বর্তমান পাকিস্তানে অবস্থিত সিন্ধুর লারকানা জেলায় মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছিলেন তিনি, যা বদলে দিয়েছিল গোটা ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসকেই। কিন্তু জীবদ্দশাতেই তিনি দেখে গিয়েছিলেন কীভাবে তার প্রাপ্য কৃতিত্ব হাতিয়ে নিচ্ছে ব্রিটিশরা। এবং তিনি যা দেখে যেতে পারেননি, কিংবা হয়তো কল্পনাও করেননি, তা হলো—নিজ দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও মনে রাখেনি তাকে। ইতিহাস বইতে দুই-একবার হয়তো নাম এসেছে তার, একজন ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ব বিশারদ হিসেবে, কিন্তু তার অপর পরিচয়গুলো যেন হারিয়েই গেছে ইতিহাসের অতল গহীনে।
বলছি রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় কিংবা আর ডি ব্যানার্জির কথা। সম্প্রতি তাকে নিয়ে ‘Rakhal Das Banerji: The Forgotten Archaeologist’ নামে একটি বই লিখেছেন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অভ ইন্ডিয়া (এএসআই)-এর পূর্বাঞ্চলের সাবেক পরিচালক ফনিকান্ত মিশ্র। সেখানেই বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে, কীভাবে রাখালদাসের সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতা আবিষ্কারের কৃতিত্ব ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল প্রকাশ্য ও নির্লজ্জ চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে।
অভিযুক্ত ব্যক্তিটি হলেন স্যার জন মার্শাল। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বে তার অবদানও কম নয়। ১৯০২ থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত, সবচেয়ে বেশি সময় ধরে এএসআই-এর মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। কিন্তু যেভাবে রাখালদাসের কাজের স্বীকৃতি তিনি নিজের নামে আদায় করেছিলেন, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের ব্যাপারে প্রথম প্রতিবেদনটি রচনা করা হয়েছিল ১৯২০ সালে, এবং সেটি করেছিলেন রাখালদাসই। কিন্তু সেটিকে গোপন করার চেষ্টা করেছিলেন মার্শাল। রাখালদাসের করা পরবর্তী প্রতিবেদনগুলোও প্রকাশ্যে আসা রোধ করেছিলেন তিনি। অথচ ১৯২২ সালে রাখালদাসের জমা দেয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনটিকেই সম্পাদনা করে তিনি তৈরি করেছিলেন তার বিখ্যাত ‘Mohenjodaro and the Indus Civilisation’ বইটি। এ প্রসঙ্গে ফনিকান্ত মিশ্র বলেন,
“এটি ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি চুরির একটি নিদারুণ নিদর্শন। এক তরুণ ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ববিদের কঠোর পরিশ্রমের ফসল কেড়ে নিয়েছিলেন তার কর্তা। বিশ্ব আজ জানে মার্শালই আবিষ্কার করেছিলেন সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ, এবং এটিই পড়ানো হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। রাখালদাস যেন নিছকই তাৎপর্যহীন একটি ফুটনোট মাত্র!”
