
বেশ কয়েক শতক আগে ম্যাসো-আমেরিকান অঞ্চল ম্যাক্সিকোতে অ্যাজটেক সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। এর আগে এরা ছিল যাযাবর শ্রেণীর সম্প্রদায়। উপকথা অনুসারে তাদের দেবতার আদেশ ছিল, যে স্থানে কোনো একটি ঈগলকে ক্যাকটাসের শাখায় বসে সাপ খেতে দেখবে সেখানেই যেন তারা স্থায়ী হয়ে যায় এবং নগর গড়ে তোলে। যাযাবর অবস্থায় ঘুরতে ঘুরতে তারা মধ্য-ম্যাক্সিকোর একটি পাহাড়ঘেরা অঞ্চলে এমন দৃশ্যের দেখা পায় এবং সেখানেই তারা স্থায়ী হয়ে যায়। এবং ধীরে ধীরে তাদের নিজস্ব একটি সভ্যতা গড়ে তোলে।

Image Source: Britannica Kids
সূর্যদের কথা
অ্যাজটেক সংস্কৃতিতে মানুষের বিশ্বাস ছিল, বর্তমান বিশ্বের আগে আরো চারটি বিশ্বের অস্তিত্ব ছিল। চারটির প্রতিটিতেই আলাদা আলাদা সূর্য ছিল। আগের চারটি বিশ্বের সবকটিই বিশৃঙ্খলার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রথম সূর্যটি ছিল দেবতা টিজকাল। টিজকাল তার ভাই কুইটজালের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। যুদ্ধে কুইটজাল তাকে হারিয়ে ফেলে এবং দলবল সহ আকাশলোক থেকে বিতাড়িত করে দেন। আকাশে সূর্যের অনুপস্থিতিতে পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে আসে। অন্ধকার পরিস্থিতিতে কুইটজাল দ্বিতীয় সূর্য হিসেবে আবির্ভূত হন। এই ঘটনায় টিজকাল অত্যন্ত রাগান্বিত হন এবং রাগের বশবর্তী হয়ে সকল মানুষকে বানরে রূপান্তরিত করে দেন। এরপর কুইটজাল সকল বানরকে ভাসিয়ে সরিয়ে দেন এবং দেবতার অবস্থান থেকে সরে যান।

Image Source: Dave McKean
দেবতাহীন এমন পরিস্থিতিতে তৃতীয় সূর্য হিসেবে আসেন দেবতা তালক। কিন্তু এ সময়ে প্রথম সূর্য টিজকাল আবার আরেক ঝামেলা পাকিয়ে বসেন। ঐ সময়ে তালকের স্ত্রী জোশিকুইটজালকে চুরি করে নিয়ে যান টিজকাল। এতে তালক খুবই মর্মাহত ও রাগান্বিত হন। রাগের বশবর্তী হয়ে তিনি মর্ত্যে বৃষ্টি পড়া নিষিদ্ধ করে দেন। বৃষ্টি না থাকাতে মর্ত্যলোকে নেমে আসে ভয়াবহ খরা। পানিহীন অবস্থায় পড়ে মর্তের লোকেরা দিনের পর দিন বৃষ্টি ভিক্ষা চাইতে থাকে। তাদের বিরামহীন ভিক্ষার নমুনা দেখে দেবতা এতই বিরক্ত হয়ে যায় যে, মানুষকে শিক্ষা দিতে পানির বৃষ্টির বদলে আগুনের বৃষ্টি বর্ষণ করে বসেন। এর ফলে সমস্ত পৃথিবী পুড়ে ছাই হয়ে যায় এবং দেবতাকে আবারও নতুন করে সবকিছু শুরু করতে হয়।
এরপর ৪র্থ সূর্য হিসেবে আসেন তালকের নতুন স্ত্রী চালচুতলিক। তিনি ভালোভাবেই সবকিছু পরিচালনা করছিলেন, কিন্তু এখানেও ঝামেলা পাকায় প্রথম সূর্য টিজকাল। তিনি চালচুতলিকের উপর এতটাই নাখোশ হয়েছিলেন যে তা চালচুতলিককে অবিরাম কান্নায় পর্যবসিত করে দেয়। তার কান্নায় পানির বদলে বের হতো রক্ত। কোনো প্রকার বিরাম ছাড়া তিনি টানা ৫২ বছর রক্ত-অশ্রু বর্ষণ করেছিলেন। ফলে সবকিছু রক্তের বন্যায় ভেসে যায় এবং দেবতাদেরকে আবারো নতুন করে শুরু করতে হয়।

