প্রাচীনকালের মানুষ কীভাবে চলাফেরা করতো, তাদের খাবারদাবার কেমন ছিলো, বিভিন্ন উৎসব কীভাবে পালন করতো- এককথায় তাদের পুরো জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়েই মানুষের আগ্রহের কোনো কমতি নেই। তখনকার সময়ের নানা ধ্বংসাবশেষ, লেখালেখি আমাদের ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের এসব সম্পর্কে বেশ চমৎকার ধারণাই দেয়। সেসব কিছু ধারণাকে একত্রিত করেই প্রাচীন রোমের জীবনযাত্রার বিচিত্র কিছু দিক নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের পুরো লেখাটি।
১। পাবলিক টয়লেট
প্রাচীনকালে রোমের পাবলিক টয়লেটগুলা ছিলো একইসাথে বিপদ আর কুসংস্কারের আড্ডাখানা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত গোপনীয়তা চুলোয় তুলে পাবলিক টয়লেটে সকল গোপন কাজও খোলাখুলিই করতো তারা! ছবি দুটি দেখলেই বোঝা যায় ব্যাপারটি। মাঝে মাঝে এমন খোলা ৫০টি টয়লেটও পাশাপাশি থাকতো। সমস্যা হলো, এসব টয়লেটের খোলা গর্তে থাকতো বিভিন্ন রকম প্রাণীর বসবাস। তাই মাঝে মাঝে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার সময় শরীরের গোপন জায়গায় ইঁদুরের কামড় খাওয়ার দুর্ভাগ্যও হয়েছে কারো কারো! আবার পয়ঃনিষ্কাশন প্রণালীর অব্যবস্থাপনার জন্য মিথেন গ্যাস জমে মাঝে মাঝে বিষ্ফোরণের কথাও শোনা গেছে। আর সেই বিষ্ফোরণে ঝামেলায় পড়তো শরীরের স্পর্শকাতর জায়গাটিকেই!
এজন্য তখন সমাজে জাদুকরদের প্রভাবও ছিলো অনেক। টয়লেটের ‘অশুভ আত্মা’ তাড়াতে জনগণ তাই ঘনঘন জাদুকরদের দ্বারস্থ হতো। জাদু আর কুসংস্কারের ছড়াছড়ি ছিলো পুরো রাজত্ব জুড়েই। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা টয়লেটের গায়ে বিভিন্ন মন্ত্র খুঁজে পেয়েছেন যেগুলো লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিলো অশুভ সেসব আত্মাদের তাড়ানো। রোমানরা বিশ্বাস করতো, অশুভ আত্মারা হাসিকে ভয় পায়। তাই তারা টয়লেটের গায়ে বিভিন্ন ক্যারিকেচার এঁকে রাখতো যাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে দিতে তারা ইচ্ছেমতো হাসতে পারে! তাহলে আর অশুভ আত্মা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। মাঝে মাঝে তারা ভাগ্যদেবী ‘ফরচুনা’র সাহায্যও চাইতো এজন্য। বিভিন্ন টয়লেটেই ফরচুনার ছবি পাওয়া গেছে। তাদের বিশ্বাস ছিলো, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার সময় তাদের রক্ষা করবে দেবী!
