প্রাচীন মিশরে মৃত্যু নিয়ে মাতামাতির একটু বেশিই ছিল। অন্ততপক্ষে, পিরামিড, মমি, শবাধারগুলো তার জোরালো সাক্ষী হিসেবে প্রমাণ বহন করে। তবে, মিশরের প্রথম পিরামিড (ফারাও জোসেরের ধাপ পিরামিড) থেকে শুরু করে গিজার জটিল নকশার পিরামিড, হুট করেই দুর্বোধ্য অবয়বে রূপান্তরিত হয়ে যায়নি। এজন্য পাড়ি দিতে হয়েছে বহু ধাপ। মিশরের প্রাগৈতিহাসিক সমাধি এবং প্রাক-প্রারম্ভিক রাজবংশের সমাধির মাঝে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এই পরিবর্তন বুঝতে হলে প্রথমেই আলোচনা করতে হবে প্রাগৈতিহাসিক মিশরের সমাধি ব্যবস্থা নিয়ে।
মিশরের সমাধি ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে মৃতদের সবসময় কবর দেওয়া হতো। প্রাচীন গ্রিসের মতো এখানে শবদাহ করার রীতি ছিল না। ইসলামের ছায়াতলে আসার আগপর্যন্ত মিশরে মৃতদেহ উত্তর দিকে নির্দেশ করে পূর্বদিকে সূর্যের মুখোমুখি কবর দেওয়া হতো। কারণ, সূর্য উঠত পূর্ব দিকে। আর সূর্য সবসময় পশ্চিম দিকে অস্ত যেত বলে সমাধিস্থান সবসময় থাকত নীল নদের পশ্চিম তীরে, নীল নদের কাছাকাছি কোনো জায়গায়। এর ফলে নীল নদ পাড়ি দিয়ে আসা শেষকৃত্যের শোভাযাত্রা খুব সহজেই সমাধিতে পৌঁছাতে পারত। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০০ অব্দের দিকে মিশর প্রস্তরযুগের দ্বারপ্রান্তে এসে ঠেকে। তবে প্রস্তর যুগের ছাপ তখনও তাদের মাঝে বিদ্যমান ছিল। এর অকাট্য প্রমাণ বহন করে দুটি জিনিস। প্রথমত, সেসময়ে যেসব অস্ত্র পাওয়া গিয়েছিল, এর সবগুলো ছিল ফ্লিন্ট বা পাথর দ্বারা নির্মিত। দ্বিতীয়ত, তারা লেখালেখির উপায় জানত না। তাই প্রাগৈতিহাসিক মিশর বা নব্যপ্রস্তরযুগের মিশরীয় কবর সম্পর্কে কোনো লিখিত তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে ঐ সময়ের হাজার হাজার কবরের অস্তিত্ব মিলেছে, যার সাথে ফারাওদের আমলের কবরের বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। এর মধ্যে মিশরের অভিজাত এলাকায় প্রাগৈতিহাসিক এবং প্রাক-রাজবংশীয় মিলিয়ে প্রায় পনেরো হাজারের কাছাকাছি কবরের সন্ধান মিলেছে, যেখানে সাধারণ মানুষদের বসবাসের এলাকায় পাওয়া গেছে প্রায় ৬০০টি কবর। প্রাগৈতিহাসিক মিশরীয় যুগে মৃতদেহ কবর দেওয়ার সময় এত জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করা হতো না। নির্মাণ করা হতো না কোনো স্থাপত্য বা ভাস্কর্য। শুরুটা হয়েছিল একদম সাদাসিধেভাবে। মরুর বালিতে সাধারণ মানের অগভীর এক গর্ত খুঁড়ে মরদেহ সমাহিত করা হতো। সময়ের সাথে সাথে গর্তের গভীরতা বৃদ্ধি পেলেও কোনো রকম স্থাপত্যের ছোঁয়া তখনও লাগেনি সমাধিতে।
কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে এই পর্যন্ত প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে প্রাচীনতম কঙ্কালের সন্ধান মিলেছে দেনদেরার হাথুর মন্দিরের কাছে, ‘তারামসা ১’ নামের একটি গোরস্থানে। সেই মৃতদেহ ছিল প্রায় ৫৫,০০০ বছর পূর্বের। কোনো এক শিশুর কঙ্কাল ছিল সেটি। বয়স হতে পারে ৮-১০ বছর। মৃতদেহটি পাওয়া গিয়েছিল কবরে বসা অবস্থায়, যার পা ছিল বাঁ দিকে বাঁকানো, মুখ ছিল পূর্ব-পশ্চিমে কিছুটা পেছনের দিকে। মাথা ছিল পূর্ব দিকে তাকিয়ে। বাঁ হাত রাখা ছিল কটিদেশের উপর, ডান হাত ছিল পেছন দিকে। কঙ্কাল উদ্ধারের সময় প্রচুর ব্লেড এবং ভাঙা কাঁচের টুকরার হদিশ মিললেও, বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মৃতদেহ কবর দেওয়ার সময় এগুলো সাথে সমাহিত করা হয়নি।
নব্যপ্রস্তরযুগের শুরুর দিকে (খ্রি.পূ. প্রায় ৭০৫০ অব্দ) মিয়েরিস হ্রদের কাছে কারুনিয়ান জনগোষ্ঠী বাস করত। এই স্থান থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এক মহিলার কবর আবিষ্কার করেছেন। মৃতদেহের বামদিক ছিল আংশিক কুঁচকানো, মাথা দক্ষিণ দিকে রেখে পূর্ব দিকে মুখ করা ছিল। ডান হাত দিয়ে তার মুখটি ঢাকা ছিল, আর বাম হাত ছিল মাথার নিচে। এই কবর থেকে কোনো সামগ্রীর অস্তিত্ব মেলেনি। পুরাতন প্রস্তরযুগের শেষদিকে (খ্রি.পূ. ১৪০০ অব্দ থেকে খ্রি.পূ. ১২০০ অব্দের মধ্যে) জেবেল সাহাবা হয়েছিল দুটি কাদান কবরের চাক্ষুষ সাক্ষী। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এর মধ্যে একটি ছিল গণকবর। বিশেষজ্ঞরা মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখেছেন, তাদের উপর মৃত্যু নেমে এসেছিল মূলত সহিংসতার কারণে। এই গণকবরের উপরের অংশ বেলেপাথরের পাত দিয়ে ঢাকা ছিল। মাতৃগর্ভের ভ্রূণ সদৃশে মৃতদেহগুলো সমাহিত করা হয়েছিল। ঐতিহাসিকগণ একে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
নাজলেত খাতার নামে মিশরে এক প্রাচীন ভূগর্ভস্থ খনি বিদ্যমান ছিল। এ খনির কাছে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা দুটি কবর আবিষ্কার করেছেন, যা ছিল প্রায় খ্রি.পূ. ৩০,০০০ অব্দ থেকে খ্রি.পূ. ৩৫,০০০ অব্দের সামসময়িক। এর মধ্যে একটি কবরের অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। অন্য কবরে মৃতদেহটি পিঠ দিয়ে বসানো ছিল। মাথা ছিল পশ্চিমে মুখ করা, বাম হাত ছিল শ্রোণিচক্রের উপরে রাখা, ডান হাত ছিল শরীর বরাবর প্রসারিত। মাথার কাছে একটি দু’মুখো কুঠারও রাখা হয়েছিল। নব্যপ্রস্তরযুগে মিশরের অভিজাত আর সাধারণ মানুষদের বসবাসের এলাকার কবরের বেশ কিছু ফারাক লক্ষ্য করা যায়।
