অদ্ভুত রহস্যময় আমাদের এই পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছে নানা রহস্যময় জিনিস, যার কোনোটির রহস্য হয়তো মানুষ জানতে পেরেছে আবার কোনোটির পারেনি। বহুকাল ধরেই মানব ইতিহাসে বহু রহস্যময় প্রাণীর খবর পাওয়া গেছে। যেমন- ড্রাগন, বিগফুট, ইয়েতি, ওয়্যারউলফ ইত্যাদি। এসব প্রাণীর বেশির ভাগই কাল্পনিক। তবে ইতিহাসের বহু গল্প, উপকথা কিংবা ভ্রমণকাহিনীতে এমন কিছু রহস্যময় প্রাণীর কথা উল্লেখ রয়েছে যাদেরকে শুধু কাল্পনিক বলে এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
এদের সম্পর্কে ইতিহাসে রয়েছে নানা প্রমাণ, নানা দলিল। বিখ্যাত বহু পর্যটকও যাদের কথা উল্লেখ করছেন। তেমনই এক প্রাচীন রহস্যময় প্রাণী জাতি হলো ‘সাইনোসেফালি’ বা কুকুরমুখো মানুষ। কুকুর বা শেয়ালের মতো মাথাওয়ালা মানুষ হিসেবেও এরা পরিচিত। বহুকাল আগে পৃথিবীর বুকে বিচরণ ছিল এই রহস্যময় কুকুরমুখো মানবদের। চলুন আজকে জেনে নিই এই রহস্যময় সাইনোসেফালি সম্পর্কে।
কারা এই সাইনোসেফালি?
সাইনোসেফালি (Cynocephali) শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ‘cyno’, যার অর্থ কুকুর এবং ‘cephaly’, যার অর্থ একধরনের মাথার অসুখ, এই দুটি গ্রীক শব্দ থেকে। সাইনোসেফালি দ্বারা এমন এক রহস্যময় মানব গোষ্ঠীকে বোঝানো হয় যাদের মাথা কুকুর কিংবা শেয়ালের মতো। তারা মানুষের ভাষা বুঝতে পারতো তবে কথা বলতে পারতো না। যদিও ইতিহাসের কিছু কিছু জায়গায় এদের সভ্য মানুষের মতো সামাজিক ভাবে বসবাস করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তবে বেশীরভাগ ইতিহাসবিদের মতে তারা ছিল বর্বর পশুদের মতো, যারা প্রধানত শিকার করে জীবনধারণ করতো।
এটুকু শুনেই আপনার হয়তো মনে হচ্ছে ড্রাগন, ওয়্যারউলফের মতো এটিও কোনো এক কাল্পনিক গালগল্প! কিন্তু না, সাইনোসেফালিদের অস্তিত্ব বিশ্বাস করার মতো বহু কারণ ইতিহাসবিদদের কাছে রয়েছে। বহু বিখ্যাত পর্যটক ও অভিযাত্রী, যেমন ক্রিস্টোফার কলোম্বাস, মার্কো পোলো এই সাইনোসেফালির বর্ণনা দিয়েছেন। এছাড়াও প্রাচীন মিসর, গ্রীস, মধ্যযুগীয় ইউরোপ ও আফ্রিকার মতো বহু প্রাচীন সভ্যতায় এবং খ্রিস্টীয় পুরানে এদের কথা উল্লেখ রয়েছে।
ইতিহাসে সাইনোসেফালি
খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দে বিখ্যাত গ্রীক ডাক্তার সিটেসিয়াস সাইনোসেফালিদের বিশদ বিবরণ সহ চমৎকার একটি প্রতিবেদন লেখেন। তৎকালীন ভারতের পাহাড়ে দেখতে পাওয়া সাইনোসেফালি সম্পর্কে তিনি তার লেখায় বর্ণনা দেন। সে সময় ভারত ‘ইন্ডিকা’ নামে পরিচিত ছিল। তার লেখায় তিনি এক ধরণের মানব উপজাতির কথা বলেন যাদের মাথা ছিল কুকুরের মতো। তারা কুকুরের মতো ‘ঘেউ ঘেউ’ করে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করতো। তবে এরা মানুষের কথা ঠিকই বুঝতে পারতো। এদের প্রধান খাবার ছিল মাংস। এদের দাঁত ছিল কুকুরের মতো, তবে কিছুটা লম্বা। নখগুলো ছিল লম্বা ও বাঁকানো।
