বিগত শতাব্দী ধরে কিবোর্ড এবং টাইপিং প্রযুক্তি অনেক দূর এসেছে। আধুনিক কম্পিউটার কিবোর্ডের শুরুটা হয় টাইপরাইটার আবিষ্কারের মাধ্যমে। তাই কিবোর্ডের ইতিহাস জানতে হলে পেছন ফিরে টাইপরাইটারের ইতিহাসটি দেখতে হবে।
টাইপরাইটারের শুরুর গল্পটা অস্পষ্ট, কারণ এর পূর্বেও লেখালেখির যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে। অনেকের বর্ণনায় ১৭০০ সালের দিকে প্রথম লেখালেখির যন্ত্র আবিষ্কার করা হয় এবং লন্ডনের ‘হেনরি মিল’ এর প্যাটেন্ট করে ১৭১৪ সালে। তবে প্রথম আধুনিক টাইপরাইটার আবিষ্কার করেন ক্রিস্টোফার ল্যাথাম, ১৮৬৮ সালে। ‘টাইপরাইটার’ শব্দটিরও জনক তিনি। ১৮৭৭ সালে দ্য রেমিংটন কোম্পানি প্রথম টাইপরাইটার বাজারজাত করা শুরু করে।
টাইপরাইটারের বিবর্তন
প্রথম টাইপরাইটার কেমন ছিল? টাইপরাইটারের কথা চিন্তা করলে আমাদের মস্তিকে যে ছবিটি ভেসে উঠে আসলে তেমন ছিল না বাস্তবে। রেমিংটন কোম্পানি সেলাই মেশিন তৈরি করতো, যার ফলে প্রথম টাইপরাইটারের সাথে সেলাই মেশিনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ল্যাথাম শোলস, গ্লিডেন এবং সোউলের তৈরি টাইপরাইটারে তো প্যাডেলও ছিল। আজকের হাই টেক কম্পিউটার এবং প্লাস্টিকের যুগে আসার আগে যেমন আমাদের অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে, তেমন দিতে হয়েছে টাইপরাইটারকেও।
১৭১৪ সালে হেনরি মিলের টাইপিং মেশিনের প্যাটেন্ট ইস্যু হলেও মেশিনটি যে তৈরি হয়েছিলো এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে ১৮০৮ সালে পেলেগ্রিনো টুরি নামে এক ইতালিয়ান আরেকটি টাইপিং মেশিন তৈরি করেন। তার মেশিনটি অন্ধদের লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছিলো। তবে এই মেশিনের সাথে উদ্ভাবন হয় কার্বন কপি, যা আজকের আধুনিক যুগেও ব্যবহার হয়ে আসছে। ১৮২৯ সালে উইলিয়াম অস্টিন বারট ‘টাইপো রাইটার’ নামে একটি মেশিন তৈরি করেন যাতে ‘কী’ এর পরিবর্তে ‘ডায়াল’ ব্যবহৃত হয়। এটিও অন্ধদের লেখার উদ্দেশ্য করেই তৈরি ছিল। জন জোন্স ১৮৫২ সালে টাইপো রাইটারের নতুন একটি মডেল তৈরি করেন, কিন্তু এগুলো একটিও তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি।
১৮২৯ থেকে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত আরও মডেল আসলেও বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য সেগুলোকে বিবেচনা করা হয়নি। তবে দুটি অসাধারণ টাইপরাইটার তৈরি হয়েছিলো: ১৮৬১ সালে ব্রাজিলিয়ান ‘জাও দে এজেভাদো’র তৈরি গৃহজাত টাইপরাইটার, যেটি তিনি কাঠ দিয়ে তৈরি করেছিলেন, এবং হ্যানসেন রাইটিং বল, যা ১৮৬৫ সালে তৈরি হয়েছিলো। এজেভাদোর টাইপরাইটারটি পরবর্তীতে বাণিজ্যিক টাইপরাইটারের সাথে মিল থাকায় ব্রাজিলিয়ানরা প্রথম টাইপরাইটার আবিষ্কারের দাবি করে।