মিশরের সাধারণ মানুষদের বেলায় বেশিরভাগ মৃতদেহ কবর দেওয়া হতো বাসস্থানের আশেপাশে। কবরের আয়তন ছিল খুবই অল্প। কারণ, মৃতদেহকে কবর দিতে যতটুকু যায়গার দরকার হতো, ঠিক ততটুকুই ব্যবহার করা হতো। সেখানে কবর সামগ্রীর খুব একটা হদিস পাওয়া যায়নি। ওই কবরগুলো দেওয়া হতো মৃতদেহকে কেন্দ্র করে। তবে সমাধিতে একেবারেই যে কোনোকিছু পাওয়া যেত না, তেমনটাও নয়। বিভিন্ন পাত্রের অস্তিত্ব মিলেছে সেখানে। হয়তো মৃত্যুর সাথে জড়িত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলো তারা বাড়ি থেকে দূরে পালন করত।
খ্রি.পূ. ৪০০০ অব্দের দিকে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে এখানে। তখন কবরস্থানের জায়গা বাড়ানোর পাশাপাশি কবরস্থানগুলোর দূরত্ব বাসস্থান থেকে ক্রমশ বাড়তে থাকে। কখনো ডিম্বাকৃতির গর্ত খুঁড়ে, কখনো বা মৃতদেহকে পশুর চামড়ায় আবৃত করে সমাহিত করা হতো। মৃতদেহকে ডানদিকে কাত করে মাথা রাখা হতো দক্ষিণে। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা হতো। কবর সামগ্রীর পরিমাণও ছিল অল্প। তবে ঐ সময় খানিকটা ব্যতিক্রম ছিল এল-ওমারির বাসিন্দারা। ওখানকার মৃতদেহগুলোর মাথা দক্ষিণদিকে থাকলেও, মুখ থাকত পশ্চিমে। মৃতদেহকে শোয়ানো হতো বামদিকে।
মিশরের অভিজাত এলাকায় নব্যপ্রস্তরযুগে গেবেল রামলা নামক স্থানে অগণিত মানুষকে একসাথে কবর দেওয়া হয়েছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা বহু প্রচেষ্টার পর সেখান থেকে তিনটি কবরস্থান অবিকৃত অবস্থায় উদ্ধার করতে সক্ষম হন। কিছু ব্যক্তিগত এবং কিছু গণকবরেরও সন্ধান পাওয়া গেছে, যেগুলো আনুমানিক খ্রি.পূ. ৪৬০০ অব্দ থেকে খ্রি.পূ. ৪৩০০ অব্দের হয়ে থাকতে পারে। ঐতিহাসিকদের ধারণা, এই গণকবরগুলো ছিল মূলত পারিবারিক কবরস্থান। এসব কবরে মৃতদেহগুলো বাঁকানো এবং ডানপাশ করে শোয়ানো ছিল।
মৃতদেহের উপরে পাওয়া গেছে কাপড়, পশম কিংবা নলখাগড়ার চাদর। সাধারণ মানুষদের এলাকার কবরের সাথে এগুলোর পার্থক্য হচ্ছে- এসব সমাধিতে বিভিন্ন রকমের অলংকার, কাঁচের টুকরা, তৈজসপত্র, ছুড়ি, ব্লেড ইত্যাদির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল, যা অনেকাংশেই মৃত ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদার প্রতিফলক হিসেবে কাজ করত। নারীদের কবরে দিয়ে দেওয়া হতো বিভিন্ন অলংকার, আর পুরুষদের কবরে স্থান পেত বিভিন্ন অস্ত্র। অলংকার রাখার দরুন মহিলাদের কবর পুরুষদের কবরের চেয়ে আকারে বড় হতো। এই কবর থেকে দাঁত পুনঃস্থাপনেরও একটি প্রমাণ পাওয়া যায়।
মৃতদেহ সৎকারে প্রাচীন মিশরে সর্বপ্রথম অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের প্রমাণ পাওয়া যায় মিশরের বাদারিয়ান গোষ্ঠীর কাছ থেকে। এছাড়াও, তারাই সম্ভবত প্রাচীন মিশরে প্রথম মৃতদেহ মোড়ানোর রীতি চালু করেছিল। তারা ছাগলের চামড়া দিয়ে দেহ মোড়ানোর পাশাপাশি কখনো কখনো চামড়ার নিচে কাপড়ও দিয়ে দিত। তাদের কবরগুলো হতো ডিম্বাকৃতির বা গোলাকার। খুব কম কবরের চারপাশে দেওয়ালের অস্তিত্ব ছিল। কবরে আড়াআড়িভাবে লাঠি দিয়ে রাখা হতো, ঝুরা