কৌতূহলপ্রিয় মানুষেরা বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালিয়ে দূর করেছেন সকলের মনের ভ্রান্ত ধারণা। তবে থেমে থাকেনি কোনো আবিষ্কারই। আলোচনা সমালোচনার মাধ্যমে নতুন নতুন প্রশ্নের আবির্ভাব ঘটেছে এবং সেই সকল বিষয়কে স্বচ্ছ করতে আবারো গবেষণায় নেমেছেন অন্য বৈজ্ঞানিকগণ। এভাবেই এগিয়ে চলেছে বিজ্ঞান। পাঁচ শতাব্দী আগেও মানুষের কাছে অজানা ছিল হৃদপিন্ড এবং রক্তপ্রবাহের ধারণা। অথচ আজ আমাদের জ্ঞান অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে।
গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল মুরগিছানার ভ্রূণ গবেষণায় সর্বপ্রথম হৃদপিন্ডকে দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে শনাক্ত করেন। তবে তার বেশিরভাগ ব্যাখ্যা পরবর্তীতে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। পরবর্তীতে তার হৃদপিন্ড সম্পর্কিত জ্ঞান সকলের নিকট পৌঁছে দিতে যে সকল বিজ্ঞানীগণ কাজ করেছেন তাদের মধ্যে গ্যালেন এবং উইলিয়াম হার্ভের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। চলুন জেনে নেওয়া যাক তাদের অবদান সম্পর্কে।
গ্যালেন এবং হৃদপিন্ড
একইসাথে চিকিৎসক, লেখক এবং দার্শনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন গ্যালেন। রোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় ডাক্তার গ্যালেনের দেওয়া তত্ত্ব প্রায় ১,৫০০ বছর ধরে ইউরোপে দাপটের সাথে চলেছিল। তার জন্ম বর্তমান তুর্কিস্তানে (পূর্বনাম পারগ্যামাম) খ্রিস্টপূর্ব ১৩০ অব্দে। তার বাবা-মা ছিলেন গ্রিক। তার শিক্ষাজীবন কেটেছে গ্রিস, আলেক্সান্দ্রিয়া এবং এশিয়া মাইনরে। তারপর তিনি আবার পারগ্যামামে ফিরে এসে একটি মল্লযোদ্ধা প্রশিক্ষণ স্কুলের চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন এবং ধীরে ধীরে শারীরিক ক্ষত চিকিৎসায় বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৬০ অব্দের দিকে তিনি রোমে যান এবং বাকি জীবন রোমের রাজধানীতেই কাটিয়ে দেন।
গ্যালেনই প্রথম চিকিৎসাবিদ্যায় পরীক্ষামূলক পদ্ধতির সূচনা করেন। দৈহিক অভ্যন্তরীণ কার্যাবলী বুঝতে জীবদ্দশায় তিনি অনেক প্রাণীদেহে অস্ত্রোপচার চালান। পরীক্ষা থেকে দেওয়া ব্যাখ্যার মধ্যে বেশ কিছু ছিল সঠিক, যেমন- বৃক্ক থেকে মূত্র সৃষ্টি হয় এটি তারই আবিষ্কার।
তিনি দেহের অভ্যন্তরীণ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত তিনটি ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেন- মস্তিষ্ক এবং স্নায়ু, হৃদপিন্ড এবং ধমনী, যকৃত এবং শিরা। তার ব্যাখ্যানুযায়ী, যকৃত থেকে কালচে রক্ত উৎপন্ন হয়ে শিরার মাধ্যমে সারা দেহের টিস্যুগুলোতে পৌঁছে দেয় এবং সেখান থেকেই দেহ প্রয়োজনীয় রক্ত পায়। কিছু রক্ত আবার ফুসফুসের বাতাসের সংস্পর্শে আসে এবং সেখান থেকে হৃদপিন্ডে যায়। হৃদপিন্ড থেকে এরপর উজ্জ্বল লাল রক্ত মস্তিষ্কে পৌঁছে ‘নিউমা’ নামক পদার্থের সৃষ্টি হয় যা আমাদের সংবেদনশীলতা এবং অনুভূতির জন্য কাজ করে।
গ্যালেনের এই তত্ত্বানুযায়ী রক্ত যকৃত বা হৃদপিন্ডে আর ফিরে আসে না, বরং তা দেহে শোষিত হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, মাঝে মাঝে যকৃত অতিরিক্ত রক্ত উৎপাদন করে ফেলে, তখন দেহে অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। ফলে অসুস্থ হতে হয়। এর থেকে বাঁচবার উপায়ও তিনি বাতলে দেন। গ্যালেন বলেন, দেহে যদি রক্ত বেড়ে যায় তাহলে দেহের কিছুটা অংশ কেটে রক্তপাত ঘটালে সামঞ্জস্য পুনরায় ফিরে আসবে।