এরপর ১৮৬৫ সালে ডেনমার্কের রাজমুস মেইলিং হ্যানসেনের তৈরি রাইটিং বল ইউরোপ এবং ইংল্যান্ডে খানিকটা সাড়া ফেলে দেয়। অর্ধ গোলকাকৃতির এই টাইপরাইটার ছিল সবার চেয়ে আলাদা। এই রাইটিং বল আবিষ্কারের কিছু পরেই ১৮৬৭ সালে শোলস (একজন আবিষ্কারক), গ্লিডেন (একজন মেকানিক) ও সউল (একজন প্রিন্টার) তাদের ‘টাইপরাইটার’ নিয়ে আসেন, যা টাইপিং প্রযুক্তি একেবারে বদলে দেয়। আজকের QWERTY কীবোর্ড লে-আউট তৈরি করেন শোলসই। তার পার্টনার জেমস ডেন্সমরের সহায়তায় ১৮৭৮ সালে প্যাটেন্ট করেন তিনি। কিন্ত সেসময়ের প্রযুক্তির তুলনায় এই লে আউট ছিল অনেক এগিয়ে। ১৯৩৬ সালে DVORAK লে আউট প্যাটেন্ট করা হয় (সামনে আলোচনা রয়েছে), কিন্তু সময়ের বিবর্তনে QWERTY জনপ্রিয়তা লাভ করে।
এরপর এই টাইপরাইটার মডেলের পরিমার্জন চলতে থাকে। পা-চালিত প্যাডেলটি সরিয়ে ফেলা হয়, যার ফলে এর চেহারা অনেকটা আমাদের পরিচিত টাইপরাইটারের মতো হয়ে ওঠে। ১৯১০ সাল অব্দি সব টাইপরাইটার এই একই মডেলে তৈরি হতে থাকে। এরপর ১৯৬১ সালে আইবিএম কোম্পানির ‘সেলেক্ট্রিক’ মডেলটি টাইপরাইটারের জগতে ভালো রকমের পরিবর্তন আনে। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এর তিনটি মডেল বের হয়। টাইপরাইটার তার যুগ থেকে আজ অনেক দূর। তবু সরকারি অফিসগুলোতে এর ব্যবহার দেখা যায়। অনেকটা ঐতিহ্যের খাতিরেই।
কম্পিউটার কীবোর্ডের উত্থান
১৯৫০-৭০ পর্যন্ত যখন টাইপরাইটারের বহুল ব্যবহার চলছিল, তখন কম্পিউটার কেবল তার অস্তিত্ব প্রমাণ করা শুরু করে। বিশ্বের প্রথম ডিজিটাল কম্পিউটার এনিয়াক-এ ইনপুট-আউটপুটের জন্য পাঞ্চকার্ড ব্যবহার হত। একে টেলেটাইপ প্রযুক্তি বলা হয়। টেলেটাইপ যন্ত্রে ‘কী’ প্রিন্ট করা থাকতো। ডাটা ইনপুট করতে হলে সেই নির্দিষ্ট কী-হোলে কার্ড পাঞ্চ করতে হত। তারপর সেই পাঞ্চ কার্ড কার্ড রিডারে প্রবেশ করিয়ে ডাটা পাওয়া যেতো। ১৯৪৮ সালে BINAC কম্পিউটার ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক টেলেটাইপ পদ্ধতিতে ইনপুট-আউটপুট করতো। কিন্তু পাঞ্চকার্ড থেকে সরে আসতে আমাদের লেগেছে আরও কয়েক দশক। এসময়ে কম্পিউটার তার আধুনিকতার ছোঁয়া বাড়িয়ে চলে। UNIVAC কম্পিউটারটি সেসময় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এটিও টেলেটাইপ প্রযুক্তি ব্যবহার করত।
১৯৬৪ সালে বেল ল্যাবস এবং এমআইটি একসঙ্গে MULTICS কম্পিউটার তৈরি করে। এই কম্পিউটারে VDT (Video Display Terminal) প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে। এরপর সব কিছু বদলে যায়। এই প্রযুক্তির সাহায্যে টাইপ করার সাথে সাথে সেটি স্ক্রিনে দেখা যেত, যার ফলে কমান্ড দেয়া, যোগাযোগ এবং কম্পিউটার কন্ট্রোল করা পূর্বের চেয়ে আরও সহজ এবং সাশ্রয়ী হয়ে ওঠে। ১৯৭০ সালের দিক থেকে সব কম্পিউটার VDT ও ইলেক্ট্রিক কিবোর্ড ইউজ করা শুরু করে। ১৯৭০ সালের পর থেকে যত কিবোর্ড বিক্রি করা হয় সবই শূন্য থেকে তৈরি করা ছিল, একদম হাতের তৈরি।
