মিক ও শারীরিকভাবে শুচি করতে হবে। শিন্তো ধর্মাবলম্বীদের সকলেই নিজেদের মানসিক ও আত্মিক শান্তি ও শুচির জন্য বছরে দুবার উৎসবের আয়োজন করে থাকে। এ থেকেই বোঝা যায় শিন্তো ধর্মে বিশুদ্ধতার গুরুত্ব কতখানি। 

৪) মাতসুরি: দেবতা ও পৈতৃক আত্মাদের যথাযথ মর্যাদা দেয়া।

জাপানের বিভিন্ন স্থানে দেখা মেলে এমন অনেক কামির অবয়ব
Image Courtesy: Prepona

শিন্তো ধর্মের ইতিহাস

শিন্তো জাপানের সবচেয়ে পুরনো ধর্ম, কারণ বৌদ্ধধর্ম ও কনফুসিয়ানিজমের আগে শিন্তোই ছিল জাপানের একমাত্র ধর্ম। তাই জাপানে যখন নতুন নতুন ধর্মের আগমন ঘটে, তা শিন্তোর উপর বিরাট প্রভাব ফেলেছিলো। বলা যায়, জাপানিজদের জীবনযাপনে যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। সেই সময়ই আসলে শিন্তোর নামকরণ করা হয়, যাতে একে অন্যান্য ধর্ম থেকে আলাদা করা যায়। তখন থেকে জাপানের অনেকেই শিন্তো ও বৌদ্ধধর্মের সংমিশ্রণে জীবনচর্চা শুরু করে। তবে দুটো ধর্ম কিন্তু মোটেই একরকম নয়, বরং এদের নিয়মকানুনে ব্যাপক ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। যেমন- অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কোনো প্রচলনই ছিল না শিন্তো ধর্মে। বৌদ্ধধর্ম আসার পর জাপানিরা মৃতদেহের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে শেখে। 

মেইজি যুগে (১৮৬৮-১৯১২) শিন্তো জাপানের রাষ্ট্রধর্ম হয়ে ওঠে। শিন্তোকে বৌদ্ধ ধর্ম থেকে আলাদা করার লক্ষ্যে সে সময়ের শাসকগণ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সেসবের মধ্যে অন্যতম জাপানি সম্রাটদের দেবত্ব প্রদান। শিন্তোর পুরাণে বলা হয়েছে, জাপানের প্রথম সম্রাট জিম্মু ছিলেন সূর্যদেবী অমতেরাসুর বংশধর। রাজতন্ত্র অনুযায়ী পরবর্তী সকল সম্রাটরাও তাই দেবীর বংশধর বলে বিবেচিত হতেন। তাই জাপানের সকল সম্রাটকে কামির প্রতিনিধি বলে গণ্য করা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নানা কারণে যখন শিন্তো মূল রাজ্য থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন বৌদ্ধধর্মের গ্রহণযোগ্যতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সাথে সম্রাটের ক্ষমতার একাংশ কেড়ে নেয়া হয়, যার ফলে তিনি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতার আসন হারান। জনগণের নিকট তখন তিনি শুধুমাত্র রাষ্ট্রের প্রতীক হয়ে দাঁড়ান। সেই থেকে জাপানি সম্রাটদের পূর্বের মতো ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন কামির প্রতিনিধি হিসেবে দেখা হয় না। সম্রাট আকিহিতো কোনোরূপ দেবত্বের দাবি করেননি, বর্তমান সম্রাট নারুহিতোও করেন না।

