.jpeg?w=1200)
‘দূত অবধ্য’, অর্থাৎ ‘দূতকে বধ/হত্যা করা উচিত নয়’– এই প্রথাটি বহু আগে থেকে চলে আসছে। প্রায় প্রতিটি সভ্যতাতেই দূতদেরকে বিশেষ সুরক্ষার যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হতো। আধুনিক আন্তর্জাতিক রীতি অনুসারেও দূত/রাষ্ট্রদূতদের হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত গর্হিত কাজ। কিন্তু এরপরও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালনকালে রাষ্ট্রদূতরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। রুশ রাষ্ট্রদূতরাও এর ব্যতিক্রম নন।
আধুনিক রাশিয়ার ইতিহাসে চার জন রুশ রাষ্ট্রদূত দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন রুশ সাম্রাজ্যের ‘অতি সম্মানিত’ রাষ্ট্রদূত, সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘বিপ্লবী’ রাষ্ট্রদূত এবং রুশ ফেডারেশনের ‘পেশাদার’ রাষ্ট্রদূত। চলুন, জেনে নেয়া যাক, কেন এবং কীভাবে এই চারজন রুশ রাষ্ট্রদূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন?
আলেক্সান্দর গ্রিবোয়েদভ
আলেক্সান্দর গ্রিবোয়েদভ ছিলেন ইরানে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত। ১৭৯৫ সালে রাশিয়ার মস্কোয় জন্মগ্রহণকারী গ্রিবোয়েদভ ছিলেন একজন কবি, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও কূটনীতিবিদ। তিনি ছিলেন একজন মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা। ১৮২৬–১৮২৮ সালের রুশ–ইরানি যুদ্ধে রাশিয়ার নিকট ইরানের পরাজয়ের পর উভয় পক্ষ ‘তুর্কমেনচাই চুক্তি’তে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে রাশিয়া ইরানের কাছ থেকে এরিভান খানাত, নাখচিভান খানাত, তালিশ খানাতের অবশিষ্টাংশ এবং ওর্দুবাদ ও মুঘান অঞ্চলদ্বয় (বর্তমান আর্মেনিয়া, আজারবাইজানের দক্ষিণাঞ্চল ও নাখচিভান স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র এবং তুরস্কের ইগদির প্রদেশ) লাভ করে; ইরান রাশিয়াকে ২ কোটি রৌপ্য রুবল ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হয়; কাস্পিয়ান সাগরে রুশ একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইরানে বসবাসকারী রুশ নাগরিকরা রাশিয়ায় প্রত্যাবর্তনের অধিকার লাভ করে।

এই চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে গ্রিবোয়েদভের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। যুদ্ধ শেষে তিনি ইরানে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন। তুর্কমেনচাই চুক্তি অনুযায়ী ইরানে বসবাসরত জর্জীয় ও আর্মেনীয়রা ইরান থেকে রাশিয়ায় চলে যাওয়ার অধিকার লাভ করেছিল, এবং বহু জর্জীয় ও আর্মেনীয় তেহরানে অবস্থিত রুশ দূতাবাসের মাধ্যমে ইরান ত্যাগ করে। ১৮২৯ সালে ইরানের শাহ ফতেহ আলী শাহ কাজারের আর্মেনীয় কোষাধ্যক্ষ মির্জা ইয়াকুব মার্কারিয়ান রুশ আর্মেনিয়ায় চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তেহরানে অবস্থিত রুশ দূতাবাসে আশ্রয় নেন। কিন্তু মার্কারিয়ান ইরানি সরকারের অনেক গোপন তথ্য জানতেন, এবং এজন্য তার দেশত্যাগের সম্ভাবনাকে ইরানি কর্মকর্তারা হুমকির চোখে দেখতে থাকেন। ইতোমধ্যে শাহের আত্মীয় আল্লাহার খান কাজারের হারেম থেকে খ্রিস্টান–বংশোদ্ভূত দুই নারী পালিয়ে রুশ দূতাবাসে আশ্রয় নেয়।
শাহ মার্কারিয়ানকে রাজকীয় তহবিল তছরুপের দায়ে অভিযুক্ত করেন, এবং মার্কারিয়ান ও উল্লিখিত দুই নারীকে তার কাছে হস্তান্তর করার জন্য গ্রিবোয়েদভকে আহ্বান করেন। কিন্তু আশ্রয়প্রার্থীদের হস্তান্তর করতে গ্রিবোয়েদভ অস্বীকৃতি জানান। কূটনৈতিক রীতি অনুযায়ী রুশ দূতাবাসের ওপর সরাসরি বলপ্রয়োগ করা ইরানি সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এজন্য ইরানি কর্মকর্তারা ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন। তাদের প্ররোচনায় ধর্মীয় নেতারা তেহরানের বাজার ও মসজিদগুলোতে রুশদের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে উত্তেজিত করতে শুরু করে। যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে এমনিতেই ইরানিদের মধ্যে রুশবিরোধী মনোভাব অত্যন্ত তীব্র ছিল। তদুপরি, শাহের প্রতি কথিত অপমানের সংবাদে তাদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। রুশ সূত্রগুলোর মতে, ইরানে রুশ প্রভাব খর্ব করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশরাও এই রুশবিরোধী উত্তেজনা সৃষ্টিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল।