বিভিন্ন সূত্র থেকে তিনি জেনেছিলেন, এরা মূলত শিকার করে জীবনধারণ করতো। শিকার ধরার পর তা মেরে রোদে ঝলসিয়ে খেতো তারা। এরা ভেড়া ও ছাগল পালন করতো। এছাড়া তৎকালীন ভারতে জন্মানো ‘সিপ্তাখোরা’ নামের একটি ফল ছিল এদের খুব প্রিয়। এরা এই ফলের চাষ করতো এবং উৎপাদিত ফলের বিনিময়ে মানুষের কাছ থেকে রুটি, ময়দা, সুতা সহ তরবারি, ঢাল, তীর, ধনুক প্রভৃতি জিনিস কিনতো। সিটেসিয়াস তার লেখায় আরো জানান,
“তারা বাড়িতে নয় বরং গুহায় বাস করতো। তীর-ধনুক নিয়ে শিকারকে তাড়া করতো। এরা ছিল খুব দ্রুত গতিসম্পন্ন। খুব দ্রুতই এরা এদের শিকারকে ধরে ফেলতে পারতো। এদের মধ্যে নারীরা মাসে একবার গোসল করতো, তবে পুরুষেরা কখনো গোসল করতো না। এরা চমৎকার চামড়ার তৈরি পোশাক পরতো। এদের মধ্যে যারা ধনী ছিল তারা কেউ কেউ লিলেনের পোশাকও পরতো। ঘুমানোর জন্য এদের কোনো বিছানা ছিল না। এরা ঘাসের উপরে ঘুমাতো। যার সবচেয়ে বেশি ভেড়া থাকতো তাকেই সবচেয়ে ধনী হিসাবে ধরা হতো। নারী পুরুষ উভয়েরই পেছনের দিকে কুকুরের মতো লম্বা লেজ ছিল। তবে এই লেজ কুকুরের লেজের চেয়ে বেশি লম্বা ও লোমশ হতো। স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে এদের আয়ু ছিল অনেক বেশি। গড়ে ১৭০-২০০ বছর পর্যন্ত বাঁচতো এরা।”
তৎকালে ভারত ছিল সাইনোসেফালিদের প্রধান বাসস্থান। গ্রীক অভিযাত্রী ‘মেগাস্থিনিস’ও ভারতে কুকুরের মতো মাথাযুক্ত এক ধরনের মানুষের সাথে সাক্ষাৎ লাভের কথা উল্লেখ করেন। দার্শনিক ‘ক্লাউডিয়াস অ্যালিয়েনাস’ তার লেখায় ভারতের এই কুকুরমুখো মানুষের কথা উল্লেখ করেন, যারা রোদে শুকানো মাংস খেয়ে বেঁচে থাকতো এবং ছাগল ও ভেড়া পালন করতো। এছাড়াও আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট তার গুরু অ্যারিস্টটলকে লেখা কয়েকটি চিঠিতে দাবি করেন যে, তিনি খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে যখন ভারত আক্রমণ করেছিলেন তখন এমন অনেক কুকুরের মতো মাথা যুক্ত মানুষ দেখেছিলেন।
তিনি আরো বলেন, যুদ্ধে অংশ নেয়া এমন মাথাযুক্ত কয়েকটি মানুষকে তিনি আটকও করেছিলেন, যারা রেগে গিয়ে কুকুরের মতো ‘ঘেউ ঘেউ’ শব্দ করতো। গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসও তার লেখায় এদের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন,
“লিবিয়ার উত্তরদিকে নিচু বেলেমাটির স্থানে যেখানে মেষপালকদের বাস, সেখান থেকে পশ্চিমে ট্রাইটন নদী পর্যন্ত পাহাড়ি জঙ্গলে নানা পশু বাস করে। এখানে কুকুরের মতো চেহারার মানুষ দেখতে পাওয়া যায়। লিবিয়ার অধিবাসীদের মতে, এদের চোখ দুটি বুকে অবস্থিত।”
এমনই বহু শতাব্দী ধরে বহু বীর যোদ্ধা, বহু মিশনারি, বহু অভিযাত্রীর বর্ণনায় উঠে এসেছে এই সাইনোসেফালির কথা। পরবর্তী সময়ে রোমান লেখক, পরিবেশবিদ ও দার্শনিক প্লিনি দ্য এল্ডার তার ‘ন্যাচারাল হিস্টোরি’ বইতেও এদের কথা লিখেছিলেন। তিনি এদেরকে রহস্যময় এক মানব সম্প্রদায় হিসেবে উল্লেখ করেন এবং এদের ‘দ্য মনস্ট্রোয়াস রেস’ নামে আখ্যা দেন।