চিকিৎসা জগতে গ্যালেনের ভূমিকা কোনোমতেই অস্বীকার করার উপায় নেই। তিনিই প্রথম শিরা এবং ধমনীর মধ্যে শারীরবৃত্তীয় পার্থক্য খুঁজে পান। তিনি তার ৪০০ বছর পূর্বের তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করেছিলেন- ধমনী দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হয়, বাতাস নয়।
চ্যালেঞ্জের মুখে গ্যালেন
ষোড়শ শতাব্দীতে এসে গ্যালেনের তত্ত্ব প্রথম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। স্প্যানিশ চিকিৎসক মাইকেল সারভেটাস গ্যালেনের ব্যাখ্যাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন, শিরা থেকে রক্ত প্রথমে ফুসফুসে গিয়ে বিশুদ্ধ হয়ে তারপর হৃদপিন্ডে যায়। তবে রক্তসঞ্চালনের গতিপথ তিনি দেখাতে পারেননি।
১৫০০ খ্রিস্টাব্দে বেলজিয়ান চিকিৎসক অ্যান্ড্রিয়াস ভেসালিয়াস বলেন যে, গ্যালেনের হৃদপিন্ড সম্পর্কিত ব্যাখ্যাটি সঠিক নয়, তবে গ্যালেনের ব্যাখ্যাকৃত অন্যান্য বিষয়কে তিনি চ্যালেঞ্জ করেননি।
উইলিয়াম হার্ভের অনেক আগেই রক্তসঞ্চালনের ব্যাখ্যা পাওয়া গিয়েছিল। সে প্রায় ২৬০০ বছর আগের কথা। চীনা মেডিসিনের প্রধান সারগ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, “দেহের সমস্ত রক্ত হৃদপিন্ড থেকে পাম্প হয়ে একটি চক্র সম্পন্ন করে এবং কখনোই থামে না”। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আরবীয় ডাক্তার ইবনে আন-নাফিস একটি ‘ক্ষুদ্র সঞ্চালন’ প্রক্রিয়ার কথা বলেছিলেন, যেখানে উল্লেখ রয়েছে রক্ত প্রবাহিত হয় হৃদপিন্ড থেকে ফুসফুসে, আবার ফুসফুস থেকে দেহের অন্য কোনো অংশে না গিয়েই সোজা হৃদপিন্ডে।
উইলিয়াম হার্ভে এবং হৃদপিন্ড
গ্যালেনের কাজ নিয়ে যখন সকলের মাঝে সংশয় বেড়েই চলছিল, তখনই এ বিষয়টি নাড়া দেয় উইলিয়াম হার্ভের মাঝে।
১৫৭৮ সালে ইংল্যান্ডের ফোকস্টোনে হার্ভের জন্ম। কোথাও কোথাও বলা হয় তার বাবা ব্যবসায়ী ছিলেন, আবার কোথাও কোথাও উল্লেখ করা হয়েছে কৃষক হিসেবে। সে যা-ই হোক, তার বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে অনেক বড় করবেন। ক্যান্টাবারির কিং’স স্কুলে ছোট থেকে পড়ালেখা করে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন হার্ভে। এরপর তিনি মেডিসিন নিয়ে পড়াশোনা করতে চলে যান ইতালি পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী এবং শল্যচিকিৎসক হায়ারোনিমাস ফ্যাব্রিসিয়াসের কাছে তিনি শিক্ষা নিতে থাকেন।
ফ্যাবিসিয়াসের বিশেষ আকর্ষণ ছিল শরীরবিদ্যায়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মানবদেহের শিরাগুলোতে একমুখী কপাটিকা রয়েছে, কিন্তু সেগুলোর কার্যাবলী তিনি ঠিক বুঝতে পারছিলেন না। পরবর্তীতে হার্ভে তার শিক্ষা গ্রহণ করে একমুখী কপাটিকার গঠন এবং রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া সমাধানে কাজে লেগে পড়েন।
১৬০২ সালে ইতালি থেকে পড়াশোনা শেষ করে ফিরে এসে নিজেকে একজন চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৬০৭ সালে তিনি ‘রয়াল কলেজ অব ফিজিশিয়ান’ এর একজন ফেলো হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ১৬০৯ সালে লন্ডনের বার্থেলোমেওস হসপিটালের ডাক্তার হিসেবে নিযুক্ত হন।