Image Source: Dave McKean
এরপর আসেন পঞ্চম সূর্য। অ্যাজটেকদের বিশ্বাস অনুসারে পঞ্চম সূর্যই এখন পর্যন্ত টিকে আছেন এবং প্রতিদিন মর্ত্যবাসীকে দিবস উপহার দিয়ে যাচ্ছেন। তাকে ডাকা হয় টোনাটিয়া (Tonatiuh) নামে। মাঝে মাঝে একে হুইটজাল নামেও ডাকা হয়। তার মা কোয়াটলিক পাখির এক গুচ্ছ পালক দ্বারা অপ্রত্যাশিতভাবে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যাবার কারণে ৫ম সূর্যদেব হুইটজালের জন্ম হয়। পাখির পালক দ্বারা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যাবার ঘটনা অবাস্তব বলে মনে হতে পারে, কিন্তু পৌরাণিক কাহিনীতে এগুলো একদমই মামুলি ব্যাপার। অ্যাজটেকদেরই আরেকজন দেবী অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন এক প্রকার লাউ জাতীয় সবজি দ্বারা।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। পাখির পালক দ্বারা দেবী কোয়াটলিকের এমন গর্ভধারণে দেখা দেয় আরেক সমস্যা। তিনি ছিলেন ৪০০ সন্তানের জননী। এতগুলো সন্তান জন্মদানের পরেও আবার অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন দেখে সকল সন্তান তার বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠে। সন্তানগুলো তাদের মাতাকে ধরে নিয়ে শাস্তি হিসেবে দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চায়। করেই ফেলেছিল প্রায়, এমন সময় অর্থাৎ একদম ক্রান্তি মুহূর্তে তিনি জন্ম দেন ৫ম সূর্য হুইটজালকে। জন্ম থেকেই হুইটজাল ছিলেন শক্ত সবল, আর যোদ্ধার বেশেই বের হয়েছিলেন মাতৃগর্ভ থেকে। তার জন্মলব্ধ অসীম শক্তির সাহায্যে চোখের পলকেই ৪০০ জনের প্রায় সকলকেই মেরে ফেলতে সক্ষম হন। প্রাণে বেঁচে যায় মা। ৪০০ জনের মাঝে অল্প কয়েকজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এরপর থেকে দেবতা হুইটজাল ৫ম সূর্য হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন।

