চেঙ্গিস খানের নৃশংসতা নিয়ে ইতিহাসে অনেক কাহিনীই প্রচলিত আছে। এর মাঝে অনেকগুলোতেই দেখা যায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। প্রথমে তিনি তার শত্রুদেরকে আত্মসমর্পনের সুযোগ দিয়ে তার সাথে যোগ দিতে বলেছেন। যদি তারা তা প্রত্যাখ্যান করতো, তাহলে তাদের উপর ধ্বংস আর হত্যার লীলাখেলা চালাতো মোঙ্গল বাহিনী। চেঙ্গিস খান মনে করতেন এমনটা করলে তার শত্রুপক্ষ তাকে অধিক পরিমাণে ভয় পাবে। ফলে তখন তারা যুদ্ধ ব্যতিরেকেই আত্মসমর্পন করবে। অনেক সময় তার এ কৌশল কাজেও এসেছে। তবে যদি কেউ তাকে কোনোভাবে অপমান করতো, সেটা একেবারেই ভালোভাবে নিতেন না তিনি। সেক্ষেত্রে অপমানকারীর একেবারে দফারফা করেই তিনি ছাড়তেন।
১
একবার এক এলাকার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে ৫০০ জনের বিশাল এক বণিক দল সেখানে পাঠিয়েছিলেন চেঙ্গিস খান। তবে খানের এই উদার আহ্বানে সাড়া দেন নি সেই এলাকার শাসক। বরঞ্চ তিনি এমন এক কাজ করলেন যা মঙ্গোলাধিপতিকে যারপরনাই রাগিয়ে দিলো। ইনালচুক নামের সেই নেতা মোঙ্গলদের সেই কাফেলাকে পুরোপুরিই ধ্বংস করে দিলো, নির্মমভাবে হত্যা করলো এর প্রত্যেক সদস্যকে।
তার পাঠানো শান্তির প্রস্তাব এমনভাবে ছুড়ে ফেলাকে মোটেই ভালোভাবে নিলেন না চেঙ্গিস খান। তিনি কেবল উপযুক্ত সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন। একসময় রাজ্য জয়ের অভিযানে বেরোলেন চেঙ্গিস। ইনালচুকের এলাকা খানের যাত্রাপথেই পড়লো। চেঙ্গিস পুরনো হিসাব মিটিয়ে নিতে চাইলেন। যদিও তার সকল ক্ষোভ ছিলো কেবলই ইনালচুকের উপর, তবে তিনি তা ঝাড়লেন সেই এলাকার সকল কিছুর উপর। সেখানকার জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করে খানের বাহিনী, ধ্বংস করে সেখানকার প্রতিটি স্থাপনা। এরপর আসে ইনালচুকের পালা। চোখ আর কানে গরম গলিত রুপা ঢেলে মারাত্মক যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই মৃত্যুর মুখে ছুড়ে দেয়া হয় ইনালচুককে।
২
অল্প বয়সেই প্রতিপক্ষের বিষের প্রভাবে বাবাকে হারিয়েছিল তেমুজিন (চেঙ্গিস খানের পূর্ব নাম)। এরপর স্বগোত্রের বিরোধীতায় গোত্রছাড়া হতে হয় তাদের। এতগুলো সন্তান নিয়ে তখন বেশ বিপদেই পড়ে যান তার মা। সন্তানদের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন তুলে দিতে তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হতো। সেই সন্তানদের মাঝে যেমন তার নিজের সন্তান ছিলো, তেমনি ছিলো স্বামীর অন্য ঘরের সন্তানও।
ছোটবেলা থেকেই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বড় হওয়া তেমুজিন অন্তত এতটুকু বুঝে গিয়েছিলো যে, এ পৃথিবীতে কেবল যোগ্যরাই টিকে থাকে; অযোগ্যদের সবাই শুধু করুণাই করে, কেউ তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় না। পরিবারের জন্য খাদ্য সংগ্রহে তেমুজিনও কাজ করতো। তবে খাবারের বন্টন নিয়ে সবসময় সে সন্তুষ্ট থাকতো না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সমবয়সী সৎ ভাইয়ের সাথে মাঝে মাঝেই এ বিষয়ে টুকটাক ঝামেলা বেঁধে যেত তার।
