প্রাচীন ও মধ্যযুগে পুরো ইউরোপকে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে পথ দেখালেও আধুনিক যুগের সূচনালগ্নে, শিল্পবিপ্লবের সময় ইতালি বেশ পিছিয়ে পড়েছিল। এজন্য আমরা দেখতে পাই, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি কিংবা বেলজিয়ামে শিল্পবিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার বেশ পরে ইতালিতে শিল্পবিপ্লবের বাতাস বইতে শুরু করে, কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্প-নির্ভর অর্থনীতির দিকে ইতালির যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু দেরিতে হলেও দেশটি খুব দ্রুত সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করেছিল, যেটি ইতালির আধুনিক গাড়িনির্মাণ শিল্পের উত্থান ঘটাতে বেশি দেরি করেনি।
শিল্পবিপ্লবের কারণে ইতালিয় সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতে কিছু অর্থসম্পদ জড়ো হয়, বিলাসবহুল দ্রব্যের চাহিদা সৃষ্টি হতে শুরু করে। আজ থেকে ১২০ বছর আগে মোটরচালিত গাড়ি সেসময়ের বাস্তবতায় বিলাসবহুলই ছিল বটে। মোটরগাড়ির একটা চাহিদা সেসময় তৈরি হয়েছিল বলেই ইতালীয় বিনিয়োগকারীরা গাড়ি নির্মাণশিল্পের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হন।
ইতালির তুরিন শহরে জিওভান্নি আগনেল্লি নামের এক ব্যক্তি ইতালির আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পেরেছিলেন, সেদেশে মোটরগাড়ির বেশ বড় বাজার আছে, সমাজের উচ্চশ্রেণীর ক্রেতাদের চাহিদামতো পছন্দসই গাড়ি তৈরি করতে পারলে আর পেছনে তাকাতে হবে না। এই ভেবেই ১৯০০ সালের দিকে তিনি ও তুরিনের স্থানীয় কিছু বিনিয়োগকারী মিলে গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠানের চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দেন। তুরিনের কোর্সো দান্তে নামক এলাকায় ১৫০ জন শ্রমিক নিয়ে গড়ে তোলা হয় ফিয়াট কোম্পানির প্রথম কারখানা। ফিয়াট (FIAT) এর পূর্ণরূপ হচ্ছে ‘Fabrica Italiana Automobili Torino‘, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘ইতালীয় গাড়িনির্মাণ কারখানা, তুরিন‘।
বিনিয়োগকারী জিওভান্নি আগনেল্লি ব্যবস্থাপনা পরিষদে থাকলেও পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে তিনি কোম্পানির উদ্ভাবনী বিভাগে যোগ দেন। তার দূরদর্শিতার কারণে ইতালির বাজারে ফিয়াট কোম্পানির গাড়ির চাহিদা বাড়তে থাকে। প্রথম বছরে মোট চব্বিশটি গাড়ি তৈরি হয় তুরিনের সেই কারখানায়। তাদের ডিজাইন করা প্রথম গাড়ির মডেল ছিল থ্রি এন্ড হাফ সিভি (The 3 ½ CV)। পরের বছর ইতালীয় রেসার ভিনসেঞ্জো ল্যান্সিয়া একটি প্রতিযোগিতায় ফিয়াট টোয়েন্টি ফোর এইচপি (FIAT 24 HP) মডেলের গাড়ি নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। সেই প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম হয়ে রেস শেষ করেন এবং এই ঘটনা ইতালিতে ফিয়াট কোম্পানির চাহিদা বিপুল পরিমাণ বৃদ্ধি করে। ইতালির দ্বিতীয় কার ট্যুরে প্রেসিডেন্ট জিওভান্নি আগনেল্লি সশরীরে অংশগ্রহণ করেন এবং ফিয়াট এইট এইচপি (FIAT 8HP) মডেলের গাড়ি নিয়ে রেকর্ডের খাতায় নাম লেখান।
ইতালির বাজারে নিজেদের অবস্থান শক্ত করার পর ফিয়াট বহির্বিশ্বের দিকেও নজর দিতে শুরু করে। ইতালির বাইরে সর্বপ্রথম আমেরিকায় ১৯০৮ সালে তারা কারখানা স্থাপন করে। বলা বাহুল্য, আমেরিকাতেও তারা সাফল্য লাভ করে। সেই সময়ে আমেরিকান কোম্পানিগুলোর চেয়ে ফিয়াট কোম্পানির তৈরিকৃত গাড়িগুলোর দাম অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও আমেরিকার বাজারে সফলভাবে তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে এবং বড় আকারে উৎপাদন শুরু করে। ধীরে ধীরে মোটরগাড়ির পাশাপাশি তারা ট্রাক, ট্রামের ইঞ্জিন, জাহাজের ইঞ্জিন ইত্যাদি খাতেও বিনিয়োগ শুরু করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েও ফিয়াট কোম্পানির জয়যাত্রা অব্যাহত ছিল। ১৯১৬ সালের কোম্পানির নতুন নেতৃত্বের আদেশে তুরিনের লিনগোত্তো জেলায় ইউরোপের সবচেয়ে বড় গাড়িনির্মাণ করার কারখানার কাজ শুরু হয় যেটি শেষ হয় ১৯২২ সালে। পুরো ইউরোপ জুড়ে যতগুলো গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান ছিল, তাদের মধ্যে ফিয়াট নিজেদের অর্জিত মুনাফা দিয়ে এই সুবিশাল পাঁচতলা কারখানা তৈরি করতে সক্ষম হয়। ফিয়াটের জন্য এটি ছিল বিশাল এক অর্জন, ইতালির বাকি কোম্পানিগুলোর জন্য ছিল অনুপ্রেরণা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রশক্তির পক্ষে ইতালি অংশগ্রহণ করে এবং ফিয়াট কোম্পানি নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী মিত্রবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য যানবাহন ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। তাদের তৈরি গাড়ি ও সরঞ্জামের মান এত ভাল ছিল যে, বিশ্বযুদ্ধের সময় তাদের ক্রেতাদের মধ্যে ব্রিটিশ নৌবাহিনী ও ডাক বিভাগও ছিল!
