
বিশ্বের প্রতিটি দেশেই চুরি-ডাকাতি কিংবা খুনের মতো অপরাধ কম-বেশি হয়ে থাকে। এসব অঘটন প্রতিরোধ কিংবা সঠিক অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার জন্য রয়েছে তদন্তকারী সংস্থা কিংবা স্থানীয় প্রতিনিধি, রয়েছে প্রশাসনিক নানা নিয়ম-কানুন। এ ধরনের অপরাধ এখন যেমন হয়, হাজার বছর আগেও তেমন হতো। প্রাচীনকালে ডিএনএ টেস্ট বলে কিছু ছিল না। এখনকার গোয়েন্দারা অত্যাধুনিক অনেক যন্ত্রপাতির সাহায্য নিতে পারেন, যার মাধ্যমে পাওয়া যায় গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য এবং সূত্র।
অতীতে এই ব্যাপারগুলো এতটা সহজ ছিল না। তাই কোনো অঘটন ঘটলে প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বের করা ছিল অনেক দুরুহ একটি কাজ। তাছাড়া তখন অপরাধের জন্য শাস্তির ধরনও ছিল ভিন্ন। প্রাচীন মিশরের কথাই ধরা যাক। অপরাধীদেরকে ধরার জন্য তারা বেশ কিছু পন্থা উদ্ভাবন করেছিল যা এখনকার মানুষের কাছে অদ্ভুত মনে হতে পারে। সেই পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে আজ আমরা জানবো।

অভিযোগপত্র
দুর্নীতির প্রশ্রয়, আইনগত দিক থেকে ধনী কিংবা ক্ষমতাবান লোকদের বেশি সুযোগ-সুবিধা দেয়া এবং স্বজনপ্রিয়তার ব্যাপারগুলো প্রাচীন মিশরেও ছিল। তারপরও সাধারণ মানুষের অভিযোগগুলো বেশ গুরুত্ব সহকারে আদালতে বিবেচনা করা হতো। তখন অধিকাংশ মিশরীয়ই ছিল গরীব এবং সেই কারণে ছোটখাট চুরিও তাদের জন্য অনেক বড় ব্যাপার ছিল। একটি অভিযোগপত্র থেকে ব্যাপারটা বুঝতে পারা যায়।
নখু-এম-মাউতের কর্মীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছি আমি। তারা আমার ঘরে ঢুকে দুটি বড় রুটি, তিনটি কেক এবং পাত্রে রাখা সমস্ত ভুট্টা চুরি করে। এছাড়া একটি তেলের বয়াম থেকে তেল মাটিতে ফেলে দেয়, বিয়ারের একটি বোতল ভেঙে ফেলে। তখন আমি আমার বাবার রুমে ছিলাম, তাই বুঝতে পারিনি। শেমু মৌসুমের তৃতীয় মাসে, ১২তম দিনে ঘটলো এই ঘটনা। এখন মহান রাজা আমেন হটেপের শাসনামল এবং আমি মনে করি তিনি এর বিচার করবেন। হে আমার রাজা, চুরি করা যা-ই হোক না কেন, তা আমাকে ফেরত দেওয়া হোক।
চোর ধরার জন্য প্রশিক্ষিত বানর
এ ধরনের অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্ত শুরু করা হতো। তবে অপরাধ সংঘটিত হবার আগেই যাতে তা প্রতিরোধ করা যায় সেজন্য বেশ কিছু উপায় বের করেছিল মিশরীয়রা। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান যেমন সমাধি কিংবা ব্যস্ত বাজারগুলোতে সর্বদা প্রহরী নিযুক্ত থাকতো যাতে কেউ আইন অমান্য করতে না পারে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, তাদের সাথে থাকতো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বানরও! এই বানরেরা কাউকে চুরি করতে দেখলেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো এবং তার পা টেনে ধরে মাটিতে ফেলে দিতো। যতক্ষণ না পুলিশ আসতো, ততক্ষণ পর্যন্ত বেচারা চোরের উপর চলতো প্রশিক্ষিত বানরের আক্রমণ।

প্রত্যক্ষদর্শীর উপর নির্যাতন
রাজা তৃতীয় রামসেস আততায়ী হাতে মারা যান। তার হত্যাকারীদের বদলে প্রত্যক্ষদর্শীদের আদালতে ডাকা হয়। রাজার সব সহকারী এবং চাকর-বাকরদেরকেও আদালতে হাজির করা হয়েছিলো। কেন তারা হত্যার খবর সাথে সাথে পুলিশকে জানায়নি, এটাই ছিল তাদের অপরাধ। তখনকার আইনানুসারে, এই ব্যর্থতা খুবই গুরুতর অপরাধ হিসেবে দেখা হতো। পরবর্তীতে মিশরের আদালত তাদের সবার কান কেটে ফেলার নির্দেশে দেয়। ৩৮ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল সেই হত্যাকান্ডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করার অপরাধে, যদিও রাজার এক স্ত্রী ছিলেন এই হত্যা ষড়যন্ত্রের মূল হোতা।
কথিত আছে, একবার কুখ্যাত একটি ডাকাত দল মমি লুট করার ষড়যন্ত্র করছিল। সেই দলেরই এক সদস্য ষড়যন্ত্রের কথা পুলিশকে জানিয়ে দেয়! পরবর্তীতে সে স্বীকার করে, শাস্তির ভয়েই এ কাজ করেছিলো সে।
কেউ সাক্ষী কিংবা অপরাধী কোনো তথ্য দিতে রাজি না হলে পুলিশ কিন্তু ভদ্রভাবে বসে থাকতো না। পুলিশ যতক্ষণ না পর্যন্ত কথা আদায় করে নিতে পারে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে প্রহার করতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দড়ি দিয়ে বেঁধে একাধিক রড দিয়ে নির্মমভাবে মারার প্রচলন ছিল। অনেক সময় মারের চোটে অজ্ঞান হয়ে যেত এসব সন্দেহভাজন।
শুরুতে অবশ্য বলা হতো, কীভাবে তাদেরকে নির্যাতন করা হবে। এভাবে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে তথ্য বের করার চেষ্টা করা হতো। তখনকার দিনে কোনো ধর্মীয় পুস্তক ছুঁয়ে সাক্ষীদের শপথ করানোর প্রচলন ছিলো না, বরং তাদের বিচারকের সামনে বলতে হতো মিথ্যা বললে কী ভয়ংকর শাস্তি তারা মাথা পেতে নেবে।

সাক্ষীদের আত্মীয়স্বজনদের জেরা করা
এছাড়াও অনেক সন্দেহভাজন ব্যক্তির পুত্র-কন্যা, স্ত্রী কিংবা দাস-দাসীদের ধরে নিয়ে যাওয়া ছিল সাধারণ ব্যাপার। কারণ তারা মনে করতো এসব লোকজন অপরাধীদের আড়াল করতে চাইবে। এসব পদ্ধতি বর্তমানে বেশ বর্বর মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে মিশরীয়রা বুঝতে পেরেছিলো, জোর করে আদায় করা স্বীকারোক্তিগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
যে কারণে তারা অপরাধের পটভূমি সূক্ষ্মভাবে খতিয়ে দেখতো, যাতে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, সাক্ষী শুধু তাদের মনমতো কিছু বানিয়ে বলছে না। একাধিক সাক্ষী থাকলে তাদেরকে আলাদা রুমে নিয়ে গিয়ে জেরা করা হতো এবং সবার জবানবন্দী মিলিয়ে দেখা হতো। কারণ সবার জবানবন্দী মিলে গেলে মোটামুটি ধরে নেয়া যায় যে, সব সাক্ষী সঠিক কথা বলছে।
একবার এক লোক কবর লুটের কথা স্বীকার করলো। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, সেই সময়ে কবরে মৃতদেহের সাথে মৃত ব্যক্তির ব্যবহার করা মূল্যবান জিনিসপত্র দিয়ে দেয়ার প্রচলন ছিল। মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো, মৃত ব্যক্তি এসব জিনিসপত্র ব্যবহার করবে। রাজারা মারা গেলে সেবা করার জন্য তাদের দাস-দাসীদেরকেও জীবন্ত কবর দেয়া হতো। যা-ই হোক, স্বীকারোক্তি পাওয়ার পর সেই লোককে চোখ বেঁধে উপত্যকায় নিয়ে যাওয়া হলো, যেখানে সারি বেঁধে রয়েছে অনেকগুলো কবর। এরপর তাকে খুঁজে বের করতে বলা হলো কোন কবর লুট করেছিলো তার দল। এভাবে সাক্ষীর বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করা হতো।
বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের ক্ষেত্রে আদালত
তালাকের জন্য আদালত ছিল অত্যন্ত কঠোর। যে কেউ যে কারো বিরুদ্ধে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের অভিযোগ আনতে পারতো। প্রাচীন মিশরে ব্যাভিচারের শাস্তি ছিল ভয়ানক এবং স্বাভাবিকভাবেই নারীরাই ছিল এর প্রধান শিকার। স্বামীর সাথে প্রতারণা করলে নারীদের নাক কেটে ফেলা হতো এবং অনেক ক্ষেত্রে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হতো। তবে নারীদের মতো ব্যাভিচারী পুরুষদের শাস্তি এত কঠোর ছিল না। তালাকের সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর কিংবা বেশি হলে বেতের বাড়ি এতটুকুই ছিল তাদের শাস্তি। তবে এই গুরুতর ব্যাপারটির উপর কিন্তু প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ ছিল সামান্যই। অনেক সময় জনতাই অভিযুক্ত নারী কিংবা পুরুষের বিচারের ভার নিজ হাতে তুলে নিত।