একবার এক শিকারের বন্টন নিয়ে বেশ ঝামেলা বেঁধে যায় দু’ভাইয়ের মাঝে। মীমাংসার জন্য তেমুজিন যায় তার মায়ের কাছে। সে হয়তো ভেবেছিলো মা আপন সন্তানের পক্ষই নেবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মা নেন তার সৎ ভাইয়ের পক্ষ। সেদিন কিছুই বলে নি কিশোর তেমুজিন, শুধু রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সেখান থেকে চলে গিয়েছিলো সে।
এরপর একদিন ছোটভাইকে নিয়ে তেমুজিন ঝাঁপিয়ে পড়ে সৎ ভাইয়ের উপর, ধনুকের আঘাতে বের হয়ে যায় তার প্রাণপাখি। তার মা এ ঘটনাটি জানার পর অনেক রাগারাগি করেছিলেন, কিন্তু এতে তার কোনো ভাবান্তরই হয় নি।
আরেকবারের কাহিনী শোনাই। তেমুজিন তখনও ক্ষমতার স্বাদ পায় নি। মঙ্গোলদের বিখ্যাত এক রেসলারের নাম ছিলো বুরি। এই বুরি এক ম্যাচে তেমুজিনের ভাই বেলগুতেইকে বেশ অপমান করলো। অপমানের ঝাঁজ সেইবার নীরবেই সহ্য করে নিয়েছিলো তেমুজিন; কিছুই বলে নি, শুধু মনে রেখেছিলো।
এরপর একসময় মঙ্গোলদের নেতার আসনে বসে তেমুজিন, হয়ে ওঠে চেঙ্গিস খান। ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে বুরিকে তার পাওনা মিটিয়ে দেয়া দরকার বলে মনে করলেন চেঙ্গিস। তাই বুরিকে বেলগুতেইয়ের সাথে আরেকটি ম্যাচ খেলার আমন্ত্রণ জানান তিনি। এবার বুরির মনে পড়ে যায় অতীতের কথা। ভয় পেয়ে তাই ম্যাচটা স্বেচ্ছায় হেরে যায় বুরি। বেলগুতেই সেদিন তাকে নিয়ে একপ্রকার খেলাধুলাই করেছিলো।
একবার বুরিকে ছুঁড়ে ফেললো বেলগুতেই, এরপর তার উপর চড়ে বসলো সে। ঠিক তখনই চেঙ্গিস খানের এক সিগনালে বদলে গেলো সব। বুরিকে উপুড় করে হাঁটু দিয়ে সজোরে তার পিঠে চাপ দিলো বেলগুতেই। এতক্ষণ ধরে মার খেয়ে খেয়ে বুরির অবস্থা তখন বেশ নাজুক। প্রতিরোধ করার শারীরিক ও মানসিক শক্তি ততক্ষণে তার নেমে এসেছিলো শূন্যের কোঠায়। এরপরই আসে সেই মরণ কামড়। বুরির মাথাটা ধরে সজোরে ঘুরিয়ে দেয় বেলগুতেই। সাথে সাথেই ভেঙে যায় তার স্পাইন। নিশ্চল বুরিকে এরপর টেনে নিয়ে যাওয়া হয় রিংয়ের বাইরে। সেখানেই অল্প কিছু সময় পর মৃত্যুর হাতে নিজেকে সঁপে দেয় বেচারা বুরি।
৩
কোনো এলাকায় আক্রমণ করলে প্রথমে তাদেরকে আত্মসমর্পনের সুযোগ দিতেন চেঙ্গিস খান। কিন্তু যদি তারা তাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিতো, তবে খান হয়ে উঠতেন হিংস্র হায়েনার চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর। তার সেনা অভিযানগুলোর ইতিহাস দেখলে বোঝা যাবে যে, যেখানেই খানের বাহিনী অগ্রসর হয়েছে, সেখানেই কেবল হত্যা-লুন্ঠন-ধ্বংসের নতুন নতুন দুঃখগাথা রচিত হয়েছে। এশিয়ার জনসংখ্যার উপরও চেঙ্গিসের সেসব অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিলো।