১৯৮১ সালে আইবিএম তাদের প্রথম পিসি উন্মোচন করে। এই পিসির সাথে মডেল এম কীবোর্ডটি সংযুক্ত ছিল। এই কম্পিউটারটি বৃহৎ আকারে সফলতা লাভ করে। এর কারণ এটি সহজেই ব্যবহার করা যেত। এটি ছিল মেকানিক্যাল কিবোর্ড এবং সর্বোচ্চ মানের কন্সট্রাকশন দিয়ে তৈরি ছিল। ফলে এটি ব্যবহারে ছিল সন্তোষজনক অনুভূতি।
১৯৯০ সালের দিকে মেমব্রেন সুইচ মেকানিক্যাল সুইচকে প্রতিস্থাপন করা শুরু করে। মেমব্রেন সুইচ শব্দ কম করতো এবং হালকা ছিল, যার ফলে ল্যাপটপে ব্যবহারের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে। মেমব্রেন কিবোর্ড তৈরি করতে খরচও কম হত, যার ফলে কিবোর্ডের দামও কমতে থাকে। এরপর থেকে কিবোর্ডের ডিজাইন আরও আধুনিক হতে থাকে। বের হয় সব অদ্ভুত কিবোর্ড। মিনি কিবোর্ড, এক হাতের জন্য তৈরি কিবোর্ড, মাউস-কিবোর্ড কম্বসহ নানা ডিজাইন। ২০১৪ সালে Corsair প্রথম RGB মেকানিক্যাল কিবোর্ড বাজারে আনে। আজকের কম্পিউটারের দুনিয়ায় এখন সবজায়গায় RGB এর ছড়াছড়ি। Corsair এর মাধ্যমে কিবোর্ডে নতুন মাত্রা যোগ হয়।
DVORAK কিবোর্ড
১৯৩২ সালে প্রফেসর অগাস্ট ডেভরাক এমন একটি কিবোর্ড বানাতে চান যেটি ব্যবহারে QWERTY এর চেয়ে সহজ হবে এবং সময়সাশ্রয়ী হবে। এর মাঝের সারিতে ইংরেজি ৫টি স্বরবর্ণ এবং বেশি ব্যবহৃত ব্যাঞ্জনবর্ণ ছিল। যেগুলো হচ্ছে AOEUIDHTNS। এই সারিকে বলা হয় হোম রো। ৭০ শতাংশ শব্দে এই সারির বর্ণগুলো ব্যবহৃত হয়। QWERTY-র হোম রো শুধু ৩২ শতাংশ শব্দে। আরও একটি পরিসংখ্যানে জানা যায়, গড়ে আট ঘণ্টার সময়ে একজন টাইপিস্টের হাত QWERTY কীবোর্ডে প্রায় ১৬ মাইল ভ্রমণ করে, যেখানে DVORAK-এ শুধু ১ মাইল। এছাড়া যারা শুধু এক হাত দিয়ে টাইপ করতে চান তাদের জন্য দুটি আলাদা DVORAK কীবোর্ড রয়েছে। একটি বাম হাত ও আরেকটি ডান হাতের জন্য।
এত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এটি হেরে যায় QWERTY-র কাছে। কারণ ইতোপূর্বেই মানুষ QWERTY লে আউট-এ দক্ষ হয়ে উঠেছিল, আর টাইপরাইটার কোম্পানিগুলো নতুন করে এই লে আউট বানাতে আগ্রহ দেখায়নি। অভ্যাস এবং পরিচিতির কাছে হেরে গিয়েছে একজন বুদ্ধিমান মানুষের কারুকার্য। এখনও কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ এটি ব্যবহার করে যান। চাইলে করতে পারেন আপনিও। তবে DVORAK কিবোর্ড খুঁজতে একটু বেগ পেতে হতে পারে।
কিবোর্ডে পারদর্শিতা অনেক কাজের একটি দক্ষতা। সবক্ষেত্রেই এটি প্রায় কাজে লাগে। তবে মোবাইল এবং কম্পিউটার কিবোর্ডে দক্ষ হওয়া আলাদা ব্যাপার কিন্তু। দুই আঙ্গুলে দক্ষ হলে শুধু হবে না, দশ আঙ্গুলেই হতে হবে। না পারলে শিখে নিতে পারেন সহজেই। কীবোর্ডের দাম হাতের নাগালেই, আর স্মার্টফোন তো রয়েছেই। ওটিজি ব্যবহার করে কানেক্ট করে শেখা শুরু করুন নাহয়!