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা অংশগ্রহণ করলে সেই দেশ থেকে ইতালি ব্যবসা গুটিয়ে নেয় এবং ইতালিতে ফেরত চলে আসে। বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালিতে সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতৃত্বে কমিউনিস্টরা বেশ গোলযোগ শুরু করলে কোম্পানির বেশ কিছু কারখানা শ্রমিকদের দখলে চলে যায়। কিন্তু খুব বেশিদিন কোম্পানিকে ঝামেলা পোহাতে হয়নি, ১৯২৩ সালের দিকে তারা আবার পূর্ণোদ্যমে নিজেদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করে। বাজারে টিকে থাকতে হলে উদ্ভাবনী দক্ষতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটাতে হয়– এই নীতিকে কাজে লাগিয়ে তারা নতুন ডিজাইনের বেশ কিছু গাড়ি বাজারে নিয়ে আসে এবং বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব সময়ে তাদের যে জনপ্রিয়তা ছিল, তা ফিরে আসতে থাকে।
ইতালিতে মুসোলিনি ক্ষমতায় যাওয়ার পর কোম্পানিটি তাদের বেশ কিছু পরিকল্পনা বাতিল করে দেয়, কারণ বিদেশে ব্যবসার প্রায় সকল পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৩৪-৩৬ সালের মধ্যে ‘তোপোলিনো’ এবং ‘তারিফা মিনিমা’ নামের দুটো বিশ্বমানের গাড়ি বাজারে আনা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে ফিয়াট কোম্পানির উৎপাদন ও বিপণন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। মুসোলিনির নির্দেশে প্রায় প্রতিটি কারখানাকে যুদ্ধের সরঞ্জাম তৈরির কারখানায় রূপান্তর করা হয়। শত্রুশক্তির আক্রমণে অসংখ্য ফ্যাক্টরি একেবারে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। যেগুলো ছিল, সেগুলো শেষ পর্যন্ত ইতালির সামরিক বাহিনীকে সাহায্য করেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে স্বৈরশাসক মুসোলিনির যখন পতন প্রায় নিশ্চিত, তখন তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে পালাতে চেয়েছিলেন। ফিয়াট কোম্পানির বিলাসবহুল ফিয়াট ২৮০০ বার্লিনেত্তা মডেলের গাড়ি নিয়ে পালানোর সময় তিনি ধরা পড়েন, তাকে সস্ত্রীক হত্যা করা তো হয়েছিলই, তার গাড়িকেও ফ্যাসিবাদের চিহ্ন হিসেবে একটি জলাশয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হয়। মুসোলিনির সাথে সম্পৃক্ততা থাকার কারণে আগনেল্লি পরিবারের হাত থেকে মালিকানা ছিনিয়ে নেয়া হয়। তবে ১৯৬৬ সালের তা আবার ফিরিয়ে দেয়া হয়।
১৯৪৫ সালে কোম্পানির অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা ও সাফল্যের মূল কারিগর জিওভান্নি আগনেল্লি মারা গেলে ভিত্তোরিও ভ্যালেত্তার উপর দায়ভার অর্পণ করা হয়। বিশ্বযুদ্ধের সময় যেসব কারখানা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো পুনর্নির্মাণ করা হয়, নতুন কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়। উদ্ভাবনের অংশ হিসেবে ফিয়াট ৫০০ ও ফিয়াট ১৮০০ মডেলের দুটি গাড়ি বাজারে আসে, যেগুলোতে প্রথমবারের মতো তাপ নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটানো হয়। গাড়িনির্মাণ ছাড়াও বিমানের ইঞ্জিন নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয় তারা।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ইতালির অর্থনৈতিক অগ্রগতি চরম মাত্রা লাভ করে। এর পেছনে ফিয়াট গাড়িনির্মাতা কোম্পানি ও এর উদ্ভাবনী শক্তির বড় ধরনের অবদান ছিল। ইতালির গাড়ির বাজারে একধরনের বিপ্লব ঘটে যায়, গাড়িক্রেতা পরিবারের সংখ্যা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর এই সুযোগ কাজে লাগায় ফিয়াট। এছাড়াও মুসোলিনির সময়ে বিদেশে ব্যবসা প্রসারের যে বাধা ছিল, তা সরে যাওয়ায় বিদেশেও তারা ব্যাপকহারে রপ্তানি শুরু করে। ফিয়াটের গাড়িগুলো আগে থেকেই তাদের উচ্চমানের কারণে বিখ্যাত ছিল, তাই বৈদেশিক বাজারেও তাদেরকে হটানোর মতো কেউ ছিল না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আর কখনও ফিয়াটকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সময়ের সাথে সাথে তারা বিজ্ঞানের উৎকর্ষতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন সুবিধা যোগ করেছে তাদের গাড়িগুলোতে, যেগুলো ক্রেতাদের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। ব্রাজিলের মতো পৃথিবীর অনেক দেশে ফিয়াট অটোমোবাইল শিল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছে। জিওভান্নি আগনেল্লির মতো কিছু স্বপ্নচারী মানুষের হাত ধরে যে কোম্পানির যাত্রা শুরু ১২০ বছর আগে, এখনও সেই কোম্পানি দুর্দমনীয় গতিতে এগিয়ে চলেছে সমানতালে, হয়তো চলবে সামনেও।