ইরানের ইতিহাসবিদ রশিদ-আল-দীনের মতে মঙ্গোল বাহিনী মার্ভে আনুমানিক সত্তর হাজার আর নিশাপুরে আনুমানিক দশ লক্ষ লোককে হত্যা করেছিলো। চীনের জনসংখ্যাও মঙ্গোলদের অভিযান দ্বারা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। যখন তারা চীনে আক্রমণ শুরু করে, তখন সেখানকার জনসংখ্যা ছিলো দশ কোটির মতো। ১২৭৯ সালের দিকে মঙ্গোলদের চীন অভিযান শেষ হয়। ১৩০০ সালের আদমশুমারি থেকে জানা যায় যে, তখন সেখানকার জনসংখ্যা ছিলো বড়জোর ছয় কোটি! এই চার কোটির মাঝে একটা বড় অংশের প্রাণ গিয়েছিলো চেঙ্গিসের বাহিনীর হাতে। তবে সেই সংখ্যাটি ঠিক কত তা পরিষ্কার নয় ইতিহাসবিদদের কাছে।
সমরকন্দে যখন মঙ্গোল বাহিনী পৌঁছায়, তখন সেখানে তারা এক লক্ষাধিক সৈন্যের কাছ থেকে বেশ ভালো রকমের প্রতিরোধেরই সম্মুখীন হয়। কিন্তু তারপরেও মনোবল না হারিয়ে অবরোধ আর আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে তারা। একপর্যায়ে সেখানকার পানির সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। একসময় পতন ঘটে সমরকন্দের। এরপর সেই শহরে শুরু হয় খান বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। সেটা এতটাই ভয়ঙ্কর ছিলো যে মঙ্গোল সেনারা গর্ভবতী নারীদের পেট কেটে গর্ভের সন্তানকে পর্যন্ত বের করে খুন করেছে! বিভিন্ন তথ্যমতে সে সময় হত্যার শিকার হওয়া কিংবা পালিয়ে যাওয়া নগরবাসীর সংখ্যা ছিলো প্রায় ৪,০০,০০০।
৪
চেঙ্গিস খানের ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে যে, তিনি ইসলাম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ প্রভৃতি ধর্মের ধর্মগুরুদের সাথে তিনি পরামর্শ করতেন, তাদের থেকে বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ নিতেন। এ কথাটি সত্য হলেও এর দ্বারা এটি প্রমাণিত হয় না যে অন্যান্য ধর্মের লোকজনের প্রতি তিনি উদারতা দেখাতেন কিংবা তিনি ছিলেন মানবদরদী। বরঞ্চ শত্রুদের সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করলেও তার জীবনে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা দেখানোর কোনো নমুনা খুঁজে পাওয়াটা বেশ দুষ্কর।
চেঙ্গিসের রোষের অনলে সবচেয়ে বেশি পুড়েছিলো মুসলিম ও ইহুদিরা। তাদেরকে তিনি প্রকাশ্যে ‘ক্রীতদাস’ বলে সম্বোধন করতেন। এছাড়া তারা স্বাধীনভাবে ধর্মীয় নানা বিধিবিধান পালনের সুযোগও পেত না। ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ায় মঙ্গোলীয় রীতি অনুযায়ী বিভিন্ন খাবারদাবার খেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলো তারা। এতে বেশ ক্ষেপে যান চেঙ্গিস। তার কথা ছিলো, তিনি সেসব এলাকা জয় করেছেন এবং করুণা করে তাদেরকে সেখানে থাকতে দিয়েছেন। তাই তাদেরকে মঙ্গোলীয় রীতিতেই খাবার প্রস্তুত করে খেতে হবে। মুসলিমদের ভেড়া জবাইয়ের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিলো। যদি কেউ এটা করতে গিয়ে ধরা পড়তো, তবে তার জন্য ছিলো কঠোর শাস্তি। ইহুদিদেরও খৎনা করানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিলো।
