ট্রাফালগারের পটভূমি
ফরাসি বিপ্লবের পথ ধরে উত্থান হলো ইতিহাসের অন্যতম সেরা জেনারেল, নেপোলিয়ন বোনাপার্টে’র। সেনাবাহিনী নিয়ে তিনি তুলোধুনো করে চলেছেন ব্রিটেন, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, প্রুশিয়াসহ অন্য সব দেশ। ফার্স্ট এবং সেকেন্ড কোয়ালিশন নেপোলিয়নের হাতে পরাস্ত হয়। ফলশ্রুতিতে হাবসবুর্গ শাসিত তৎকালীন পরাশক্তি অস্ট্রিয়া ১৮০১ সালে ছিটকে যায় যুদ্ধ থেকে। রাশিয়া আর জার্মান রাষ্ট্রগুলোও মেনে নিতে বাধ্য হয় তার শ্রেষ্ঠত্ব। এদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করে নেপোলিয়ন উঠেপড়ে লাগলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। ১৭৯৬-৯৭ সালে আয়ারল্যান্ড দিয়ে ইংল্যান্ডে আক্রমণের এক পরিকল্পনা ভেস্তে গিয়েছিল। তবে নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডে অবতরণের আশা ছাড়েননি। ১৭৯৮ সালের আইরিশ বিদ্রোহ তার আশার পালে জোর হাওয়া দিচ্ছিল।
এদিকে সাগরে তো আর নেপোলিয়ন নেই, তাই রয়্যাল নেভি সেখানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু স্থলে নেপোলিয়নের হাতে নাকাল হতে হতে ব্রিটিশরা বিরক্ত হয়ে যায়। ফলে প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট অপসারিত হন, তার স্থলাভিষিক্ত হলেন অ্যাডিংটন। তিনি ১৮০২ সালে ফ্রান্সের সাথে অ্যামিয়েন্স চুক্তি স্বাক্ষর করলেন। ত্রিনিদাদ আর শ্রীলঙ্কা রেখে ফ্রান্স, স্পেন আর ইউনাইটেড প্রভিন্সেস অফ হল্যান্ড (তৎকালীন ফ্রান্সের অধীন) থেকে ছিনিয়ে নেয়া সমস্ত উপনিবেশ ফিরিয়ে দেয়া হলো। স্যাভয়, উত্তর ইতালি এবং হল্যান্ডে ফরাসি কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়।
অ্যামিয়েন্স চুক্তি এক বছরের বেশি টেকেনি। ইতালি আর সুইজারল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ফ্রান্স অব্যাহত হস্তক্ষেপ করতে থাকে। হল্যান্ডেও তারা শক্তি বৃদ্ধি করল। নেপোলিয়ন ফরাসি অধিকৃত বন্দর ব্যবহার করে ইংল্যান্ডে কোনো ধরনের বাণিজ্যও নিষিদ্ধ করেন (Continental Blockade)। মাল্টাতেও ব্রিটিশ উপস্থিতিতে আপত্তি জানান তিনি। ভূমধ্যসাগরে নৌ-কর্তৃত্ব বজায় রাখতে মাল্টা কৌশলগতভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
নেপোলিয়ন আসলে ইংল্যান্ডে সরাসরি হামলা চালানোর খায়েশ তখন পর্যন্ত বিসর্জন দেননি। ১৮০১ সাল থেকেই ফ্রান্সের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে ব্যুঁলোর বন্দরে এই লক্ষ্যে জাহাজ ও সেনা প্রস্তুত করা হচ্ছিল। সেই বছরের ১৫ আগস্ট নেলসন একবার ব্যুঁলোতে হামলা চালান। তবে ব্রিটিশ অভিযান ব্যর্থ হয় এবং ফরাসিরা নতুন উদ্যমে প্রস্তুতি নিতে থাকে। অ্যামিয়েন্সের ফলে তাতে কিছুটা ভাটা পড়লেও তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। ওদিকে রয়্যাল নেভি অ্যামিয়েন্সের চুক্তির পরে তাদের অনেক কর্মী ছাটাই করে, বহু সরঞ্জাম ও রসদ বিক্রি করে দেয় এবং পুরনো অনেক জাহাজও ভেঙে ফেলে। ফলে তাদের প্রস্তুতিতে ঘাটতি ছিল।
নেপোলিয়নের দিক থেকে হুমকি বৃদ্ধি পেলে ১৮০৩ সালের ১৮ মে নতুন করে শুরু হয় যুদ্ধ। ফ্রান্সের আগ্রাসনের সামনে ইংল্যান্ড তখন একা। অন্য সবাই আগেই নেপোলিয়নের প্রভুত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। নেপোলিয়নিক ওয়ার্সের সময় ইংল্যান্ডই একমাত্র শক্তি ছিল যারা কখনোই নেপোলিয়নের কর্তৃত্ব মেনে নেয়নি।
ওদিকে নেলসন তখন সারেতে বাড়ি কিনে নিশ্চেষ্ট সময় কাটাচ্ছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর এমাও নেলসনের সাথে থাকতে শুরু করেন। যুদ্ধের দামামা বাজলে ১৮০৩ সালের ১৬ মে ভূমধ্যসাগরের ব্রিটিশ নৌবহরের দায়িত্ব পেলেন নেলসন। তার পতাকাবাহী জাহাজ বা ফ্ল্যাগশিপ ছিল এইচএমএস ভিক্টরি। পরবর্তী দুই বছর ধরে তিনি ফরাসি বন্দর ত্যুঁলো’ অবরোধ করে বসে রইলেন। ফলে সেখান থেকে ফরাসিরা বের হয়ে ব্যুঁলোর বহর এবং মিত্র স্প্যানিশ নৌবহরের সাথে যোগ দিতে পারছিল না। নেপোলিয়নের ইচ্ছা সম্মিলিত নৌবহরে করে ফরাসি বাহিনী নিয়ে সোজা ইংল্যান্ডে হানা দেয়া, কাজেই ত্যুঁলোর জাহাজগুলো তার দরকার। তাকে ঠেকাতে হলে রয়্যাল নেভির একমাত্র উপায় ফরাসি নৌবহর ধ্বংস করে দেয়া।
শত্রু সেনাপতি
ভিল্যেনুভ
ট্রাফালগারের লড়াইতে ফরাসি নৌবহরের নেতৃত্বে ছিলেন ভাইস অ্যাডমিরাল জ্যাঁ ব্যাপ্টিস্ত সিলভেস্ত্রে ভিল্যেনুভ (Pierre-Charles-Jean-Baptiste-Silvestre de Villeneuve)। তার সহকারী রিয়ার অ্যাডমিরাল ল্যু পিলি। ভিল্যেনুভ ১৮০৪ সালের আগস্টে অ্যাডমিরাল তুশ-ট্রেভিলের কাছ থেকে ত্যুঁলো’র কম্যান্ড গ্রহণ করেছিলেন। তবে নেপোলিয়ন ভিল্যেনুভের কর্মতৎপরতায় খুশি ছিলেন না এবং ১৮০৫ সালের শেষদিকে তাকে সরিয়ে অ্যাডমিরাল রসিলিকে কম্যান্ডার নিয়োগ দেন। কিন্তু রসিলি ত্যুঁলো’তে তখন অবস্থান করছিলেন না। তিনি আসতে আসতেই ভিল্যেনুভ বন্দর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন এবং ট্রাফালগারের যুদ্ধ সংঘটিত হয়ে যায়।
ভিল্যেনুভের জন্ম অভিজাত পরিবারে হলেও তিনি ফরাসি বিপ্লবের স্রোতে গা ভাসিয়েছিলেন। বেশ কয়েকটি বিপ্লবী সরকারের অধীনে নিজের আনুগত্য প্রমাণ করে খুব দ্রুত সামরিক বাহিনীর সিঁড়ি বেয়ে মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই তিনি রিয়ার অ্যাডমিরাল পদবীপ্রাপ্ত হন। তিনি আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ফরাসি নৌবাহিনীর সাথে অংশ নেন। ব্যাটল অফ নাইলে নেলসনের সাথে তার সংঘর্ষ হয়। একজন ভালো অফিসারের যেসব গুণ থাকা দরকার সবই তার ছিল, তবে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারার অক্ষমতা তাকে দুর্বল করে ফেলে। এছাড়া স্প্যানিশ মিত্রদের সাথে রণকৌশল নিয়ে মতবিরোধও তার পরাজয়ে একটি নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।
ডন ফ্রেডেরিকো গ্র্যাভিনা
অ্যাডমিরাল গ্র্যাভিনা (Federico Carlos Gravina y Nápoli) সিসিলিয়ান অভিজাত পরিবারের সন্তান। রাজপরিবারের সাথে তাদের সুসম্পর্ক ছিল। সেই সূত্রে তিনি যোগ দেন স্প্যানিশ নৌবহরে। সরকারি খরচে তিনি ইংল্যান্ডে এসে নৌযুদ্ধের কলাকৌশল শিক্ষা নিয়েছিলেন। ১৭৯৩ সালে বিপ্লবী ফরাসি বাহিনীর বিরুদ্ধে ত্যুঁলো’তে তিনি লড়াই করেন। পরে স্পেনের দক্ষিণ-পশ্চিমে কাদিজের বন্দর ঘিরে যুদ্ধ করেন ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে। ১৮০১ সালে তাকে পাঠানো হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজে, তৎকালীন মিত্র ফরাসি নৌবাহিনীর সাথে সমন্বয় সাধনের জন্য। এর তিন বছর পর নেপোলিয়ন যখন ফরাসি ক্ষমতা দখল করেন তখন স্পেন থেকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেন এই গ্র্যাভিনাই।
ট্রাফালগারের সংঘর্ষের সময় গ্র্যাভিনা ছিলেন ভিল্যেনুভের অধীনে। বয়সে ছোট ফরাসি কমান্ডারের অধীনে কাজ করতে স্প্যানিশ অ্যাডমিরালের অনীহা গোপন কিছু ছিল না। ফলে ফরাসি আর স্প্যানিশ বহরের মাঝে তৈরি হয়েছিল দূরত্ব, যা নেলসনকে সুবিধা পাইয়ে দিয়েছিল।
তৎকালীন পরিস্থিতি
নেপোলিয়ন তার সেনাবাহিনী নিয়ে স্থলে সবাইকে পর্যুদস্ত করে বেড়ালেও সাগরের খেলায় ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির কাছে ফরাসি বহর ছিল নাজেহাল। ব্রিটিশ জাহাজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সাগর মহাসাগর। ফরাসিদের প্রত্যেকটি বন্দর অবরুদ্ধ করে রেখেছে ব্রিটিশ নৌবাহিনী। ফলে সেখানে ঠুঁটো জগন্নাথের মতো বসে আছে নেপোলিয়নের যুদ্ধজাহাজ।
সাগরের বাণিজ্য পথ দখল করে রেখেছে ব্রিটিশরা। এই পথ ব্যবহার করে দেদারসে পৃথিবীর নানা দিকে তাদের উপনিবেশ থেকে আসছে অর্থ আর মূল্যবান দ্রব্যাদি। উপচে পড়া কোষাগার দিয়ে ব্রিটিশরা টাকা ঢালছে সেসব ইউরোপিয়ান রাজাদের পেছনে, যারা নেপোলিয়নকে টেনে নামাতে আদাজল খেয়ে লেগেছেন। ফলে নিজেদের সেনাবাহিনী মাঠে না নামিয়েই নেপোলিয়নকে বহু যন্ত্রণা দিচ্ছে ধুরন্ধর ব্রিটিশরা, যার পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে বলিষ্ঠ অর্থনীতি আর দুর্দমনীয় রয়্যাল নেভি। ফলে ব্রিটিশ আধিপত্য বানচাল করে মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের যে স্বপ্ন নেপোলিয়ন দেখছেন তা সফল করা যাচ্ছে না।
নেপোলিয়নের উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার। ব্রিটিশদের হেস্তনেস্ত করতে ইংল্যান্ডে আগ্রাসন চালাতে হবে। ১৮০৪ সালের জুলাই মাস থেকে তিনি এই পরিকল্পনার রূপরেখা চূড়ান্ত করতে থাকেন। ইংলিশ চ্যানেল, যা ফ্রান্স এবং ব্রিটেনকে আলাদা করে রেখেছে, তা পাড়ি দিয়ে কেন্টের তীরে ফরাসি বাহিনী নামানোর উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন নেপোলিয়ন। এই লক্ষ্যে ১৮০৫ সালের প্রারম্ভেই প্রায় ১,৬০,০০০ সেনা সন্নিবেশ করা হলো কেন্টের বিপরীতে ফরাসি ভূখণ্ডে। তাদের নিয়ে যাবার জন্য জাহাজ প্রস্তুত। কিন্তু এগুলো সবই যাত্রীবাহী জাহাজ, যুদ্ধ করার সক্ষমতা তাদের নেই।
এদিকে ইংলিশ চ্যানেল পাহারা দিচ্ছে রয়্যাল নেভির যুদ্ধজাহাজ। কাজেই নিরাপদে ফরাসি সৈনিকদের পার করতে ফরাসি নৌবাহিনীর সহায়তা দরকার। নেপোলিয়ন তাই চাইছিলেন ব্রিটিশ অবরোধ ভেঙে ফরাসি নৌবহর তাদের স্প্যানিশ মিত্রদের সাথে মিলিত হবে, তারপর সম্মিলিত বাহিনী ইংলিশ চ্যানেল দিয়ে নিরাপদে ফরাসি সেনাদের নিয়ে যাবে ইংল্যান্ডের মাটিতে।
