ভূত-প্রেত আছে কি নেই, এ নিয়ে মানুষের কৌতূহল চিরদিনের। এর অস্তিত্বের প্রমাণ পেতে আজ অবধি মানুষ কত যে বিচিত্র উপায় পরখ করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। যুগে যুগে এ নিয়ে অজস্র রকম জল্পনাকল্পনাও হয়েছে। প্ল্যানচ্যাটে আত্মা ডেকে তার কাছে পরলোকের খবর জানা কিংবা প্রেতের ভর করার মাধ্যমে রোগ সারানো ও অলৌকিক ঘটনা দেখানোও কখনও কখনও বেশ রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠে। ভূত বা অশরীরী জীবের অস্তিত্ব থাকুক বা না থাকুক, মানুষের ইতিহাসে ঘুরে-ফিরে এদের প্রসঙ্গ বারবার এসেছে।
ভূত ও প্রেতচর্চা নিয়ে বিভিন্ন সময় বিচিত্র সব সংগঠন গড়ে উঠেছে। মানুষের বিচিত্র সব রোমাঞ্চের খোরাক পূর্ণ করা ছাড়াও এ জাতীয় সংগঠনকে বিভিন্ন সময় অন্যান্য ভূমিকায়ও দেখা গেছে। এমনকি রাজনীতির জটিল অঙ্গনও তার থেকে বাদ থাকেনি। তেমনি এক সংগঠনের রোমাঞ্চকর গল্প আজ হবে।
১৮৭৫ সালের ১৭ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘থিওসোফিক্যাল সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। রাশান বংশোদ্ভূত হেলেনা পেত্রোভনা ব্লাভাৎস্কি ও অবসরপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার কর্নেল হেনরি অলকট এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। মাদাম ব্লাভাৎস্কি প্রেত বিশেষজ্ঞ হিসেবে বেশ খ্যাতি পেয়েছিলেন। তিনি অন্ধকার ঘরে বিদেহী আত্মাদের আহবান করতেন। সেই প্রেতাত্মারা তার কাছে এসে বিভিন্ন অজানা খবর ও পরামর্শ-নির্দেশ দিয়ে যেতেন! নির্দেশ ও পরামর্শ সাধারণত লেখা আকারে দেওয়া হতো। ‘থিওসোফিক্যাল সোসাইটি’তে নির্দেশদাতা বিদেহীদের ‘মহাত্মা’ নামে ডাকা হতো।
এই সংগঠনের আত্মা নামানো এবং আরো অনেক অলৌকিক কার্যকলাপ নিয়ে পৃথিবীজুড়ে একসময় ব্যাপক জল্পনাকল্পনা হয়েছে। বিভিন্ন দেশে এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। উনিশ শতকের শেষ নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৬০০ এবং ভারতে ৩০০ শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। ১৮৮৮ সালে ব্লাভাৎস্কির লেখা ‘সিক্রেট ডকট্রিন’ বইটি প্রকাশিত হলো। ভূত-প্রেত ও অলৌকিক ঘটনার গোপন রহস্য ও ক্ষমতা আয়ত্ব করতে অগণিত পাঠক বইটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।
‘থিওসোফিক্যাল সোসাইটি’র জনপ্রিয়তার ঢেউ সেসময় বাংলাতেও এসে পড়েছিলো। ১৮৮২ সালে ‘বেঙ্গল থিওসোফিক্যাল সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এর লেখক প্যারিচাঁদ মিত্র এর সভাপতি হয়েছিলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রাজা শ্যামাশঙ্কর রায় সভাপতি হয়েছিলেন। মাদাম ব্লাভাৎস্কি ও কর্নেল অলকট জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতেও এসেছিলেন। বিখ্যাত পত্রিকা ‘অমৃতবাজার’ এর সম্পাদক শিশিরকুমার ঘোষও থিওসোফিস্টদের উপর পরম আস্থাশীল হয়ে উঠেছিলেন।
শুধু মানুষের কৌতূহলের জগতে নয়, ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনেও ভূতপ্রেত চর্চার এই সংগঠনের প্রভাব বিস্তার করার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছিলো।