দেবতা হুইটজাল; Image Source: warosu
এখানে অ্যাজটেকদের বিভিন্ন দেবতার নাম কিছুটা সরলীকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সরলীকৃত বানানের ক্ষেত্রে কাজী আনোয়ার হোসেন অনূদিত ‘মন্টেজুমার মেয়ে’ বইটিকে অনুসরণ করা হয়েছে। এখানে টিজকাল = Tezcatlipoca, কুইটজাল = Quetzalcoatl, হুইটজাল = Huitzilopochtli।
বলিদান
অ্যাজটেকরা বিশ্বাস করতো সূর্যদেবতাকে শান্ত রাখতে হলে তার উদ্দেশ্যে বলি দিতে হবে। অন্যথা হলে পূর্ব দিক দিয়ে আর উঠবে না সূর্য। রাগান্বিত হয়ে আগের দেবতাদের মতো কোনো ক্ষতিকর ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবেন। আগের মতো ফলে ধ্বংস হয়ে যাবে মর্ত্যের সকল প্রাণ। বিশ্বাস করতো, তাই বিশ্বাস অনুসারে দিনের পর দিন নরবলি দিয়ে গেছে। কখনো এর ব্যতিক্রম করে দেখেনি। চাইলে তারা এমন কিছু করতে পারতো যে দেখি আজকে বলি না দিকে কিছু হয় কিনা। একদিন বলি না দিয়ে পূর্ব দিকে সূর্য উঠে কিনা এটা পরীক্ষা করে দেখলেই বেঁচে যেতো হাজার হাজার মানুষের প্রাণ।
অ্যাজটেকদের মানুষ বলি দেবার প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত নারকীয়। এই সভ্যতার শেষ দিকে সূর্যের উদ্দেশ্যে নর-বলিদান চরম পর্যায়ে উপনীত হয়। ধারণা করা হয় ১৪৮৭ সাল পর্যন্ত টেনোকটিটলান-এর বিখ্যাত পিরামিডে প্রায় ২০ হাজার থেকে ৮০ হাজার লোককে বলি দেয়া হয়েছিল শুধুমাত্র দেবতাকে খুশি করার উদ্দেশ্যে। এর পাশাপাশি দেবতাদের সন্তুষ্টির জন্য ধন-সম্পদ-সোনা-দানাও উৎসর্গ করা হতো। ধন-সম্পদ তো মামুলী জিনিস, সূর্যদেবতা সবচেয়ে পছন্দ করতো মানুষের স্পন্দমান হৃৎপিণ্ড। একজন প্রশিক্ষিত পুরোহিত তার দক্ষ হাতে ছুরি দিয়ে মানুষের বুক বিদীর্ণ করে হৃৎপিণ্ড বের করে নিয়ে আসতো। নড়াচড়া করছে বা স্পন্দন দিচ্ছে এমন জীবন্ত হৃৎপিণ্ডটি উঁচিয়ে সূর্যের দিকে তাক করে ধরতো। তাদের বিশ্বাস ছিল এরকম করলে সূর্যদেব খুশি হবে এবং পৃথিবীতে শান্তি অব্যাহত রাখবে।
বলি দেবার জন্য লোক সংগ্রহ করা হতো অপরাধী বা কয়েদীদের মাঝে থেকে। বিশেষত যুদ্ধ-বন্দীদেরই বলি দেয়া হতো বেশি। সাধারণত এই বলি উৎসব হতো উঁচু কোনো স্থানে। কারণ উঁচু হলে সূর্যের কিছুটা কাছাকাছি হওয়া যায়। উপযুক্ত উঁচু স্থানের জন্য তারা উঁচু উঁচু পিরামিড নির্মাণ করতো। এ ধরনের পিরামিড নির্মাণের জন্য তারা বিশ্বে বিখ্যাত। পিরামিড নির্মাণের জন্য অ্যাজটেকদের পাশাপাশি মায়া ও ইনকা সভ্যতাও বিখ্যাত।

টেনোকটিটলান-এর পিরামিড; Image Source: tes.com
পিরামিডের উঁচুতে নিয়ে চারজন পুরোহিত বলিদানকারী লোকটিকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখতো, ছুরি চালানোর কাজটা করতো আরেকজন পুরোহিত। হৃৎপিণ্ড বের করার কাজটা দ্রুত সম্পন্ন করা হতো যেন তাজা ও স্পন্দমান অবস্থায় সূর্যদেবের নিকট উপস্থাপন করা যায়। অন্যদিকে হৃৎপিণ্ডহীন রক্তাভ মরদেহটি পাহাড় বা পিরামিডের চূড়া থেকে ফেলে দেয়া হতো। তলদেশে অপেক্ষমাণ হিসেবে থাকতো সাধারণ পূজারী লোকজন। তারা মৃতদেহকে টুকরো টুকরো করে ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে যেত। মাঝে মাঝে পূজার উদযাপন উপলক্ষে এমনকি এসব নরমাংস খাওয়াও হতো। বর্বরতার একদম চরম অবস্থা বলা যায়। পরবর্তীতে স্প্যানিয়ার্ডরা অ্যাজটেক সভ্যতার দখল নেয় এবং এর ফলে অ্যাজটেকদের এমন বর্বর প্রথার অবসান ঘটে।

Image Source: Pinterest
তবে স্প্যানিয়ার্ডদের মাধ্যমে অ্যাজটেকদের বর্বরতার অবসান ঘটলেও, পরবর্তীতে স্বয়ং স্প্যানিয়ার্ডদের হাতেই আবার নতুন করে জন্ম নেয় তাদের নিজস্ব বর্বরতা। তাদের বর্বরতা নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে।