মৃত্যু আমাদের জীবনে এমন একটি ঘটনা যা এড়ানোর কোনো উপায় নেই, যার মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে জীবন নামক ছোট্ট একটি ভ্রমণের, শুরু হয় অনন্তকালের এক পথযাত্রা। একজন মানুষের সামাজিক মর্যাদা যা-ই হোক না কেন, তার ক্ষমতার হাত যতই লম্বা হোক না কেন মৃত্যুর কাছে একদিন না একদিন তাকে আত্মসমর্পণ করতেই হবে। এই মৃত্যু এবং এর ফল হিসেবে প্রাপ্ত মৃতদেহের সৎকার নিয়ে তাই যুগে যুগে, দেশে দেশে নানা রকম প্রথার জন্ম হয়েছে।
মোটামুটি পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালকে ইউরোপের ইতিহাসের মধ্যযুগ বলা চলে। আজকের দিনে অধিকাংশ দেশের কাছে উন্নয়নের মডেলে পরিণত হওয়া ইউরোপের নানা দেশ তখন নিমজ্জিত ছিলো কুসংস্কারের গাঢ় অন্ধকারে। মৃত্যু ও মৃতদেহ নিয়ে তাদের তেমনই কিছু কুসংস্কার এবং অদ্ভুত প্রথার কাহিনী নিয়ে সাজানো হয়েছে এ লেখা।
কোলাহলময় কবরস্থান
কবরস্থান নামক জায়গাটির কথা চিন্তা করলেই আমাদের মাঝে অদ্ভুত এক স্থবিরতা, শীতলতা চলে আসে। দৈনন্দিন জীবনের শত কাজের চাপেও হঠাৎ করে স্থায়ী এ আবাসস্থলের স্মরণ আমাদের মনোজগতে ঝড় তুলে দেয়, সচেতন করে তোলে কর্মফল সম্পর্কে।
আজকের দিনে আমরা যখন কোনো কবরস্থানের দিকে তাকাই, তখন সেখানে খুব কম মানুষেরই আনাগোনা দেখা যায়। এর সংরক্ষণের কাজে নিয়োজিত কর্মী ও মৃত আত্মীয়-স্বজনদের কবর পরিদর্শনে আসা মানুষদের ছাড়া তেমন আর কাউকে সেখানে দেখা যায় না, এটাই স্বাভাবিক। মৃত সেই ব্যক্তি যদি মানবজাতির ইতিহাসে বিখ্যাত কেউ হয়ে থাকেন, তাহলে ভিন্ন কথা।
মধ্যযুগে ইউরোপের কবরস্থানগুলো অবশ্য এমন ছিলো না। বরং সেগুলোর বর্ণনা শুনলে আজকালকার মানুষজন সেগুলোকে জনসমাবেশ বলে ভাবলেও বাড়াবাড়ি হবে না। স্থানীয় নির্বাচন, অপরাধীদের বিচার, ধর্মোপদেশ সংক্রান্ত অনুষ্ঠান এবং বিনোদনের উদ্দেশ্যে নাটক পর্যন্ত মঞ্চস্থ হতো তাদের কবরস্থানগুলোতে। এমনকি দেহ-ব্যবসায়ী নারীরা পর্যন্ত কবরস্থানের মতো জায়গায় নির্বিঘ্নে তাদের পাপাচার চালিয়ে যেত।
ইতিহাসবিদ ফিলিপ এরিসের মতে, তৎকালীন কবরস্থানগুলো ছিলো ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বেশ চমৎকার এক জায়গা। চার্চের অধীনে থাকায় জায়গাটির উপর কোনো প্রকার করারোপ করা হতো না। তাই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে কবরস্থানে এক টুকরো জমি ভাড়া পাওয়া ছিলো সৌভাগ্যের নামান্তর।
মৃতদেহ যখন খুনের সাক্ষী
কুসংস্কার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছিলো মধ্যযুগের ইউরোপীয় সমাজ ব্যবস্থাকে। এরই এক নমুনা ছিলো ‘ক্রুয়েন্টেশন‘। তৎকালীন মানুষজন বিশ্বাস করতো, খুনীর উপস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট মৃতদেহ থেকে পুনরায় রক্তপাত শুরু হবে। এ বিশ্বাসকেই ছোট এই শব্দ দ্বারা নির্দেশ করা হতো।
১৫৯৭ সালে প্রকাশিত ‘কিং জেমস’ ডেমনোলজি’ থেকে জানা যায়, “কোনো গোপন খুনের বেলায় যদি খুনী ব্যক্তি নিহতের ধারে-কাছে থাকে, তাহলে রক্ত এমনভাবে ফিনকি দিয়ে বেরোবে যেন স্বর্গে উপরওয়ালার কাছে তা হত্যাকারীর বিচারের জন্য ফরিয়াদ জানাচ্ছে“!