মাটিগুলো রক্ষা করার জন্য। বাহু এবং পা ভাঁজ করে মৃতদেহ আলগোছে রাখা হতো কবরে। দেহ বাঁ-দিকে কাত করে মুখ রাখা হতো পশ্চিমে। আর মাথা থাকত দক্ষিণে। বাদারি অঞ্চলের এক প্রাচীন কবরে মৃতদেহে রেসিনের ব্যবহার দেখে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন, সেসময়েও মানুষ মৃতদেহকে পচনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন গবেষণার চেষ্টা চালাত।
প্রাগৈতিহাসিক মিশরের অধিকাংশ কবরেই সামগ্রী হিসেবে পাওয়া যেত দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র। পরকালে মানুষ এসব জিনিস ব্যবহার করবে, এই ভেবেই এসব জিনিস কবরে দিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু তাদের মাঝে কেন এবং কীভাবে এই ধারণা ও বিশ্বাসের উদ্ভব ঘটেছিল, তা নিশ্চিত করে বলা শক্ত। মরুর শুষ্ক বালিতে কবর দেওয়ার ফলে আবিষ্কৃত মৃতদেহগুলোর অধিকাংশই অক্ষত অবস্থায় ছিল। অথচ, সেই যুগে মিশরে মমিকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যানুযায়ী, মরুর শুষ্ক ও তপ্ত বালি, মৃতদেহের শরীর থেকে পানি শোষণের মাধ্যমে দেহকে শুষ্ক বানিয়ে ফেলে। একটি দেহ এই প্রক্রিয়ায় পুরোপুরিভাবে শুষ্ক হয়ে গেলে, ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক শরীরের কোনো টিস্যুকে আর নষ্ট করতে পারে না। ফলে সেটাকে বলা যায়, ‘প্রাকৃতিক মমিকরণ প্রক্রিয়া’।
মরুঝড়ে বালি সরে মৃতদেহগুলো বাইরে বেরিয়ে আসলে, সেগুলোকে শেয়াল ছিন্নভিন্ন করে ফেলত। ফলে মিশরীয়দের মাথায় নতুন চিন্তার উদ্ভব ঘটতে লাগল, কীভাবে শেয়াল বা অন্যান্য হিংস্র প্রাণীর থেকে লাশগুলোকে রক্ষা করা যায়। সেজন্য মৃতদেহকে কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে বালির গর্ত খুঁড়ে সেখানে মাদুর দিয়ে তার উপর মৃতদেহ শুইয়ে দেওয়া হতো। আবার কখনো কখনো মৃতদেহকে ঢাকার জন্য ব্যবহার করা হতো গাছের ছোট কচি ডাল। তৃতীয় নাকাদা পর্যায়ে এসে কিছু কিছু মৃতদেহ দাফনের ক্ষেত্রে মাটির কফিনও ব্যবহার করা হয়েছিল। শেয়াল থেকে লাশ রক্ষার বিষয়টি মিশরীয় পুরাণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর উপর ভিত্তি করে শেয়ালমুখো দেবতা আনুবিসের পূজা শুরু করে মিশরীয়রা।
দেবতা আনুবিস সম্পর্কে জানতে হলে পড়তে পারেন – আনুবিস: প্রাচীন মিশরের শিয়াল দেবতা
এই সময়ের পরেই মিশরে শুরু হয় প্রাক-রাজবংশীয় যুগ এবং জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে মিশরের সমাধি ব্যবস্থা। রূপক অর্থে, প্রাগৈতিহাসিক মিশরের ডিম্বাকৃতির কবর ছিল মিশরীয় স্থাপত্যশিল্পের মূলভিত্তি, যার উপর ভর দিয়ে বিশ্বের প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ, সম্পূর্ণরূপে পাথর দ্বারা নির্মিত মিশরের ধাপ পিরামিড তৈরি করা হয়েছিল।