১৮২৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি হাজার হাজার উত্তেজিত জনতা তেহরানের রুশ দূতাবাস আক্রমণ করে। দূতাবাসের কসাক রক্ষীরা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে, কিন্তু জনতার স্রোতের মুখে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে স্বল্পসংখ্যক কসাক রক্ষীর প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। ক্ষিপ্ত জনতা দূতাবাসের ভিতরে ঢুকে পড়ে এবং দূতাবাসে অবস্থানরত সকলকে নির্বিচারে খুন করে। গ্রিবোয়েদভ বন্দুক ব্যবহার করে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন, কিন্তু তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান এবং তার লাশকে তার কার্যালয়ের জানালা দিয়ে বাইরে নিক্ষেপ করা হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা তার লাশের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করে, সেটিকে রাস্তা দিয়ে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় এবং টুকরো টুকরো করে কেটে ভাগাড়ে নিক্ষেপ করে। তার লাশ শনাক্ত করার কোনো উপায় ছিল না বললেই চলে, কেবল তার হাতে বহুদিন আগের একটি ডুয়েলে প্রাপ্ত আঘাতের চিহ্ন দেখেই তার লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল।

অনুরূপভাবে, মার্কারিয়ান, হেরেম থেকে পলাতক দুই নারী ও দূতাবাসের অন্যান্য সবাইকে উন্মত্ত জনতা খুন করে। ৩৭ থেকে ৪১ জন এই হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়। রুশ দূতাবাসের কেবল একজন কর্মচারী পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে সমর্থ হয়। অন্যদিকে, গ্রিবোয়েদভ ও কসাক রক্ষীদের গুলিতে কয়েক ডজন আক্রমণকারী নিহত হয়। এসময় রাশিয়া ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, এবং ইরানের বিরুদ্ধে নতুন করে একটি যুদ্ধ শুরু করার কোনো ইচ্ছে তাদের ছিল না। অন্যদিকে, ইরানি কর্মকর্তাদের মূল উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছিল এবং তাদেরও রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার কোনো আগ্রহ ছিল না। ফলে উভয় পক্ষ কূটনৈতিকভাবে এই সঙ্কট সমাধান করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ফাতেহ আলী শাহ কাজার তার নাতি খসরু মির্জাকে মস্কোয় প্রেরণ করেন। খসরু গ্রিবোয়েদভের হত্যাকাণ্ডের জন্য রুশ সম্রাট প্রথম নিকোলাইয়ের নিকট ইরানের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন এবং বিখ্যাত ‘শাহ হীরা’সহ বহু মূল্যবান সামগ্রী রুশ সম্রাটকে উপহার হিসেবে প্রদান করেন। এর মধ্য দিয়ে গ্রিবোয়েদভের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটিকে ইতিহাসের একটি তাৎপর্যহীন প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করা হয়।
ভাৎস্লাভ ভরোভস্কি
ভাৎস্লাভ ভরোভস্কি ছিলেন ইতালিতে নিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত। ১৮৭১ সালে রাশিয়ার মস্কোয় একটি জাতিগত পোলিশ পরিবারে জন্মগ্রহণকারী ভরোভস্কি ছিলেন একজন বলশেভিক বিপ্লবী, সাহিত্য সমালোচক ও কূটনীতিবিদ। ১৮৯৫ সাল থেকে তিনি রুশ সমাজতন্ত্রী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ১৯০৩ সালে বলশেভিক দলের সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯০৫ ও ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন, এবং বলশেভিকদের ক্ষমতা লাভের পর তিনি সদ্যপ্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন। ১৯২১ সালে তাকে ইতালিতে সোভিয়েত রাশিয়ার (পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের) রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করা হয়।