আদালতের মতো জায়গায় গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল ক্রুয়েন্টেশন। এমনকি আজ থেকে মাত্র চার শতক আগে পর্যন্তও বিচারকার্যে এর উপর নির্ভরতার কথা জানা যায়।
অস্থি রাখার আধার
আজকের ইউরোপ জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক সমৃদ্ধ, বলা চলে এদিক দিয়ে নেতৃত্বস্থানীয় অবস্থানেই এখন তারা আছে। তবে মধ্যযুগে এমনটা ছিলো না। জ্ঞানের অভাবে নানাবিধ রোগশোক সবসময় ইউরোপের ঘরগুলোতে লেগেই থাকতো। সেসব রোগের প্রতিকারে তারা দ্বারস্থ হতো নানাবিধ জাদুমন্ত্রের, যা আসলে ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। সেই সাথে বিভিন্ন রাজ্যের মাঝে লেগে থাকা যুদ্ধবিগ্রহ তো ছিলই। সব মিলিয়ে মৃত্যুর মিছিল সবসময় লেগেই ছিলো।
এর ফলে কবরস্থানগুলোতে স্থান সংকুলানে হিমশিম খেতে হতো কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু মৃতদেহকে তো জায়গা দিতে হবে। এজন্য বেশ চমৎকার এক উপায় বেছে নিয়েছিলো তারা। যখনই কবরস্থানগুলো মৃতদেহ দিয়ে প্রায় ভরে যেত, তখনই পুরাতন কবরগুলো থেকে কঙ্কাল উত্তোলন করা হতো। এরপর সেই কঙ্কালগুলো নিয়ে রাখা হতো আরেকটি ঘরে, যাকে বলে ‘অসুয়ারি (Ossuary)’ অর্থাৎ মৃতব্যক্তির অস্থি রাখার আধার। অসুয়ারিগুলোতে কিন্তু সেই অস্থিগুলোকে অযত্নে ফেলে রাখা হতো না, বরঞ্চ বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হতো। মৃত মানুষের হাড় দিয়ে সাজানো অদ্ভুত সুন্দর সেই জায়গাগুলো দেখলে মনে হবে ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ কথাটি বোধহয় এখান থেকেই এসেছে!
তবে মৃতদেহের স্থান সংকুলানের সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি এসব অসুয়ারির ধর্মীয় গুরুত্বও ছিলো। এখানে আসলে মানুষ আবার উপলব্ধি করতে পারতো ধনী-গরীব, আমির-ফকির নির্বিশেষে সবাইকেই একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে, কারো এর হাত থেকে নিস্তার নেই। অসুয়ারির কঙ্কালগুলোর সামনে খোঁদাই করা থাকতো একটি কথা, যার বাংলা অর্থ- “তোমরা এখন তেমন আছ, যেমন আমরা এককালে ছিলাম; আমরা এখন তেমন আছি, যেমন তোমরা একদিন হবে।”
আকস্মিক মৃত্যুর ভয়
সড়ক দুর্ঘটনা, আততায়ীর হামলা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে আকস্মিক মৃত্যু হতে পারে মানুষের। তবে এর সাথে সেই মানুষটির উপর সৃষ্টিকর্তার অখুশি হওয়ার মতো কারণ খুঁজতে যায় না আজকের দিনের কেউ। ওদিকে ঠিক এ কাজটিই করতো মধ্যযুগের ইউরোপের অধিবাসীরা। তারা মনে করতো, কেবলমাত্র পাপী ব্যক্তিদেরই আকস্মিক মৃত্যু হতে পারে, সৎ কিংবা সমাজে সম্মানীত ব্যক্তিদের নয়।
এটা তো কেবলমাত্র শুরু। তারা আরো ভাবতো যে, কেউ যদি আকস্মিকভাবে মারাই যায়, তাহলে তারা অতৃপ্ত আত্মা অনন্তকাল ধরে এই পৃথিবীর বুকেই ঘুরে বেড়াতে থাকবে, যাত্রা করতে পারবে না অনন্তলোকের উদ্দেশ্যে। এমন বিশ্বাসের পেছনে তাদের যুক্তি ছিলো- যেহেতু লোকটি পূতপবিত্র হয়ে ধর্মীয় গুরুর কাছে নিজের সকল দোষ স্বীকার করে ক্ষমাপ্রার্থনা করে যেতে পারে নি, অতএব পরকালে তার আত্মা শান্তির ছোঁয়া পাবে না।
