ইতিহাসবেত্তাদের মতে, খ্রি.পূ. ৫০০০ অব্দ থেকে খ্রি.পূ. ৩২০০ অব্দ পর্যন্ত প্রাচীন মিশরে প্রাক-রাজবংশীয় যুগ চলমান ছিল। এই সময়ের মাঝে মিশরীয় সমাধি ব্যবস্থা ক্রমশ উন্নতি লাভ করতে থাকে। মৃতদেহ সংরক্ষণে আরও বেশি সচেষ্ট, উদ্যোগী, ও সচেতন হয় তারা। এই সময়ে সংরক্ষিত দেহ হিসেবে চমৎকার এক উদাহরণ হতে পারে ‘জিঞ্জার মানব’। সবচেয়ে প্রাচীনতম সংরক্ষিত দেহ হিসেবে খ্যাত জিঞ্জার মানবকে উদ্ধার করা হয়েছিল আপার ইজিপ্টের গেবেলেইনের এক কবর থেকে। খ্রি.পূ. আনুমানিক ৩৪০০ অব্দের দিকে পৃথিবীতে বর্তমান ছিল এই জিঞ্জার মানব। মৃত্যুর পর তাকে কবর দেওয়া হয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক কালের ভ্রূণ সদৃশ অবস্থানে। কবরে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল বেশ কিছু নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীও। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে মমিতে রূপান্তরিত এই মৃতদেহের বয়স ছিল ১৮ থেকে ২১ বছর।
বেশ পরিশ্রমের পর বিজ্ঞানীরা একমত হয়েছেন যে, তাকে হত্যা করা হয়েছিল পেছন দিক থেকে ছুরিকাঘাতে। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করে হয়েছিল পাঁচ ইঞ্চি লম্বা তামার ছুরি বা ফ্লিন্ট ব্লেড। আঘাতের ধরন দেখে কিছুটা অনুমান করা যায়, পেছন থেকে আগত এই আঘাত ছিল ইচ্ছাকৃত। এতে তার কাঁধের হাড়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। প্রাক-রাজবংশীয় আমলে কবর সম্পর্কীয় রীতি-নীতি যে আরও গুরুত্বের সাথে নেওয়া হয়েছিল, এর প্রমাণ বহন করে কবরে সমাহিত সামগ্রীগুলোর জটিল নকশা। এছাড়াও, প্রথমদিকের ডিম্বাকার গর্তগুলো ক্রমে ক্রমে চতুষ্কোণ আকৃতি নিতে থাকে। বিভিন্ন কাঠের টুকরোকে তারা কফিনের মতো করে মৃতদেহের চারপাশে সাজিয়ে রাখত, যাকে বলা যায় কফিনের পূর্বপুরুষ।
ঐসময়ে আরও একধাপ এগিয়ে ছিল গেজরিয়ান সংস্কৃতির অন্তর্গত নেখেনের বাসিন্দারা। নেখেন ছিল প্রাগৈতিহাসিক মিশরীয় আমলের শেষের দিকে এবং প্রাক-রাজবংশীয় যুগের শুরুর দিকে ঊর্ধ্ব মিশরের রাজধানী। দেবতা হোরাসের রেফারেন্স টেনে একে ‘বাজপাখির শহর’ বলেও আখ্যায়িত করা হতো। প্রাক-রাজবংশীয় যুগে এই নেখেনের কবরের দেওয়ালে প্লাস্টার করার পাশাপাশি, সেই প্লাস্টারের উপর আঁকা হয়েছিল বিভিন্ন চিত্রও। তবে চিত্রগুলো এতটা জটিল ছিল না। সিংহের ছবি, যোদ্ধার ছবি, নৌকার ছবি, শিকারের ছবি- এসব সাধারণ জিনিসই ছিল এর মূল বিষয়বস্তু। বলা তো যায় না, নৌকার এই ছবিই হয়ত সূর্য দেবতা রা-এর নৌকা ভ্রমণকে ইঙ্গিত করত।
খ্রি.পূ. ৪০০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে বাদারিয়ান সংস্কৃতিতে পাত্রে কবর দেওয়ার রীতি চালু হয়েছিল। এ সময়ে হেমামিয়েহ এবং এডাইমাতে (খ্রি.পূ. ৪০০০ অব্দ) এই ধরনের সমাধি ব্যবস্থা চোখে পড়ে। প্রথমে ভাবা হতো, যাদের আর্থিক অবস্থা ততটা সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তারাই পাত্র-কবরের পন্থা বেছে নিত। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, বহু অভিজাত পরিবারের পিতাকে কফিনে শোয়ানো হয়েছে, আর পুত্রকে পাশে কবর দেওয়া হয়েছে পাত্রের মধ্যে। অর্থাৎ পাত্রে কবর দেওয়া কোনো পরিবারের আর্থনীতিক অবস্থা ইঙ্গিত করে না, বরঞ্চ ধর্মীয় কোনো রীতির সাথে এর যোগাযোগ থাকতে পারে। ষষ্ঠ রাজবংশের এক সমাধির দেয়ালচিত্র দেখে বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেছেন, প্রাচীন মিশরীয়রা এই পাত্রকে হয়তো মহিলাদের জরায়ুর সাথে তুলনা করতেন। মাতৃগর্ভে যেমন জরায়ু থাকে, তেমনি জরায়ু সদৃশ পাত্রে কবর দেওয়ার ফলে তারা আবার ঠিক মায়ের গর্ভের মতোই পুনর্জন্ম লাভ করতে পারবে।
নাকাদা যুগের শেষ পর্যায়ে এসে কিছু বড় বড় কবর পাত্র লক্ষ্য করা যায়, যাদেরকে ‘Pottery Coffin’ বা ‘পাত্রসমাধি’ বলা হতো। রূপকাররা অনেক পাত্রে নীল নদের উপত্যকা, প্রাচীন মিশরের প্রাণী, উদ্ভিদ, এবং এখানকার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চালচিত্র ফুটিয়ে তুলত। মৃতদেহের শরীরের উপর বা পাশে অসংখ্য সিরামিকের পাত্র পাওয়া গিয়েছে। মাঝে মাঝে সন্ধান মিলেছে সিরামিকের মূর্তিরও। এসব সামগ্রী মৃত ব্যক্তির নিজের কি না, বা ধর্মীয় রীতি পালনের জন্য এই সামগ্রীসমূহ রাখা হয়েছিল কি না, তা নিয়ে এখনো নিশ্চিত কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি।
প্রাক-রাজবংশীয় যুগে আরেকটি খুব সাধারণ কবর সামগ্রী হলো প্রসাধনী প্যালেট। এই প্যালেট হলো একপ্রকার তক্তা, যাতে করে কারুশিল্পীরা বিভিন্ন রঙ মেশাতেন। বাদারিয়ান ও নাকাদা যুগের প্যালেট আয়তাকার হলেও প্রাক-রাজবংশীয় যুগে তা এসে রূপ নেয় বিভিন্ন জ্যামিতিক আকৃতিতে। এবং তা তৈরি করা হতো পাললিক শিলার খণ্ডিত অংশ বা স্লেট দিয়ে। এই সময় প্যালেট শুধু কবর সামগ্রী হিসেবেই নয়, দৈনন্দিন জীবনেও এর বহুল ব্যবহার ছিল। কারণ, প্যালেটের মাঝে পাওয়া গেছে প্রসাধনী ব্যবহারের অসংখ্য প্রমাণ।
সমাধিতে প্রাপ্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো ক্ষুদ্র প্রস্তরমূর্তি। এগুলো সাধারণত সিরামিক দিয়ে তৈরি করা হতো। এ নিয়ে মিশরতত্ত্ববিদদের মাঝে নানা মত চালু আছে। কেউ কেউ বলেছেন, ক্ষুদ্র প্রস্তর মূর্তিগুলো একেকজন দেবতার প্রতিনিধিত্ব করত। আবার অনেকে বলেছেন, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অংশ হিসেবে এগুলো মৃতদেহের সাথে কবর দেওয়া হয়েছে। মূর্তিগুলোর নির্দিষ্ট কোনো মুখাবয়ব ছিল না। মূর্তিগুলোর মধ্যে যে অংশ সবচেয়ে বেশি চমক জাগায়, তা হলো ‘স্টেটোপাইগাস নারী মূর্তি’। স্টেটোপাইগাস নারীদের বড় নিতম্ব নির্দেশ করে। এই নারী মূর্তিগুলোর হাত সবসময় থাকত মাথার উপরে। প্রাক-রাজবংশীয় যুগে এই অঙ্গভঙ্গির নারী মূর্তি পুরো মিশরেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। হয়তো এটি ছিল তৎকালীন কোনো ধর্মীয় উপাসনার রীতি।