বিদ্রোহী ব্যক্তিত্ব ও নারী অধিকারের অন্যতম প্রবক্তা হিসেবে অ্যানি বেসান্ট একসময় বেশ খ্যাতি পেয়েছিলেন। প্রেতচর্চা নিয়েও তার ছিলো সমান আগ্রহ। মাদাম ব্লাভাৎস্কির ‘সিক্রেট ডকট্রিন’ পাঠ করে তিনি থিওসোফি ও ভূতপ্রেত বিষয়ে রীতিমত আসক্ত হয়ে পড়েন। আয়ারল্যান্ডে জন্মানো এই ভদ্রমহিলা ১৮৯৩ সালে ভারতে আসেন। মাদাম ব্লাভাৎস্কির মৃত্যুর পর অ্যানি বেসান্ট ও উইলিয়াম জাজ ‘থিওসোফিক্যাল সোসাইটির’ কার্যক্রম চালাতে থাকেন। একসময় কর্নেল অলকট, উইলিয়াম জাজ ও অ্যানি বেসান্টের মধ্যে তুমুল মতবিরোধ শুরু হয়। উইলিয়াম জাজের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়েছিলো।
মাদাম ব্লাভাৎস্কির আসন দখল করার জন্য উইলিয়াম জাজ একেবারে উঠে-পড়ে লেগেছিলেন। নিজের আধ্যাত্মিক স্থান প্রমাণ করতে বিদেহী আত্মাদের চিঠি ও লিখিত নানা নির্দেশ সংগঠনে দেখাতে শুরু করলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ১৮৯৪ সালে ‘থিওসোফিক্যাল সোসাইটি’ থেকে উইলিয়াম জাজ প্রতারণার অভিযোগে বহিষ্কৃত হলেন। তবে ভারতের শাখায় অপাংক্তেয় হলেও আমেরিকার শাখাগুলোতে জাজ অবিসংবাদিত ছিলেন।
অ্যানি বেসান্ট ভারতের থিওসোফিস্টদের কাছে নিজের প্রভাব অপরাজিত রাখতে সচেষ্ট হলেন। উইলিয়াম জাজের মতো তিনিও বিদেহী আত্মাদের লেখা চিঠি ও নির্দেশ দেখাতে শুরু করলেন। তবে ধুরন্ধর এই মহিলা বুঝতে পেরেছিলেন, তার অবস্থান পাকাপোক্ত করতে শুধু এই উপায় যথেষ্ট নয়। বরং ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা ও হিন্দুধর্মীয় আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহার করে সাফল্য হাসিল করা বেশি সহজ হবে। সুতরাং তিনি সেই পথেই গেলেন।
ভারতীয় থিওসোফিস্টদের নেতৃত্বের পদে আসীন হয়ে অ্যানি বেসান্ট ঘোষণা করলেন, অদৃশ্য মহাত্মারা উইলিয়াম জাজ নয়, তার সাথেই যোগাযোগ রাখেন! তার দাবি- ভগবান সর্বশক্তিমান; তিনি মহাত্মাদের মাধ্যমে পৃথিবীতে তার শাসন পরিচালনা করেন। পৃথিবীতে ভগবানের প্রধান প্রতিনিধি হচ্ছেন পৌরাণিক চরিত্র সনৎকুমার। তিনি গোবী মরুভূমিতে অজ্ঞাতবাস করেন। জগতের কার্যকরী চালক হিন্দু স্মৃতিশাস্ত্রের প্রণেতা মনু। তাকে অলক্ষ্যে সাহায্য করেন বুদ্ধ, খ্রিস্ট, জরথুষ্ট্র, ঋষি অগস্ত্য প্রমুখ মহাত্মাগণ!
জনসমাজে অ্যানির প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা ছিলো অসাধারণ। তদুপরি এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী তার পরম অনুরাগী হয়ে উঠেছিলেন। ফলে প্রচারযন্ত্রের কল্যাণে ভারতবর্ষ ও বহির্বিশ্বে তার নাম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায়ই তিনি বিদেহী আত্মা আহবানের আসর বসাতেন। দেখাতেন অদ্ভুত সব কান্ড। ১৮৯৪ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন- তাকে বিদেহীদের সাথে সংযোগ স্থাপনের প্রায়োগিক শিক্ষা দিয়েছিলেন মাদাম ব্লাভাৎস্কি। তার বই, কাগজ বা অন্যকিছু প্রয়োজন হলে নাকি আপনাআপনি হাতে এসে পড়তো! যতবার মাদাম সঙ্গীদের নিয়ে তাস খেলেছেন- তাস নিজে থেকেই তার হাতে এসে পড়েছে!