নির্দোষ হলেও মুক্তি নেই
একবারের মতো অপরাধীর খাতায় যার নাম উঠে যেতো, সেই দুর্নাম কিন্তু ঘুচতো না কখনো। এমনকি পুরোপুরি নির্দোষ প্রমাণিত হলেও সমাজ তাদেরকে পুরোপুরি ভিন্ন চোখে দেখতো। একবার এক লোককে তার অপরাধ স্বীকার করানোর জন্য নির্মমভাবে মারা হচ্ছিলো, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও স্বীকারোক্তি আদায় করা গেলো না। শেষমেষ পুলিশ তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো ঠিকই, কিন্তু রেকর্ড বইয়ে তার নামের পাশে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ তকমার কোনো পরিবর্তন হলো না। এভাবেই সবকিছু চলতো তখন। মনে করা হতো, যখন একবার যেহেতু কেউ সন্দেহের তালিকায় এসে গেছে, তার মানে এর পেছনে অবশ্যই তার কোনো দোষ আছে। ‘যা রটে, তা কিছু ঘটে। আর যা ঘটে, তার কিছু না কিছু রটে’ – প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে ব্যাপারটা অনেকটা এরকম আর কী। তার কর্মকান্ড সব পুলিশের নজরে থাকতো।

আমুন দেবতার মূর্তি
এতক্ষণ ধরে যে পদ্ধতিগুলোর কথা বলা হলো, ১০০০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত মিশরীয়রা এভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করতো। সেই পদ্ধতিগুলোর কিছু দিক নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও সেই সময়ের কথা বিবেচনা করলে খুব একটা অদ্ভুত মনে হবে না ব্যাপারগুলো। কিন্তু এরপর তারা যা করলো সেটা ছিল অত্যন্ত হাস্যকর একটি ব্যাপার। মিশরীয় শাসনামলের শেষদিকে ক্ষমতায় আসে আমুনের যাজকেরা। বলতে গেলে, পুরো বিচারব্যবস্থা তারা তুলে দেয় আমুনের এক মূর্তির কাছে!
যখনই কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসতো তখনই সেই মূর্তিটিকে জিজ্ঞাসা করা হতো আসলেই সেই ব্যক্তি দোষী কিনা। মূর্তিটি যদি একটু সামনে আগাতো এর অর্থ হচ্ছে ‘হ্যাঁ’ এবং একটু পিছনে গেলে তার অর্থ হচ্ছে ‘না’। অবধারিতভাবেই মূর্তিটি নিজে থেকে এসব কিছুই করতো না, কিছু লোক আড়ালে থেকে মূর্তিটি নিয়ন্ত্রণ করে দেবতার ভূমিকা পালন করতো। অনেক ক্ষেত্রে কোনো তদন্তই করা হতো না, ইচ্ছামতো সেই মূর্তির সাহায্যে কাউকে দোষী কিংবা নির্দোষ সাব্যস্ত করা হতো। এভাবে মিশরীয়দের বিচার ব্যবস্থা ধীরে ধীরে প্রহসনে পরিণত হয়।