১৯২৩ সালে তুরস্ক এবং তুর্কি প্রণালীদ্বয়ের (বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালী) ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তি ও তুরস্ক সুইজারল্যান্ডের লুজানে একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি কৃষ্ণসাগরীয় রাষ্ট্র এবং ‘তুর্কি প্রণালীদ্বয়’ ভূকৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এজন্য লুজান সম্মেলনে সোভিয়েত স্বার্থ যাতে রক্ষিত হয় সেজন্য সোভিয়েত সরকার ভরোভস্কিকে এই সম্মেলনে সোভিয়েত প্রতিনিধি হিসেবে যোগদানের নির্দেশ দেয়। ১৯২৩ সালের এপ্রিলে ভরোভস্কি দুইজন অ্যাটাশেসহ ইতালি থেকে সুইজারল্যান্ডে যান এবং লুজানের একটি হোটেলে অবস্থান করতে থাকেন। এসময় সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে বলশেভিকবিরোধীরা সোভিয়েত প্রতিনিধিদের প্রতি নানা ধরনের হুমকি দিচ্ছিল। সুইস সরকার তাঁদের নিরাপত্তার জন্য কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে নি।
১৯২৩ সালের ১০ মে রাতে ভরোভস্কি ও তার দুই সহযোগী তাদের হোটেলের রেঁস্তোয়ায় বসেছিলেন। এসময় দুইজন যুবক সেখানে এসে তাদের উদ্দেশ্যে গুলি ছোঁড়ে। ভরোভস্কির দুই সহযোগী প্রাণে বেঁচে যান, কিন্তু ভরোভস্কি নিহত হন। আক্রমণকারী দুই যুবক ছিল মরিস কনরাদি (যে ভরোভস্কিকে গুলি করেছিল) এবং আর্কাদি পোলুনিন। কনরাদি ছিল রাশিয়ায় জন্মগ্রহণকারী একজন সুইস, যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রুশ সেনাবাহিনীর পক্ষে এবং রুশ গৃহযুদ্ধে বলশেভিকবিরোধী শ্বেত ফৌজের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল। কনরাদির পরিবারের প্রায় সকলেই বলশেভিকদের হাতে নিহত হয়েছিল, এবং এজন্য সে বলশেভিকদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। এই হত্যাকাণ্ড ছিল সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ।

সুইস সরকার কনরাদি ও পোলুনিনকে গ্রেপ্তার করে, কিন্তু আদালতে তাদের বিচারের সময় তাদের সমর্থকরা রাশিয়ায় বলশেভিকদের নিষ্পেষণ সম্পর্কে তুলে ধরে এবং কার্যত এটি ভরোভস্কির হত্যাকাণ্ডের ফৌজদারি বিচার নয়, বরং বলশেভিক মতবাদের নৈতিক বিচারে পরিণত হয়। আদালতটি কনরাদি ও তার সহযোগীকে মুক্তি প্রদান করে। এই ঘটনায় সোভিয়েত ইউনিয়ন যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়। তারা সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছেদ করে, দেশটির সঙ্গে কোনো ধরনের অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, এবং শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষ ছাড়া অন্য সকল সুইস নাগরিকের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৪৬ সালের আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সুইজারল্যান্ডের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়নি।
পিওতর ভয়কভ
পিওতর ভয়কভ ছিলেন পোল্যান্ডে নিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত। ১৮৮৮ সালে রাশিয়ার কের্চে একটি জাতিগত ইউক্রেনীয় পরিবারে জন্মগ্রহণকারী ভয়কভ ছিলেন একজন বলশেভিক বিপ্লবী ও কূটনীতিক। অল্প বয়সে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া ভয়কভ ১৯০৫ ও ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন, এবং বলশেভিকদের ক্ষমতা লাভের পর বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। ১৯১৭ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত তিনি একাতেরিনবুর্গ শহর দুমার সভাপতি ছিলেন, এবং এসময় সর্বশেষ রুশ সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাইকে সপরিবারে হত্যা করার সঙ্গে ভয়কভ জড়িত ছিলেন।