নেপোলিয়নের পরিকল্পনা
১৮ জানুয়ারি, ১৮০৫।
ব্রিটিশ বাহিনীর ক্ষণিক অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে ত্যুঁলো থেকে বেরিয়ে এলেন ভিল্যেনুভ। নেপোলিয়নের নির্দেশ ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের দিকে পাল তোলার। আরেক ফরাসি বন্দর রশোফাঁ থেকে রিয়ার অ্যাডমিরাল মিসিয়েসিও অবরোধকারীদের চোখে ধুলো দিয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। কথা ছিল তিনিও ওয়েস্ট ইন্ডিজে ভিল্যেনুভের সাথে মিলিত হবেন। সেখানে ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোর উপর হামলা করে তাদের ব্যতিব্যস্ত করাই ছিল নেপোলিয়নের লক্ষ্য। কিন্তু নাবিকদের অনভিজ্ঞতা, জাহাজে অধিক মালামালের বোঝা এবং প্রতিকূল আবহাওয়া ভিল্যেনুভের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মাত্র তিন দিন পরেই তিনি আবার ত্যুঁলোতে ফিরে আসেন।
এদিকে ১৮০৪ সালের ১২ ডিসেম্বর স্পেন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে গ্র্যাভিনার নেতৃত্বে স্প্যানিশ নৌবহরকে ফরাসীদের সাহায্যে প্রেরণ করে। কাজেই নেপোলিয়ন নতুন ফন্দি করলেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি ওয়েস্ট ইন্ডিজে অপেক্ষমাণ মিসিয়েসিকে সেখানেই ফরাসি বহরের জন্য অপেক্ষা করার বার্তা পাঠানো হলো। একই দিন ফেরল বন্দরে অ্যাডমিরাল গর্ডনকে ব্রেশট থেকে আগত ফরাসি বাহিনীর জন্য প্রস্তুত থাকার আদেশ পাঠানো হয়।
দোসরা মার্চ ব্রেশটের ফরাসী নৌবাহিনীর ভাইস অ্যাডমিরাল গুন্টাম ২১টি যুদ্ধজাহাজ, ৬টি ফ্রিগেট এবং ২টি মালবাহী জাহাজ নিয়ে রওনা হবার নির্দেশ পান, তিনি পাল তোলেন ২৭ তারিখে। তার কাজ ছিল ফেরল অবরোধ করে বসে থাকা ব্রিটিশ বাহিনীকে হটিয়ে গর্ডনের সাথে একত্রিত হওয়া। এরপর তারা চলে যাবেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ভিল্যেনুভের দায়িত্ব ছিল নেলসনকে ফাঁকি দিয়ে ১১ জাহাজ আর ৬ ফ্রিগেটের বহর নিয়ে জিব্রাল্টার ধরে কাদিজের দিকে যাওয়া। সেখানে স্প্যানিশ জাহাজ অবরুদ্ধ হয়ে আছে। ভিল্যেনুভ ব্রিটিশদের তাড়িয়ে স্প্যানিশদের সাথে মিলিত হবেন। তারপর দুই মিত্র পাল তুলবেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের দিকে। সেখানে ভিল্যেনুভ ৪০ দিন অপেক্ষা করবেন গুন্টামের জন্য। এর মধ্যে গুন্টাম না পৌঁছলে তিনি আশেপাশের ব্রিটিশ সম্পত্তিতে আক্রমণ চালাবেন এবং ক্যানারি দ্বীপের পার্শ্ববর্তী জলপথ ধরে ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজ চলাচলে বাধা দেবেন। আরো ২০ দিন পেরিয়ে গেলেও যদি গুন্টামের দেখা না মেলে তাহলে ভিল্যেনুভ আবার কাদিজে ফিরে আসবেন নতুন নির্দেশের জন্য।
নেপোলিয়নের পরিকল্পনা সফল হলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের উপকূলে ফরাসি ও স্প্যানিশ নৌবাহিনীর একটি বিরাট যৌথ বহর গড়ে উঠত, যা রয়্যাল নেভির জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াত। এই বহর এগিয়ে আসতে ইংলিশ চ্যানেলের দিকে, এবং ফরাসি সেনাদলকে পৌঁছে দিত ইংল্যান্ডের জমিতে। শুরু হত ফরাসি আগ্রাসন।