এই কাহিনীর সূত্রপাত আসলে ১৯১৭ সালে। শুরুটা রাখালদাসের জন্য বেশ আশাজাগানিয়াই ছিল। সেই সাথে সৌভাগ্যজনকও। প্রথমত, একটি পদোন্নতি পেয়েছিলেন তিনি। আগে এএসআই-এর সহকারী সুপারিনটেন্ডেন্ট এবং ক্যালকাটা ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ইন-চার্জ ছিলেন তিনি। সেখান থেকে তিনি পরিণত হন পশ্চিমাঞ্চলের সুপারিনটেন্ডেন্ট।
রাখালদাসের জন্য সেটি ছিল একটি বিশাল ব্যাপার। কারণ পশ্চিমাঞ্চল ছিল এএসআই-এর সবচেয়ে বড় অংশ, যার অধীনে ছিল বোম্বে, সিন্ধু, হায়দরাবাদ ও কেন্দ্রীয় ভারত। তাই নতুন দায়িত্ব লাভের পর খুশিমনেই কলকাতা থেকে পুনেতে স্থানান্তর করেছিলেন তিনি।
পশ্চিমাঞ্চলের শীর্ষস্থানীয় পদে উপবিষ্ট রাখালদাস ১৯২০ সালে প্রথম সিন্ধু নদীর শুকনো গর্ভে স্তূপ বা ঢিবির সন্ধান পান। প্রাথমিকভাবে তিনি গ্রিকদের বিজয়স্তম্ভ খুঁজতে শুরু করেন সেখানে। এর কারণ, তার উপর মার্শালের নির্দেশ ছিল গান্ধার যুগের (১ম থেকে ৫ম শতক) ধ্বংসাবশেষ অনুসন্ধানের, যাতে জে টি হুইলারের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় যে ভারতীয় সভ্যতা শিক্ষালাভ করেছিল গ্রেকো-রোমান সভ্যতার কাছ থেকে। প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশদের বিশ্বাস এই ছিল যে, ভারতীয়দের পক্ষে নিজে থেকে সর্বোৎকৃষ্ট শ্রেণীর স্থাপত্য ও ভাস্কর্য নির্মাণ সম্ভব ছিল না, নিশ্চয়ই তারা অন্য কারো থেকে শিখে বা অনুকরণ করে সেগুলো তৈরি করেছিল।
প্রথম পর্যায়ের খননকাজ থেকে বেরিয়ে আসে কুষাণ যুগের (২য়-৩য় শতক) একটি বুদ্ধ স্তূপ বা ঢিবি। স্তূপটির চারপাশ খোঁড়া হয়, এবং প্রত্নতাত্ত্বিক দলটি খুঁজে পায় কিছু মাইক্রোলিথ (ছোট ছোট চকমকি পাথর, বড় কিছুর ভগ্নাংশ) এবং কিছু মৃৎশিল্পের নিদর্শন, যার সাথে পূর্বলব্ধ কিছুর মিল ছিল না। এরপর আরো খোঁড়াখুঁড়ি অব্যাহত থাকে, যা থেকে বেরিয়ে আসে যে বুদ্ধ স্তূপের মাত্র কয়েক ফুট নিচেই অবস্থান করছে পাঁচ হাজার বছরের পুরনো একটি সভ্যতা!
মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের মুহূর্তটি ছিল অনেকটা এমন: রাখালদাস স্তূপটি খোঁড়ার সময় অনুভব করছিলেন যেন কোনো মাটির তৈরি পাত্রের ভেতরের অংশটা খুঁজে পাওয়া গেছে। তিনি সেই পাত্রের কোনো ফাটল বের করার চেষ্টা করছিলেন। ঠিক তখনই কিছু একটার আঘাতে তার আঙ্গুল কেটে যায়। ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে তিনি বুঝতে পারেন, এটি ছিল একটি মাইক্রোলিথ। এবং এরপর আরো অনেক মাইক্রোলিথ উদ্ঘাটিত হতে থাকে।
রাখালদাস জানতেন, এগুলো হলো আদি-ইতিহাসের (proto-history) জিনিস। আদি-ইতিহাস বলতে বোঝানো হয় প্রাগৈতিহাস (pre-history) ও ইতিহাসের মধ্যবর্তী সময়, যখন একটি নির্দিষ্ট সভ্যতা বা সংস্কৃতি লিখতে শুরু করেনি বটে, কিন্তু ওই একই সময়ে অন্য কোনো সভ্যতা বা সংস্কৃতিতে লেখার প্রচলন শুরু হয়ে গেছে। প্রাপ্ত মাইক্রোলিথগুলো দিয়ে তিনি দুইয়ে দুইয়ে চার মেলালেন, এবং পেয়ে গেলেন মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের পথ।
ঠিক ওই সময়েই পণ্ডিত দায়া রাম সাহনি খননকাজ চালাচ্ছিলেন হরপ্পায়। রাখালদাস এবার পেয়ে গেলেন হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর পারস্পরিক সম্পর্কের প্রমাণও।
মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যবহ, কেননা এটি আবিষ্কারের ফলে ভারতীয় সভ্যতা এক ধাক্কায় চলে গেল মিশরীয় ও মেসোপটেমীয় সভ্যতার (বিশ্বের প্রাচীনতম দুই সভ্যতা) কাতারে। যদি মহেঞ্জোদারো আবিষ্কৃত না হতো, তাহলে ব্রিটিশরা কখনোই মেনে নিত না যে ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস তাদের চেয়েও পুরনো।
নতুন এই আবিষ্কারের সাথে সাথেই রাখালদাস মার্শালের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন, এবং পরবর্তীতে আরো বেশ কয়েকটি প্রতিবেদনের পর ১৯২২ সালে চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি জমা দেন। কিন্তু যেমনটি আগেই বলেছি, মার্শাল কোনো প্রতিবেদনই প্রকাশ করেন না, কিংবা প্রকাশ্যেও আসতে দেন না। তারপরও ১৯২৪ সালে ‘ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ’-এ একটি প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা আবিষ্কারের সংবাদ ফাঁস হয়ে যায়। এবং চমকপ্রদ বিষয় হলো, সেখানে আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেয়া হয় স্যার জন মার্শালকে!