সম্রাট নারুহিতো; Image Courtesy: Wikimedia Commons

সম্প্রদায়

১) জিনজা
২) কিওহা
৩) মিনজোকু 

জিনজা শিন্তো সবচেয়ে প্রাচীন সম্প্রদায়, এবং বিস্তৃত অর্থে শিন্তো বলতে আমরা যা বুঝি তার ঐতিহ্যবাহী রূপ। কিওহা শিন্তো প্রতিষ্ঠিত হয় মেইজি যুগের কিছুকাল আগে, এবং এটি সরকার স্বীকৃত ১৩টি সম্প্রদায় নিয়ে গঠিত। মিনজোকু শিন্তো বা লোকসম্প্রদায় সাধারণত স্থানীয় জনগোষ্ঠী তাদের মন্দিরে অনুশীলন করে থাকে, এবং এই সম্প্রদায়ের বিভিন্ন রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠানে বৌদ্ধ ধর্ম, তাওবাদ এবং কনফুসিয়ানিজমের প্রভাব রয়েছে। 

ঐতিহ্যবাহী উৎসবসমূহ

উৎসব ও আচার-অনুষ্ঠান শিন্তোর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহ্য। প্রতি বছরই অনেক উৎসব হয় কামিদের ধন্যবাদ দেয়ার উদ্দেশ্যে। শিন্তোর প্রধান উৎসবকে বলা হয় মাতসুরি, যা সাধারণত ৩টি অংশে বিভক্ত। প্রথমটির নাম কামি মুকা, যার অর্থ কামিকে স্বাগত জানানো। এই অংশে মন্দিরগুলো বিশেষ স্বাগত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কামিকে পৃথিবীতে স্বাগত জানায়। দ্বিতীয় অংশটি শিংকো নামে পরিচিত, যার বাংলা কামির মিছিল। এই অংশে একটি কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয় যেখানে ‘মিকোশি’ বা পালকিতে করে মন্দিরের কামিকে বহন করা হয়। উৎসবের শেষ অংশ কামি ওকুরি, যেখানে কামিকে তাদের স্বর্গীয় বাসস্থানে ফেরত পাঠানো হয়। বিনোদনের উদ্দেশ্যে রাজকীয় ভোগ ও জমকালো পারফর্মেন্সেরও আয়োজন করা হয়।

জাপানের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী বিয়ের ক্ষেত্রে শিন্তোর নিয়ম অনুসরণ করে থাকে। একজন শিন্তো পুরোহিত পুরো অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন। প্রথমে হবু স্বামী ও স্ত্রী কামির কাছে মানত করেন। এরপর ‘সান-সান-কুডো’-তে অংশ নেন। এটি মূলত অনুষ্ঠানের চূড়ান্ত অংশ যেখানে বর ও কনে ৩টি আলাদা আলাদা কাপ থেকে একধরনের বিশেষ পানীয় তিনবার পান করেন। পান পর্ব শেষ হলে পুরোহিত তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেন। 

অন্য আচার-অনুষ্ঠানগুলোয় মন্দিরের ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রায় ১৫,০০০ শিন্তো মন্দিরের অস্তিত্ব আছে জাপানে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আইসির গ্র্যান্ড শ্রাইন, যেখানে সূর্যদেবী অমতেরাসুর পূজো করা হয়। আরও একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান মিয়ামাইরি। এই অনুষ্ঠান করা হয় শিশুর মঙ্গল কামনায়। বাবা-মা তাদের ১ মাসের শিশুকে নিয়ে মন্দিরে আসেন। সেসময় তারা কামিকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন তাদের ফুটফুটে শিশু উপহার দেয়ার জন্য। একইসাথে পুরোহিত ওই শিশুকে সকল অনাচার থেকে রক্ষায় বিভিন্ন প্রার্থনার আয়োজন করেন। 

বর্তমানে শিন্তো হয়ে উঠেছে জাপানের সর্ববৃহৎ ধর্ম। প্রচুর সংখ্যক মানুষ শিন্তোর অনুসারী, আবার অনেকে শিন্তো ও বৌদ্ধ দু’ধর্মই চর্চা করে থাকেন। সমৃদ্ধিশালী জীবন ও আত্মিক শান্তির জন্য শিন্তোর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করে জাপানিরা। তাই তারা শিন্তোকে স্রেফ ধর্ম নয়, বরঞ্চ জীবনের পথ প্রদর্শক হিসেবে দেখে।

Related Articles