২। টয়লেট পরবর্তী পরিষ্কার
প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে টয়লেটে নাহয় নিজের চাপ কিছুটা হালকা করা গেলো, কিন্তু এরপর পরিষ্কার হতে হবে তো, তাই না? আজকের দিনে আমরা অবশ্য সেই ডাকে সাড়া দেয়ার পর সবাই টিস্যু পেপারের দ্বারস্থ হই। দুঃখজনক ব্যাপার হলো- প্রাচীন রোমে টিস্যু পেপারের প্রচলনই ছিলো না। তাই এর বিকল্প হিসেবে তারা নানাবিধ জিনিস ব্যবহার করতো নিজেদের পরিষ্কারের উদ্দেশ্যে।
এগুলোর মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলো লাঠির অগ্রভাগে লাগানো স্পঞ্জ। একে তারা বলতো জাইলোস্পঞ্জিয়াম। যদিও সবাই এটি ব্যবহার করতো, তবু পাবলিক টয়লেটগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় এগুলোর সংখ্যা থাকতো নগণ্য। সেগুলোকে রাখা হতো ময়লা পানি দিয়ে পরিপূর্ণ বেসিনে। আরো গা ঘিনঘিন করা ব্যাপার হলো- এ জাইলোস্পঞ্জিয়ামগুলো সবাই ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতো এবং ব্যবহারের পর অধিকাংশ সময়ই ব্যবহারকারী তা পরিষ্কার করে রাখতেন না! ফলে টাইফয়েড, কলেরার মতো বিভিন্ন রোগে তারা খুব সহজেই আক্রান্ত হয়ে যেত।
৩। মানবমূত্রের অভিনব ব্যবহার
প্রকৃতির ছোট ডাকে সাড়া দিয়ে আমরা সকলেই যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি, তখন একবারও কি মাথায় আসে যে এইমাত্র যে জিনিসটি শরীর থেকে বের হয়ে গেলো তারও অনেক মূল্য ছিল এককালে? প্রাচীনকালে মূত্রের কদর ছিলো গোটা রোমান সাম্রাজ্য জুড়েই। চামড়া পাকা করা, কাপড়চোপড় ধোয়া কিংবা গাছের সার সবদিকেই ছিলো মূত্রের জয়জয়কার।
প্রাচীন রোমে মূত্রের সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যবহার ছিলো মাউথওয়াশ হিসেবে! তারা নিজেদের দাঁত পরিষ্কার করতে নিয়মিতই এটি ব্যবহার করতো। অবশ্য তাদের দাবিকে অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। মূত্রে থাকা অ্যামোনিয়া বেশ চমৎকার এক পরিষ্কারক। বিভিন্ন দাগ সহজেই এর সাহায্যে তুলে ফেলা সম্ভব। এজন্যই দাঁত পরিষ্কার কিংবা কাপড় পরিষ্কারে মূত্রের ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। রোমান লেখক ক্যাট্টালাসের মতে, মানুষেরা তাদের স্বজাতির পাশাপাশি বিভিন্ন প্রাণীর মূত্রও এ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতো!
সত্যিকার অর্থেই তখনকার রোমের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা ছিলো এ মূত্রকে ঘিরে। মানুষের ত্যাগকৃত সেই মূত্রকে সংগ্রহ করে সেগুলোকে নানাভাবে প্রক্রিয়াজাত করে পরবর্তী ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা হতো। মূত্রের এ জনপ্রিয়তার জন্য এর ব্যবসার উপর করও নির্ধারণ করা হয়েছিলো। ট্যানারিগুলো মূত্র সংগ্রহ করতে শহরের বিভিন্ন প্রবেশপথে পটের ব্যবস্থা করেছিলো যেখানে লোকজন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে শান্তি পেত, আবার ট্যানারি মালিকেরাও নিজেদের ব্যবসা সুন্দরভাবে চালাতে পারতো।
৪। অদ্ভুত কুসংস্কার
চিকিৎসা কিংবা স্থাপত্যশিল্পে প্রাচীন রোমানরা বেশ উন্নতি লাভ করলেও তাদের মাঝে এমন কিছু কুসংস্কার প্রচলিত ছিলো যা শুনলে আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না।
উত্তেজিত পুরুষলিঙ্গের প্রতীক সংসারে সুস্বাস্থ্য ও সৌভাগ্য বয়ে আনে- এটি ছিলো প্রাচীন রোমের অত্যন্ত জনপ্রিয় এক কুসংস্কার। ফলে মন্ত্র পড়া বিভিন্ন কবচেও তারা এ প্রতীক নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। বাড়িঘরগুলোতে শোভা পেত বিভিন্ন ওয়াইন্ড চাইম যেগুলোতে শোভা পেতো উত্তেজিত পুংলিঙ্গের প্রতীক। তারা ভাবতো- এটি সকল অমঙ্গল ও অশুভ আত্মাকে তাদের পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে। তবে সব ওয়াইন্ড চাইমে যে এই এক প্রতীক থাকতো তা কিন্তু না। সিংহের পা কিংবা পাখির ডানার প্রতীকও শোভা পেত কোনো কোনো ওয়াইন্ড চাইমে।
৫। ছাগলের মল
গোলাকৃতির ছাগলের বিষ্ঠা বড়জোর গাছের জন্য সার হিসেবে কাজে আসতে পারে, কিন্তু তা যে কখনো সরাসরি মানুষের জন্যই ব্যবহার করা হতো সে কথা কি বিশ্বাসযোগ্য?