ধীরে ধীরে গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেহের রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতি নিয়ে নতুন তত্ত্ব গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। তিনি প্রতিটি ব্যাখ্যার জন্য একই পরীক্ষা কয়েকবার করেছেন এবং সঠিক প্রমাণ উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। প্রায় ৪০টি প্রজাতির প্রাণী এবং মানুষের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তিনি গবেষণা করেছেন। ১৬২৮ সালে ‘On the Motion of the Heart and Blood in Animals’ নামক ৭০ পৃষ্ঠার বইয়ে তার ব্যাখ্যার সারসংক্ষেপ তুলে ধরেছিলেন, যেটি একটি বিরাট মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। বইটি তখন ল্যাটিন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং প্রায় ২৫ বছর পর সেটির ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়।
হার্ভে দেখিয়েছেন, রক্ত সারাদেহে চক্রাকারে সঞ্চালিত হয়। গ্যালেনের তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন যে, রক্ত যদি দেহেই শোষিত হয়ে যেত তা হলে পুনরায় ঐ পরিমাণ রক্ত দেহে রাতারাতি তৈরি হয়ে যাওয়া কখনোই সম্ভব নয়। সারা দেহে এক ঘণ্টায় কতটুকু রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে সেই রক্তের আয়তন পরিমাপ করে দেখিয়েছেন এত পরিমাণ রক্ত পুনরায় তৈরি করা দেহের পক্ষে কতটা অবাস্তব। মানবদেহে রক্তের পরিমাণ হতে হবে ধ্রুব।
প্রাণীর হৃদকম্পন পর্যবেক্ষণ করে তিনি দেখেন যে, রক্ত প্রবাহের ইঞ্জিনের মতো কাজ করে হৃদপিন্ড, যকৃত নয়। রক্ত হৃদপিন্ড থেকে পাম্প হয়ে সারাদেহে পৌঁছে পুনরায় হৃদপিন্ডে ফিরে এসে একটি চক্র সম্পন্ন করে। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, রক্ত হৃদপিন্ড থেকে ধমনীর মাধ্যমে বের হয়ে শিরার মাধ্যমে প্রবেশ করে।
চ্যালেঞ্জের মুখে উইলিয়াম হার্ভে
হার্ভের ব্যাখ্যাগুলো এমন সময়ে এসেছিল যে তার প্রতি প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। অনেকেই তার কাজের প্রশংসা করেছেন, তার শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখে তার তত্ত্ব গ্রহণে আগ্রহ দেখিয়েছেন। অপরদিকে অনেক গোঁড়া ডাক্তার তার বিপক্ষে অবস্থান নেন। তখন ইউরোপে তার তত্ত্বকে একেবারের স্বাগতম জানানো হয়নি। অনেকেই তার রক্ত সঞ্চালনের বিষয়টি গ্রহণ করলেও হৃদপিন্ড থেকে চক্রাকারে রক্ত প্রবাহের বিষয়টি মেনে নেননি। তবে তার মৃত্যুর সময়ে, অর্থাৎ ১৬৫৭ সালে তার তত্ত্ব কিছুটা জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে।
তবে অনেকদিন পর্যন্ত চিকিৎসকগণ তাদের কাজে হার্ভের তত্ত্বকে সঠিকভাবে কাজে লাগাননি। অসুস্থ হলে তখনো সেই গ্যালেনের রক্তক্ষরণ প্রক্রিয়া ব্যবহৃত হতো। তবে হার্ভে যে রক্তক্ষরণ প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করেছিলেন, তা নয়।
হার্ভে তার জীবদ্দশায় ধমনী এবং শিরার সংযোগ ব্যাখ্যা করে যেতে পারেননি। কিন্তু তার মৃত্যুর চার বছরে পরেই বিজ্ঞানী মালপিজি ধমনী এবং শিরার ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করেন।
ফিচার ইমেজ- everydayhealth.com