এবার অ্যানি ভারতীয় আধ্যাত্মিক গুরুর পদে আসীন হবার দিকে পা বাড়ালেন। আত্মার অমরত্ব, জন্মান্তরবাদ ও হিন্দু বর্ণাশ্রম প্রচার করতে লাগলেন। অভাব অনটন ও সামাজিক বৈষম্যের জন্য সরাসরি পূর্বজন্মের পাপের ব্যাখ্যা দিয়ে উল্টো ভুক্তভোগীদের দায়ী করলেন! তার দাবি ছিলো- পূর্বজন্মে তিনি হিন্দু পণ্ডিত ছিলেন। এই জন্মে পশ্চিমা পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অসারতা প্রমাণ করতে তিনি আয়ারল্যান্ডে জন্মেছেন। নিজের ভারতীয় পরিচিতি হিসেবে ‘আন্নাবাঈ’ নাম ঘোষণা করলেন (অ্যানি নামের সাথে মিল রেখে)। ফলে ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনের একশ্রেণীর মানুষ তার প্রবল অনুরাগী হয়ে উঠলো।
১৮৯৩ সালের শেষপ্রান্তে অ্যানি ভারত সফর শুরু করলেন। বিদেহী আত্মা, ভূতপ্রেত ও মহাত্মাদের নিয়ে বক্তৃতা দেবার পাশাপাশি হিন্দুধর্ম ও জাতিভেদ নিয়েও বললেন। এভাবে ধীরে ধীরে পরাধীন ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনেও তার আবির্ভাব হলো।
সেসময় ভারতের বিভিন্ন স্থানে ইংরেজবিরোধী মনোভাব ধীরে ধীরে বেড়ে চলছিলো। অ্যানি তার প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তিত্ব বিশেষ কৌশলে চালানোর পথে এলেন। বিভিন্ন বক্তব্য ও ঘোষণায় তিনি জানালেন- রাজভক্তি হিন্দুধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ! গণতন্ত্র অথবা সমাজবাদী আন্দোলন সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকর। এসব আন্দোলনে দরিদ্র ও নীচ মানুষের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হয়। ফলে আধ্যাত্মিকতা লোপ পায়! এজন্য ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্রের প্রতি বেশি ঝোঁক দেখা যায়। তার মতে, প্রাচীন হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণে রাজা ও রাজবংশের প্রতি ভক্তির কোনো বিকল্প নেই। ভারতের মানুষ এ কথা বুঝতে পারছে বলেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি অনুগত থেকে হিন্দু ও ভারতীয় জাতীয়তাকে আপন করে নিচ্ছে! হিন্দুধর্ম আন্দোলনের কথাও তিনি বেশ জোর দিয়ে বলেছিলেন।
অ্যানি বেসান্ট ক্রমাগত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিরোধী হয়ে উঠছিলেন। ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন- ভারতবর্ষে গণতন্ত্র কখনই সুফল বয়ে আনবে না। ভারতীয় মানস ও গণতন্ত্র সম্পূর্ণ দুই মেরুর বিষয়। গণতন্ত্রের ফলে সংখ্যালঘু অভিজাত ও উচ্চবর্ণের মানুষ সংখ্যাগুরু নীচ মানুষের দ্বারা শাসিত হবে! বরং ব্রিটিশ রাজের অধীনেই এই ভূখণ্ডে ভারতীয় ও হিন্দু আত্মপরিচয়ে জীবনযাপন আরো বেশি সম্মানজনক হবে।
অ্যানি বেসান্ট একদিকে প্রেতচর্চা, হিন্দু পুনরুজ্জীবন ও ভারতীয় আত্মপরিচয়ের বিষয় নিয়ে প্রভাব বিস্তার করেছেন- অন্যদিকে সর্বশক্তি দিয়ে সেই একই বিষয় কাজে লাগিয়ে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি আরো মজবুত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। মজার ঘটনা হচ্ছে, এমন পরস্পরবিরোধী ঘটনার প্রবক্তার পাশে সেসময়ের জাতীয়তাবাদীদের অনেকেই দাঁড়িয়েছিলেন। বালগঙ্গাধর তিলকের ‘মারাঠা’ পত্রিকায় অ্যানি ও তার প্রচার-প্রসার নিয়ে সম্পাদকীয় ছাপা হয়। এতে বলা হয়- প্রেতচর্চা বা বিদেহী আত্মা নিয়ে তার দাবি সত্য বা মিথ্যা যা-ই হোক, ভারতবাসীর মনে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগানোয় তার অবদান অসীম! এজন্য অ্যানির সমালোচনা হলে তার শক্ত প্রতিবাদ হবে।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য অ্যানি বেসান্টকে ১৯২০ সালে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির পদে নির্বাচিত করা হয়। ১৯৩৩ সালে এই বিতর্কিত বিশাল ব্যক্তিত্ব মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তার সম্মানে সড়কও তৈরি করা হয়েছিলো। তার সমালোচনাও কম হয়নি- অনেকে তাকে ভণ্ড, প্রতারক ও মিথ্যাবাদী আখ্যায়িত করেছেন। তবে নিজের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও প্রভাববিস্তারের ক্ষমতার কারণে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।