রোমান লেখক, প্রকৃতিবিদ, দার্শনিক এবং নৌ ও সেনা কমান্ডার প্লিনি দ্য এল্ডারের মতে, জরুরি ভিত্তিতে ক্ষতস্থান ব্যান্ডেজ করতে ছাগলের মল বেশ জনপ্রিয় ছিলো। সবচেয়ে ভালো মলগুলো সংগ্রহ করা হতো বসন্তকালে। এরপর সেগুলো শুকানো হতো। তবে দরকার পড়লে টাটকা মল দিয়েও কাজ সারা হতো।
ছাগলের মল যদি শুধু ক্ষত সারাতেই ব্যবহার হতো, তাহলেও মানা যেত। কিন্তু এর ব্যবহার ছাড়িয়ে গিয়েছিলো আমাদের কল্পনার সীমাকেও। তখনকার রথ চালকেরা এক ধরণের পানীয় পান করতো যা বানানো হতো ছাগলের বিষ্ঠার পাউডার আর ভিনেগারের সাহায্যে। তারা এটি পান করতো শক্তিবর্ধক হিসেবে।
৬। টেবিলে বমি করা
বমি করার মতো ব্যাপারটি আসলেই বেশ কষ্টকর। তাই সম্ভব হলে সবাই এটি লোকচক্ষুর অন্তরালেই সেরে আসতে চেষ্টা করেন। সেটি সম্ভব না হলে অন্তত কোনো পাত্রে বা পলিথিনে কাজটি সেরে নিজেকে ভালোমতো পরিষ্কার কথাটি কিন্তু কেউই ভোলেন না। কিন্তু প্রাচীনকালে রোমে আয়োজিত বিভিন্ন ভোজসভায় এ জিনিসটির দেখাও মিলতো না।
ঐতিহাসিক বিভিন্ন লেখালেখি থেকে জানা যায়, তখনকার দিনে ভোজসভাগুলোতে জাঁকজমক আর ঐশ্বর্যের স্পষ্ট ছাপ থাকতো। সেই সাথে খাদ্যের প্রাচুর্য তো ছিলোই। রোমান দার্শনিক সেনেকার মতে, সেসব ভুড়িভোজগুলোতে মানুষেরা একেবারে পেটভরে খেতো, যতক্ষণ না খেতে খেতে অস্বস্তি হয়ে বমি হচ্ছে ততক্ষণই তারা খেতে থাকতো। তারপর বমি করে নিজেদের হালকা করে আবার খেতে বসে যেতো তারা!
তবে বমি করতে কষ্ট করে বাথরুম পর্যন্ত যেত না তারা। টেবিলের পাশেই এজন্য পাত্র রাখা থাকতো। সেখানেই বমির কাজটুকু সেরে আবার খাওয়া শুরু করতো তারা, যেন কিছুই হয় নি! একবার ভাবুন তো আপনি খাচ্ছেন, আর আপনার পাশে কেউ বমি করছে। তারপর আবার খেতে বসছে আপনারই সাথে! কেমন লাগবে তখন?
সবসময় যে মুখ ঠিকমতো পাত্রের কাছে নিয়ে যাবার সময় তারা পেতো, তা-ও না। মাঝে মাঝে মেঝেতেই কাজটি সেরে ফেলতো তারা। তখনও চিন্তা ছিলো না। দাস-দাসীরা এসে সুন্দর করে সেসব পরিষ্কার করে দিয়ে যেত।