৫
যুদ্ধের ইতিহাসে চোখ বুলালে দেখা যাবে বিভিন্ন সময়ই বিভিন্ন সমরনায়ক যুদ্ধক্ষেত্রে পূর্বের কোনো যুদ্ধ থেকে প্রাপ্ত যুদ্ধবন্দীদের মানবব্যূহ হিসেবে ব্যবহার করছেন। আর এ ব্যাপারটি ছিলো চেঙ্গিস খানের নিয়মিত অভ্যাস।
মানবব্যূহ হিসেবে কাদের ব্যবহার করা হবে সে ব্যাপারে অবশ্য বেশ বাছবিচার করে নিতেন চেঙ্গিস খান। যদি প্রতিপক্ষের সৈন্যরা কেবলমাত্র ভালো ব্যবহারের প্রত্যাশায় আত্মসমর্পন করতো, তবে অনেক সময়ই তিনি তাদের হত্যা করতেন। পক্ষান্তরে যদি সেই সেনারা দক্ষ হতো এবং আচার-ব্যবহারও ভালো হতো, তবে তিনি তাদেরকে তার সেনাদলের অন্তর্ভুক্ত করে নিতেন। আবার যদি কখনো তিনি খোশ মেজাজে থাকতেন, তাহলে যুদ্ধবন্দীদের এক বিরাট অংশকে পাঠিয়ে দিতেন একেবারে সামনের সারিতে যুদ্ধের জন্য। সেখানে যুদ্ধ করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় থাকতো না তখন। যেতে না চাইলেই দেহে ঢুকে যেত মঙ্গোল সেনার তলোয়ার। কেবলমাত্র যুদ্ধ করেই আর কিছুদিন পৃথিবীর আলো-বাতাস ভোগের অধিকার লাভ করতো তারা।
৬
খারেজমিয়া সাম্রাজ্য জয়ের পথে চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বাধীন মঙ্গোল বাহিনী সর্বশেষ অবস্থান নেয় উরগেঞ্চে। এখানে মারাত্মক প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয় তাদের। সাধারণত কোনো এলাকা অবরোধ করলে অল্প কিছুদিনের মাঝেই সেটা হস্তগত করতে পারতো মঙ্গোল বাহিনী। কিন্তু এখানে তাদের লেগে যায় প্রায় ছয় মাসের মতো সময়। এমনকি শহরের ভেতরে প্রবেশের পরেও তারা ঠিকমতো ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারছিলো না। কারণ একদিকে এই শহরের ভেতরটাও যেমন সুরক্ষিত ছিলো, তেমনি বলতে গেলে প্রায় প্রতিটি বাড়ি থেকেই মঙ্গোল সেনাদের উপর গেরিলা আক্রমণ চালানো হতো।
একসময় একেবারে অতিষ্ট হয়ে গেলো মঙ্গোল বাহিনী। তারা সিদ্ধান্ত নিলো যদি তাদের উপর আক্রমণকারীদের খুঁজে পাওয়া না যায়, তাহলে দরকার হলে এবার পুরো শহরটিই জ্বালিয়ে দেবে তারা। জ্বালিয়ে দেবার পরও শহরটির বেঁচে থাকা সৈন্যরা হাল ছেড়ে দেয় নি, কারণ তারা জানতো খানের বাহিনীর হাতে ধরা পড়া মানে নির্ঘাত মৃত্যু। এর চেয়ে যুদ্ধ করে মৃত্যুই তাদের কাছে অধিক সম্মানজনক মনে হয়েছিলো।
শেষের দিকে চেঙ্গিসের ধৈর্যের বাধও যেন ভেঙে গেলো। তার নির্দেশে একটি বাঁধের গতিপথ পরিবর্তন করে উরগেঞ্চ বন্যার পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হলো, নির্দেশ দেয়া হলো জীবিত যাকেই পাওয়া যাবে তাকেই হত্যা করতে হবে। বেশ কিছু তথ্যমতে, উরগেঞ্চে চালানো সেই গণহত্যায় দশ লাখের মতো মানুষ মারা গিয়েছিলো!