সাইনোসেফালির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন খ্রিস্ট ধর্মের সেইন্ট ক্রিস্টোফার। বহু লেখায় উল্লেখিত বর্ণনা অনুসার, ক্রিস্টোফারের দেহ ছিল মানুষের মতো, কিন্তু মাথা কুকুরের মতো, অর্থাৎ তিনিও ছিলেন সাইনোসেফালির একজন। শুধু তা-ই নয়, এই ধর্মীয় ব্যক্তি পূর্বে ছিলেন একজন বন্য ও দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, যিনি ‘সাইরেনাইকার’ যুদ্ধে বন্দি হন। বর্ণনা মতে, তিনি ছিলেন কুকুরের মতো মাথাবিশিষ্ট বিশালদেহী এক মানুষ এবং সাইনোসেফালির একটি যোদ্ধা গোত্রে তার জন্ম হয়েছিল। খ্রিস্টীয় পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, ক্রিস্টোফার যিশু খ্রিস্টের সাক্ষাৎ লাভ করেন এবং পরবর্তীতে পূর্বের পাপকাজ পরিত্যাগ করে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নেন। বহু ঐতিহাসিক চিত্রকর্মে কুকুরমুখী এই সন্ন্যাসীর ছবি রয়েছে।
এসব তো গেলো প্রাচীন যুগের কথা। পরবর্তী যুগে ইতালিয়ান সন্ন্যাসী ‘ওডোরিক ওফ পর্ডেনান’, ফ্রেঞ্চ কার্ডিনাল ‘পিয়ের ডি অ্যালিয়ে’, পর্যটক ‘জিওভানি ডা পিয়ান ডেল কার্পাইন’ সহ বহু বিখ্যাত অভিযাত্রী ও পর্যটকেরাও বর্ণনা করেছেন এই সাইনোসেফালির কথা। বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলো তার লেখায় ‘আনগামানিয়ান’ দ্বীপ ভ্রমণের সময় সাইনোসেফালি সম্পর্কে লিখেছেন,
“আনগামানিয়ান একটি বিশাল দ্বীপ। এই দ্বীপের অধিবাসীরা মূর্তিপূজারী। এদের কোনো রাজা নেই। বন্য পশুর থেকে কোনো অংশেই কম নয় এরা। আমি আপনাদের নিশ্চিতভাবে বলছি, এই দ্বীপের সব অধিবাসীই মাথা, দাঁত ও চোখ কুকুরের মতো। বলা যায় চেহারার দিক দিয়ে এরা বড় আকারের কুকুর। এদের অনেকগুলো প্রজাতি রয়েছে। তবে এরাই সবার চেয়ে বেশি হিংস্র। নিজের মতো ছাড়া অন্য আর যা কিছু এদের সামনে আসুক না কেন এরা তা ধরে খেয়ে ফেলে।”
শুধু মার্কো পোলোই নয়, বিখ্যাত অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাসও এই সাইনোসেফালির কথা উল্লেখ করছেন। তিনি এক অভিযানে হাইতি, যা তৎকালীন সময়ে বোহিও নামে পরিচিত ছিল সেখানে গিয়ে এমন কুকুরের মতো মাথা যুক্ত মানুষ দেখতে পান। রানী ইসাবেলাকে লেখা চিঠিতে তিনি এদের কথা উল্লেখ করেন।
ইতিহাসের বহু স্থানে স্থান পাওয়া এই সাইনোসেফালির দেখা মিলেছিল প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতাতেও। মিশরীয়দের ‘হাপি’ ও ‘আনুবিস’ নামের দুজন দেবতাও ছিল এমন কুকুরের মতো মাথা বিশিষ্ট মানুষ অর্থাৎ সাইনোসেফালি।
ইতিহাসের এত বেশি স্থানে এবং এত বিখ্যাত সব ব্যক্তির বর্ণনায় এদের উল্লখে রয়েছে যে, এদের অস্তিত্ব চাইলেই গবেষকরা অস্বীকার করতে পারেন না। তবে এই ক্ষুদ্র কিন্তু শক্তিশালী জাতির কী হয়েছিল তা আজও কেউ সঠিক ভাবে বলতে পারে না। ধারণা করা হয়, আশেপাশের সাম্রাজ্যগুলোর বিস্তারের সাথে সাথে এদেরকে হত্যা করা হয়। এরা এমনই এক যোদ্ধা জাতি ছিল যারা অন্যের শাসন, পরাধীনতা কিংবা অন্যের আচার আচরণ মেনে চলার চেয়ে মৃত্যুবরণ করাকেই বেশি সম্মানের মনে করতো। ফলে হয়তো বিভিন্ন শক্তিশালী ও বড় জাতির হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল এদের। তবে যা-ই হোক না কেন, মানুষের দৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ রূপে আড়াল হয়ে গেছে এই সাইনোসেফালিরা। হয়তো সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এরা। কিংবা কে জানে, হয়তো আজও এদের কেউ কেউ বেঁচে আছে, লুকিয়ে আছে কোনো দুর্গম গুহায় লোকচক্ষুর আড়ালে!
ফিচার ইমেজ – tattoo.ru