কেমন ছিল প্রাচীন সভ্যতাগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা?
শিক্ষা বলতে কী বোঝায় সেই সম্পর্কে আমাদের সবারই কম-বেশি ধারণা আছে। শিক্ষা মানুষের মাঝে ইতিবাচক এবং তুলনামূলক স্থায়ী পরিবর্তন ঘটায়। শিক্ষা এরকম আরো বহু পরিবর্তনই আনে একজন মানুষের দৈনন্দিন আচার-ব্যবহার, চিন্তা-চেতনায়। এর অর্থ হলো, শিক্ষার পেছনে উদ্দেশ্য আছে। আজ শিক্ষার পেছনে যেসব উদ্দেশ্য আছে, প্রাচীনকালেও শিক্ষার উদ্দেশ্য কি একই ছিল? নাকি সময়ের সাথে সাথে বদলেছে সেগুলো? আর সেই উদ্দেশ্য সফল করতে কি বদলেছে শিক্ষাব্যবস্থাও? সেসব জানাতেই আজকের এই লেখা।
গত পর্বের সূত্র ধরেই বলতে হয়, ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে চীনে কমিউনিস্টদের উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা মূলত কনফুসিয়ান দর্শন আর তার লেখা নীতিমালা সম্বলিত পাঁচ বই আর ষটচক্রের উপরে ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। কনফুসিয়াসকে কেন্দ্রে রেখেই তৈরি হয় চীনের কারিকুলাম, ১৯৪৯ এর পূর্ব পর্যন্ত যে কারিকুলামের মূল উদ্দেশ্য ছিল সরকারি তথা রাজ আমলা প্রস্তুত করা।
অথচ চীনে কিন্তু কনফুসিয়াসের দর্শন ছাড়াও টাওয়িয়ান দর্শনও আবহমান কাল ধরেই চীনাদের দৈনন্দিন জীবনে সমান প্রভাব বিস্তার করে আসছিলো। লু সাও (Tsao) এর দর্শনের মূল কথা হচ্ছে,
মানুষকে এমন শিক্ষাই দিতে হবে, যে শিক্ষা মানুষকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাঁচতে না শিখিয়ে প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে চলতে শেখাবে!
কনফুসিয়ান এবং টাওয়িয়ান দর্শন, উভয়ই চীনে বেশ জনপ্রিয় থাকলেও পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় কিন্তু ঐ কনফুসিয়ান দর্শনেরই একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। কনফুসিয়াসের দর্শন বলছে, সমাজের প্রত্যেকেরই যার যার জায়গা থেকে পালন করার মতো দায়িত্ব আছে, সবাই যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করে, তবে সমাজে সুখ বাড়বে, প্রত্যেক ব্যক্তির মনের গহীনে তুলনামূলকভাবে পূর্বের থেকে বেশি সুখ বিরাজ করবে।
কিন্তু কেন? এর পেছনেও চীনাদের উদ্দেশ্য ছিল কি? উদ্দেশ্যটা আপনি ইতোমধ্যেই উপলব্ধি করা শুরু করে দিয়েছেন।
প্রাচীন ভারতের দিকে তবে একটু নজর দেয়া যাক। ‘গুরুকুল’ শব্দটির সাথে বোধ হয় আমরা অনেকেই পরিচিত। কারণ এখন ভারতের বেশ কিছু জনপ্রিয় এবং শিক্ষামূলক অনলাইন সাইট আর ইউটিউব চ্যানেলের আগ-পিছে এই শব্দটির বহুল ব্যবহার স্বাভাবিকভাবেই নজরে পড়ে। তবে যে কথাটা না বললেই নয়, তা হচ্ছে, ‘গুরুকূল’ আদতে প্রাচীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার নাম, রূপ, রূপক, পরিচায়ক ও সাক্ষী! ‘গুরুকূল’ বলতে আক্ষরিক অর্থেই গুরুর আলয় অথবা আবাসকে বোঝায়। তৎকালীন অভিজাত শ্রেণীই এই শিক্ষাব্যবস্থার আওতাভুক্ত ছিল বলে শক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়। শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয় গোষ্ঠীই এই গুরুর আলয়ে তথা প্রাচীন ভারতের আবাসিক এই শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেত।
রাজারা তখন তাদের সন্তানাদি গুরুর কাছে শিক্ষার জন্য একবারে পাঠিয়ে দিতেন। উপানিষদ অনুযায়ী, সেখানে শিক্ষা দেয়া হতো পুরো বারো বছর ধরে। সেখানে সংগীত, কলা, দর্শন, যুদ্ধবিদ্যা, সমরাস্ত্র বিদ্যা, সাহিত্য, নানা দেশের নানা গীতিকথা ইত্যাদি শেখানো হত! এককথায়, গুরু যা-ই জানতেন, শিষ্যকেও তার সবটুকু উজার করেই শেখানো হতো!
গুরুকে পারিশ্রমিক প্রদানে কেউ বাধ্য নয়! গুরু দৃশ্যত, কারো মুখাপেক্ষী নয়, বরং নিঃস্বার্থভাবে শিক্ষা দান করেন এবং শিষ্যদেরকেও নিঃস্বার্থভাবে জ্ঞান বিলিয়ে দিতে সবসময় উদ্বুদ্ধ করে যেতেন। কিন্তু এটা আদতে দৃশ্যত, অর্থাৎ যা খালি চোখে দেখা যায়! যে কথাটা প্রায়শই লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার চেষ্টা হয়, সেটা হচ্ছে, অধিকাংশ গুরুই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে শাসকগোষ্ঠীর সুশীতল ছায়ার আশ্রয়ে নিজ নিজ কার্যাদি পরিচালনা করতেন। ব্যতিক্রম তো আছে বটেই, কিছু গুরু নিজেদেরকে সাধক, একজন পরিপূর্ণ সাধক বানানোর প্রচেষ্টাতেই নিমগ্ন থাকতেন! যারা কি না দিনে একবার, তিন দিনে একবার খেয়ে শিক্ষা দানের কাজটাও চালিয়ে যেতেন। আর শিক্ষার পূর্ণতা প্রাপ্তি হলে সেকালে গুরুদক্ষিণা দেবার রেওয়াজ ছিল। তবে এটা দিতেও কেউ বাধ্য ছিল না। অধিকাংশ অভিজাতের সন্তানই গুরুদক্ষিণা দিয়ে যেত। আর গুরুদের মাসিক কিংবা সাপ্তাহিক দক্ষিণার ব্যবস্থাও ছিল। ঠিক এমন যে, কোনো এক ছাত্র আসার সময় বাড়ি থেকে হাতে করে একটা লাউ নিয়ে আসলো, আরেকজন একটা মিষ্টি কুমড়া নিয়ে আসলো। এই লাউ, কুমড়াই দক্ষিণা!
কিন্তু সে যা-ই হোক। সাহিত্য, জ্যোতিষশাস্ত্র, কলা, সংগীত, রণকৌশল, শিষ্টাচার, রাজ শিষ্টাচার, জনসংযোগ বিদ্যা, সম্পর্কন্নোয়ন বিদ্যা, নৈতিক শিক্ষা ইত্যাদি নানা বিষয়ে গুরুর কাছ থেকে শিক্ষা নেবার পেছনে উদ্দেশ্য কি ছিল? উল্লেখ্য, সমাজের নিচু বর্গের মানুষ, দলিত শ্রেণী, নিচু বর্ণের মানুষদেরকে এই গুরুর শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রাখা হত। কেন? কেনই বা গুরুকূল শিক্ষাব্যবস্থাকে বেদভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা বলা হয়? এর সাথে ধর্মের যোগসাজশ কী? শিক্ষার্থীর আত্মিক উন্নয়নেও বা কতটুকু কার্যকর ছিল এই শিক্ষাব্যবস্থা!
অতসব বিদ্যার্জনের উদ্দেশ্যই ছিল রাজপরিবারকে শক্তিশালী থেকে মহাশক্তিশালী আর মহাশক্তিশালী থেকে পরাক্রমশালী রূপে তৈরি করা, যাতে করে সুসম্পর্ক বজায় রেখে নিজ অঞ্চলের মানুষকে শোষণ করা যায় আর নিজ অঞ্চলকে বাইরের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা যায়। কিন্তু এর পরপরই উপমহাদেশে শুরু হয় আবার অন্য রকমের শিক্ষাবিপ্লব, যাকে বিহার বিপ্লব বললেও অত্যুক্তি হবে না। এই বাংলাদেশ অঞ্চলে তথা আমাদের প্রাচীন বঙ্গেই এই বিহার বিপ্লবের নিদর্শন এখনও অনেকটাই অক্ষত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায়। সোমপুর বিহার, শালবন বিহার, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, ময়নামতি বিহার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
পালেরা, সেনেরা থাকাকালেই এই বিহারকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন হয়। একদম শুরুর দিকে এই শিক্ষা ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য জীবনমান উন্নয়ন, শান্তি প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরে তা ধর্ম প্রচারকে একটা সময়ে গুরুত্ব দেয়া শুরু করে।
শিক্ষাব্যবস্থায় নানা সময়ে নানাভাবে আমূল পরিবর্তন এসেছে নানা উদ্দেশ্য সফল করতে, আর সেই উদ্দেশ্য বদলাবার সাথে সাথেই বদলে গেছে শিক্ষাব্যবস্থাও! সুতরাং, প্রেক্ষাপট বিবেচনায় শিক্ষাব্যবস্থা আর উদ্দেশ্য একে অপরের পরিপূরকই বটে।
প্রাচীন গ্রিস, প্রাচীন চীন এবং ভারতীয় উপমহাদেশসহ অন্যান্য অনেক প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থাই কোনো উদ্দেশ্য পূরণে কীভাবে মোড় নিয়েছে তা জানতে থাকুন রোর বাংলার সাথেই, অপেক্ষা করুন পরবর্তী পর্বগুলোর জন্য।