ব্রিটিশ কৌশল
সাগরে আধিপত্য ধরে রাখতে ইংল্যান্ড ছিল মরিয়া। তাদের নৌবহর সংখ্যার দিক থেকে ফরাসি আর স্প্যানিশ সম্মিলিত বাহিনীর সমান। সরাসরি নৌযুদ্ধে জড়ানোর থেকে তারা শত্রুবন্দর অবরোধ করে রাখার কৌশল গ্রহণ করেছিল। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যেত। একদিকে বন্দর ছেড়ে শত্রু যুদ্ধজাহাজ বের হতে পারছিল না, অন্যদিকে দূরদূরান্ত থেকে আসা বাণিজ্য জাহাজ বন্দরে প্রবেশ করে মাল নামাতে ব্যর্থ হচ্ছিল। ফলে ফরাসি অর্থনীতির উপর ব্যাপক চাপ পড়ে। ১৮০৪ সাল থেকে ফরাসি বন্দর অবরোধের দায়িত্বে ছিলেন ত্যুঁলো’তে ভাইস অ্যাডমিরাল নেলসন, তার সাথে ১৩টি যুদ্ধজাহাজ আর ১২টি ফ্রিগেট। ৩৩টি জাহাজ নিয়ে ব্রেশটে ছিলেন অ্যাডমিরাল স্যার কর্ণওয়ালিস। রশোফাঁ , লরেইন, ফেরলসহ অন্যান্য বন্দরেও ব্রিটিশ কম্যান্ডাররা অবস্থান করছিলেন।
নেপোলিয়ন ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে ব্রিটেনে আক্রমণ করতে চাইছেন- এই খবর জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ভূখণ্ড রক্ষার মূল দায়িত্ব চলে যায় রয়্যাল নেভির ঘাড়ে, কারণ ইংলিশ চ্যানেল নিরাপদ রাখতে পারলে নেপোলিয়ন কখনোই ইংল্যান্ডে ঢুকতে পারবেন না। নেলসনকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে রয়্যাল নেভির সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হলো। তার কাজ ত্যুঁলো থেকে ফরাসিদের বের হতে বাধা দেয়া। কোনোক্রমে তারা যদি বের হয়েই যায় তাহলেও কিছুতেই যেন তারা ব্রেশটের বহরের সাথে মিলতে না পারে। পাশাপাশি জিব্রাল্টার, মাল্টা আর নেপলসের সুরক্ষার ভারও ছিল তার উপরে। দায়িত্ব পালনে টানা ১৮ মাস ধরে সাগরেই পতাকাবাহী জাহাজ এইচএমএস ভিক্টরি’তে থেকে যান নেলসন।
স্পেন আর ফ্রান্সের মিত্রতার খবর এলে ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল স্যার জন অর্ডেকে কয়েকটি জাহাজ দিয়ে জিব্রাল্টারের আশেপাশ সুরক্ষিত রাখার ভার দেয়া হলো। তার আরেকটি কাজ ছিল কাদিজের দিকে নজর রাখা। নেলসন নিজের কম্যান্ডে ভাগ পড়ায় কিছুটা ক্ষুণ্ণ হলেও দায়িত্ব পালনে ঢিল দিলেন না।
১৭ জানুয়ারি ভিল্যেনুভ যখন ত্যুঁলো থেকে বেরিয়ে যান তখন নেলসন তার দুটি ফ্রিগেটকে পাঠান ফরাসীদের অনুসরণ করতে। মূল বাহিনী নিয়ে তিনি ধরেন ইতালির পথ। সার্ডিনিয়ার উপকূলে তিনি ফ্রিগেট দুটির সাথে মিলিত হন। ভিল্যেনুভ তখন ছিলেন কাছাকাছিই। নেলসন ধারণা করলেন, তিনি হয়তো ইতালির উপকূলে ফরাসি সেনা নামাবেন। ভিল্যেনুভকে বাধা দিতে তিনি যখন প্রস্তুত হচ্ছিলেন তখন প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাস তাকে বাধ্য করে সার্ডিনিয়াতে কয়েকদিন অবস্থান করতে। এ সময় আরো কিছু ব্রিটিশ জাহাজ খবর আনে হয় ভিল্যেনুভ ত্যুঁলো ফিরে যাচ্ছেন, নাহলে তিনি অনুকূল বাতাসের সুযোগ নিয়ে ইতালির উপকূল ঘেঁষে গ্রীস হয়ে মিশরের পথ ধরবেন। নেলসন মনে করলেন, নেপোলিয়ন বোধহয় নতুন করে মিশরে আক্রমণ করতে যাচ্ছেন। তিনি পাল তুললেন আলেকজান্দ্রিয়ার দিকে। কিন্তু ভিল্যেনুভ ফিরে গেলেন ত্যুঁলোতে।