পাত্রে কবর মৃত ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদার সাথে জড়িত না থাকলেও সমাহিত করা ব্যক্তিগত জিনিসপত্র বেশিরভাগ সময়েই মৃত ব্যক্তির সামাজিক অবস্থাকে নির্দেশ করত। অলংকারের মধ্যে স্বর্ণের পাশাপাশি, লাপিস লাজুলি, ইথিওপিয়ান অবসিডিয়ান পাথর, নেকলেস, ব্রেসলেট ইত্যাদি পাওয়া গেছে। এছাড়াও ছুরি, স্ক্র্যাপর, এবং অন্যান্য যন্ত্রও ছিল উল্লেখযোগ্য। এগুলো কেন কবরে দেওয়া হতো, তার নির্দিষ্ট কারণ এখনো পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি। হয়তো এগুলো মৃত-ব্যক্তি বা তার সম্প্রদায়ের কাছে বিশেষ কোনো তাৎপর্য বহন করত।
প্রাক-রাজবংশীয় যুগের শেষদিকে এসে, আপার ইজিপ্টে বইতে শুরু করে এক পরিবর্তনের হাওয়া। বস্তুবাদী মনোভাব ধীরে ধীরে পরিস্ফুটনের দরুন, ধনী ও দরিদ্রের মাঝে পার্থক্য ক্রমশ বাড়তে থাকে। এর পরিষ্কার উদাহরণ চোখে পড়ে ধনী আর দরিদ্রের সমাধির মাঝেই। সেসময় অভিজাত শ্রেণীকে দরিদ্রদের থেকে একটু দূরে কবর দেওয়া হতো। ধনীদের গোলাকার কবর আকৃতিতে হয়ে ওঠে আয়তাকার, এবং আয়তন হয়ে ওঠে আরও বৃহৎ। কবরের পাশাপাশি তারা ইট বা কাঠ দিয়ে দেওয়ালও নির্মাণ করে, যাতে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন চিত্রও যুক্ত করা হয়।
সমাধির দেয়ালের পাশে গড়ে তোলা হতো আরেকটি ছোট কক্ষ, যার ছাদ নির্মাণ করা হতো মাটি বা নলখাগড়া দিয়ে। এই প্রসঙ্গ টানলেই উদাহরণ এসে যায় তারখানের সমাধিস্থলের কথা। এই সমাধিস্থলে কিছু সমাধির পাশে দুটি কক্ষের অস্তিত্ব মিলেছে। পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত একটি মৃতদেহ দাফন করার পর এর চারপাশে মাটির দেওয়াল বেষ্টন করা হতো। একটার উপর একটা নুড়ি-পাথর বা ঐজাতীয় জিনিস চাপিয়ে প্রায় এক মিটারের মতো উঁচু করা হতো কাঠামোকে। কিন্তু এর মাধ্যমে কবরটি সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা গেলেও মূল কবরের কাছে কেউ যেতে পারত না।
এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে মাটির দেয়ালের সাথে একটি ছোট কক্ষ তৈরি করা হলো, যাতে পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষ তাতে প্রবেশ করতে পারে। দ্বিতীয় কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছিল খাবার দেওয়ার উদ্দেশ্যে। এই কক্ষের সাথে মূল কবরের দেয়াল সংযুক্ত থাকত। সেই দেয়ালে ছিল দুটো লম্বালম্বি ফাঁকা, যা দিয়ে মৃত-ব্যক্তির জন্য খাবার নিয়ে আসা হতো। অদ্ভুত শোনালেও, প্রাচীন মিশরের মৃত-ব্যক্তির কবরে খাবার দেওয়ার চল ছিল। আবার অনেকসময় এই দ্বিতীয় কক্ষকে ব্যবহার করা হতো প্রার্থনাকক্ষ হিসেবে, যেখানে প্রাচীন মিশরীয় ধর্মীয় রীতি মেনে মৃত-ব্যক্তির জন্য প্রার্থনা করা হতো। তাই এই ধরনের সমাধিকে বলা হয় দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সমাধি। এগুলোই হলো মাস্তাবার আদিরূপ। দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সমাধি বা মাস্তাবার আদিরূপ মিশরীয় সভ্যতায় বহু গুরুত্বপূর্ণ এক নিয়ামক। এই ধরনের কাঠামোর ফলেই জীবিত ব্যক্তি সুযোগ পেত মৃত-ব্যক্তির সাথে পরোক্ষ যোগাযোগের। এবং এই মাস্তাবা থেকেই একসময় গড়ে ওঠে পৃথিবীর প্রথম পাথরের স্থাপত্য ফারাও জোসেরের ধাপ পিরামিড। এবং ধাপ পিরামিড থেকেই ক্রমশ জটিল নকশা ধারণ করে রূপ নিয়েছে গিজার বিভিন্ন পিরামিড।