পরবর্তীতে তিনি বিভিন্ন কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন। সোভিয়েত সরকার ভয়কভকে কানাডায় সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত করতে চেয়েছিল, কিন্তু ভয়কভ রুশ সম্রাটের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে কানাডীয় সরকার তাকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। অনুরূপভাবে, ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও ভয়কভের ব্রিটেনে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ১৯২৪ সালে সোভিয়েত সরকার ভয়কভকে পোল্যান্ডে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত করে। পোলিশ সরকারও প্রথমে ভয়কভকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, কিন্তু সোভিয়েতদের চাপে তারা তাকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়।
১৯২৭ সালের ৭ জুন পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশর একটি রেল স্টেশনে ভয়কভ একজন সোভিয়েত কূটনীতিক স্বাগত জানাতে এসেছিলেন। এসময় একজন যুবক তাকে লক্ষ্য করে দুইটি গুলি করে এবং বলে ওঠে যে, “রাশিয়ার জন্য মরো!” গুলিবিদ্ধ ভয়কভ পাল্টা গুলি করার জন্য পিস্তল বের করেন, কিন্তু গুলি করতে পারার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে। আক্রমণকারী যুবক স্বেচ্ছায় পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। উক্ত যুবকের নাম ছিল বোরিস কোভেরদা। রাশিয়ায় জন্মগ্রহণকারী কোভেরদা পুলিশকে জানায় যে, রাশিয়ায় বলশেভিকদের হাতে নিহত লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য এবং রুশ সম্রাটের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কারণে সে ভয়কভকে খুন করেছে।
পোল্যান্ডের জনসাধারণ ও প্রচারমাধ্যম কোভেরদার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল, এবং তাকে তারা বীর হিসেবে আখ্যায়িত করে। পোলিশ সরকারও কোভেরদাকে শাস্তি দিতে আগ্রহী ছিল না, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের চাপে তারা কোভেরদার বিচার করে এবংং তাকে আজীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। অবশ্য পরবর্তীতে তার এই সাজা কমিয়ে ১৫ বছর কারাদণ্ডে নিয়ে আসা হয়, এবং ১০ বছর কারাভোগের পর ১৯৩৭ সালে কোভেরদা মুক্তি লাভ করে।

সোভিয়েত সরকার অবশ্য এই বিচার নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না। তারা সন্দেহ করছিল, ভয়কভের হত্যাকাণ্ড কোভেরদার একার কাজ নয়, বরং সোভিয়েতবিরোধী কোনো গুপ্ত সংগঠন এর পিছনে জড়িত। কিন্তু পোলিশ সরকার এটি নিয়ে কোনো তদন্ত করেনি, এবং ভয়কভের হত্যাকাণ্ডের বিচারও তারা অনেকটা অনিচ্ছাতেই করেছিল। এসময় পোল্যান্ড ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে পারস্পরিক অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে আলোচনা চলছিল। ভয়কভের হত্যাকাণ্ডের পর সোভিয়েত সরকার পোল্যান্ডের ওপর চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে এই আলোচনা ভেঙে দেয়, কিন্তু এর বাইরে আর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ১৯৩১ সালে সোভিয়েত–পোলিশ অনাক্রমণ চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনা পুনরায় আরম্ভ হয়।
আন্দ্রেই কার্লভ
আন্দ্রেই কার্লভ ছিলেন তুরস্কে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত। ১৯৫৪ সালে রাশিয়ার মস্কোয় জন্মগ্রহণকারী কার্লভ ছিলেন একজন রুশ কূটনীতিক। ১৯৮০–এর দশক থেকে কার্লভ উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থিত সোভিয়েত দূতাবাসদ্বয়ে বিভিন্ন পদমর্যাদায় কর্মরত ছিলেন, এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি উত্তর কোরিয়ায় রুশ রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে তিনি তুরস্কে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত হন।