‘আর্স মরিয়েন্দি’র মতো বই চালু ছিলো তখনকার সমাজে যেখানে জনগণকে ভালো ও খারাপ মৃত্যু কেমন হতে পারে সেই সম্পর্কে ধারণা দেয়া হতো। পূণ্যবানদের ক্ষেত্রে দেখানো হতো মৃত্যুশয্যাতেও তারা প্রার্থনা করে যাচ্ছে, আশেপাশে রয়েছে পরিবারের প্রিয়মুখগুলো। অন্যদিকে পাপীদের আশেপাশে রয়েছে নানারকম কিম্ভূতকিমাকার প্রাণী, যাদের আগমন হয়েছে নরক থেকে, দুর্ভাগা লোকটিকে নরকে টেনে নিতে।
মরণ নাচন
ফিরে যাওয়া যাক একটু আগেই আলাপ করা অসুয়ারিতে। মধ্যযুগ এবং রেনেসাঁর সময়কালে অসুয়ারিগুলোতে বিচিত্র কিছু চিত্র দেখা যেত। সেখানে ফুটে উঠতো মৃত মানুষদের প্রতিকৃতি, যারা নৃত্যের তালে তালে বিভিন্ন মানুষকে তাদের সাথে টেনে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলো। এসব ছবি Danse Macabre তথা মরণ নাচন নামে পরিচিত। এখানেও আসলে মানুষকে পরকালের প্রতি সচেতন করার চেষ্টা করা হতো। একজন মানুষ, সে যত বিত্তবান কিংবা যত দরিদ্রই হোক না কেন, মৃত্যুর হিমশীতল পরশ থেকে যে তার মুক্তি নেই, সেটা বোঝাতেই এসব ছবি আঁকা হতো।
তবে সকল মৃত্যুকে একইভাবে চিত্রায়িত করা হতো না। পঞ্চদশ শতকে ফ্রান্সে আঁকা এক মরণ নাচন ছবিতে দেখা যায় মৃত ব্যক্তি এক শিশুকে তার দলে ভেড়ানোর আগে নিজের কঙ্কাল-মুখটি ঢেকে নিচ্ছে, যেন বাচ্চাটি তাকে দেখে ভয় না পায়।
ট্রান্সি টম্ব
আমাদের পরিচিত সমাধিফলকগুলো থেকে বেশ আলাদা ছিলো তৎকালীন ট্রান্সি টম্বগুলো। এখানে ‘ট্রান্সি’ শব্দের সাহায্যে এমন একটি মৃতদেহকে বোঝানো হচ্ছে যা পচতে শুরু করেছে কেবল, তবে মানুষের অবয়ব এখনো তাতে বিদ্যমান। পচে যাওয়া সেই মৃতদেহগুলোতে নানা ভূতুড়ে জীব, সাপ, ব্যাংয়ের মতো প্রাণীও থাকতো।
কখনো কখনো এই ট্রান্সি টম্বগুলো দ্বিতলবিশিষ্ট হতো। উপরের তলায় দেখা যেত লোকটি প্রার্থনারত অবস্থায় পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে। নিচের তলায় সেই একই ব্যক্তির পচনশীল মৃতদেহের প্রতিমূর্তি ফুটিয়ে তোলা হতো।
ফ্র ওয়েল্ট
বিচিত্র এ ভাষ্কর্যগুলোর দেখা মিলবে জার্মানির বিভিন্ন ক্যাথেড্রালে। সেসব ভাষ্কর্য মূলত নারী-পুরুষের। সামনের দিক দিয়ে দেখলে সেই নারী কিংবা পুরুষকে বেশ স্বাস্থ্যবান এবং সুখী বলে মনে হবে। কিন্তু যেই না আপনি ভাষ্কর্যটিকে পেছন থেকে দেখবেন, তখনই খুঁজে পাবেন পচনশীল একটি দেহ। সেখানে ঘোরাফেরা করছে শূককীট, কীট, সাপ ও ব্যাঙ। অসুয়ারি ও মরণ নাচনের চিত্রের মতো ফ্র ওয়েল্টও মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে দেয়।
মৃত্যু নিশ্চিতকরণ
একজন মানুষ আসলেই মারা গিয়েছে কিনা তা বোঝার জন্য আজকের দিনে যন্ত্রপাতিই যথেষ্ট। কিন্তু মধ্যযুগীয় ইউরোপের বাসিন্দারা তো স্বাভাবিকভাবেই এখনকার প্রযুক্তিগুলো পায় নি। তাই একজন মানুষ আসলেই মারা গিয়েছে কিনা সেটা বুঝতে তারা বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করতো। ‘লা চ্যানসন ডি রোল্যান্ড’ মহাকাব্যে দেখা যায় শার্লেম্যাগনে রোল্যান্ডের মৃত্যুর পর তার পায়ের আঙুল কামড়ে ধরে বুঝতে চাইছে রোল্যান্ড মৃত না জীবিত।
সেকালের ডাক্তার বার্নার্ড ডি গর্ডন বেশ চমৎকার এক উপায় বাতলে দিয়েছিলেন। তার পরামর্শ ছিলো, যদি কাউকে মৃত বলে মনে হয়, তবে “তাকে উচ্চস্বরে ডাকতে হবে, চুল ধরে টানতে হবে, আঙুল মটকাতে হবে এবং গায়ে সুই ফোটাতে হবে”। যদি এগুলোতেও তার জ্ঞান না ফেরে, তাহলে উলের তৈরি ছোট একটি বল লোকটির মুখের সামনে নিয়ে ধরতে হবে। যদি সুতাগুলো নড়তে দেখা যায়, তার মানে লোকটি জীবিত আছে, নাহলে মৃত।