এসময় সিরীয় গৃহযুদ্ধ চলছিল এবং যুদ্ধ শুরুর প্রথম পর্যায় থেকেই রাশিয়া ও তুরস্ক বিরোধী দুই পক্ষকে সমর্থন দিচ্ছে। রাশিয়া সিরীয় সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে এবং ২০১৫ সাল থেকে সিরীয় সরকারের পক্ষে সিরিয়ায় সীমিত মাত্রায় সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে। অন্যদিকে, তুরস্ক বিভিন্ন সিরীয় মিলিট্যান্ট গ্রুপকে সমর্থন দিচ্ছে এবং ২০১২ সাল থেকে সিরিয়ার অভ্যন্তরে বিভিন্ন সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। ২০১৫ সালের নভেম্বরে তুর্কি–সিরীয় সীমান্তে তুর্কি বিমানবাহিনী একটি রুশ বোমারু বিমানকে ভূপাতিত করলে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে, এবং ২০১৬ সালের জুনে তুর্কি রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান কর্তৃক এই ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করার পরই কেবল উভয় পক্ষের সম্পর্কের উন্নতি ঘটে।
এসময় সিরীয় সরকার রুশ সহায়তায় সিরিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর আলেপ্পোকে সিরীয় মিলিট্যান্টদের কাছ থেকে পুনর্দখল করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। এসময় রুশ বিমান হামলায় আলেপ্পোয় বেসামরিক জনসাধারণের মধ্যে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম প্রচার করে, এবং এটি তুর্কি ইসলামপন্থীদের মধ্যে রুশবিরোধী মনোভাবকে তীব্র করে তোলে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বেশ কয়েকদিন ধরে তুরস্কে রুশবিরোধী বিক্ষোভ চলছিল।
২০১৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর আন্দ্রেই কার্লভ তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় একটি চিত্র প্রদর্শনীতে অংশ নেন। এসময় একজন তুর্কি যুবক পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে কার্লভের ওপর গুলি চালায়। এসময় সে চিৎকার করে বলছিল, “আলেপ্পোকে ভুলে যেও না! সিরিয়াকে ভুলে যেও না!” তার গুলিতে কার্লভ গুরুতরভাবে আহত হন এবং আরো কয়েকজন সামান্য আহত হয়। তুর্কি পুলিশরা তার ওপর গুলি চালায়। কার্লভ ও উক্ত আক্রমণকারী উভয়কেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু কেউই প্রাণে বাঁচেনি। উক্ত যুবকের নাম ছিল মেভলুত মার্ত আলতিনতাশ। সে তুর্কি রায়ট পুলিশের সদস্য ছিল এবং পুলিশের পরিচয়পত্র দেখিয়েই প্রদর্শনীটিতে ঢুকেছিল। তুর্কি ও রুশ কর্মকর্তাদের প্রদত্ত তথ্যমতে, আলতিনতাশ তুরস্কে নিষিদ্ধ ‘গুলেন মুভমেন্টে’র সদস্য ছিল এবং সিরিয়ায় মিলিট্যান্টদের ওপর আক্রমণের জন্য রাশিয়ার ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। কার্লভের হত্যাকাণ্ড ছিল এরই বহিঃপ্রকাশ।

তুর্কি সরকার এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানায় এবং এটিকে রুশ–তুর্কি সম্পর্কে ব্যাঘাত ঘটানোর প্রচেষ্টা হিসেবে বর্ণনা করে। অনুরূপভাবে, বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু বিপরীতক্রমে, নিউ ইয়র্ক টাইম ও আল–জাজিরার মতো প্রচারমাধ্যমের ধারাভাষ্যকাররা এই হত্যাকাণ্ডের প্রতি মৌন সমর্থন ব্যক্ত করেছেন, এবং সিরীয় মিলিট্যান্টরাও এই হত্যাকাণ্ডকে উদযাপন করেছে। ইউক্রেনের একজন আইনসভা সদস্য কার্লভের হত্যাকারীকে বীর হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে, এই ‘বীরে’র নিজের পরিবারই তাকে দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বর্ণনা করেছে এবং তার মৃতদেহ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
ভাগ্যের আরো পরিহাস এই যে, ২০১৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় যখন রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন আন্দ্রেই কার্লভের হত্যাকাণ্ডের খবর পান, তখন তিনি একটি নাটক দেখতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু হত্যাকাণ্ডটির খবর পাওয়ার পর তার আর সেখানে যাওয়া হয়নি। সেই নাটকটি ছিল আলেক্সান্দর গ্রিবোয়েদভের লেখা!