এভাবে বঞ্চিত হবার পরও রাখালদাস মহেঞ্জোদারোয় খননকাজ চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্য আর সহায় হয়নি তার। একাধারে যেমন মার্শাল মহেঞ্জোদারো খননের জন্য সৃষ্ট তহবিলটি বন্ধ করে দেন, তেমনই নিজেও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন রাখালদাস। ডায়াবেটিস ধরা পড়ে তার, যেজন্য বেশ কয়েক মাস কাজ থেকে দূরে থাকতে হয় তাকে। এরই মধ্যে তাকে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে পূর্বাঞ্চলে বদলি করে দেয়া হয়। কিন্তু সেখানে তার উপর ছিল কেবলই লজিস্টিকসের দায়িত্ব।
তবে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে রাখালদাস সবসময়ই ছিলেন মহেঞ্জোদারোর বিষয়ে আচ্ছন্ন। তাই তো তিনি মার্শালের কাছে আরো বিস্তারিত আঙ্গিকে একটি প্রতিবেদন তুলে দেন। কিন্তু বলাই বাহুল্য, মার্শাল সেটিকেও আলোর মুখ দেখতে দেননি। এদিকে রাখালদাস নিজেও জানতেন তার কাজ এএসআই-এর পক্ষ থেকে প্রকাশের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাই তিনি বিকল্প ব্যবস্থারও সন্ধান করতে থাকেন।
তেমনই একটি প্রচেষ্টা ছিল সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে তার কাজগুলো পাঠানো। সুনীতিকুমারকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন,
“এই মানুষগুলো (এএসআই-এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা) কখনোই আমাকে মহেঞ্জোদারো নিয়ে কিছু প্রকাশ করতে দেবে না। কিন্তু তুমি কাজটি করতে পার। আমি তোমাকে আমার অনুসন্ধান, সিদ্ধান্ত আর ছবিগুলো পাঠাচ্ছি…”
শেষ পর্যন্ত একটি বাংলা সাময়িকীতে রাখালদাস রচিত মহেঞ্জোদারো বিষয়ক প্রবন্ধটি ছাপা হয়েছিল। সম্ভবত এএসআই এ বিষয়ে কিছু জানতে পারেনি। কিংবা এমনও হতে পারে, তারা জেনেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। স্রেফ মুচকি হেসে বলেছে, “একটি বাংলা সাময়িকীতে প্রকাশিত হলে ক’জন মানুষই বা আর জানবে!”
এদিকে ১৯২৫ সালের অক্টোবরে রাখালদাস অনুমতি চান জবলপুরের কাছে বেদঘাটে চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরে কিছু লিপি খতিয়ে দেখার জন্য। কিন্তু তিনি ঘুরে আসার দশদিনের মাথায় মন্দিরের মহন্ত একটি এফআইআর করেন তার নামে। সেখানে কারণ দেখানো হয়: মন্দির এলাকা থেকে একটি মূর্তি সরানো। একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয় রাখালদাসের নামে।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য রাখালদাসের নামে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়, এবং বিভাগীয় তদন্তেও তার নামে ওঠা অভিযোগটি অসমর্থনযোগ্য প্রমাণিত হয়। তবে মার্শাল একটি বিষয় পরিষ্কার করে দেন: রাখালদাসকে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় ইস্তফা দিতে হবে।
চাকরি ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পর চরম আর্থিক দৈন্যের মুখে পড়েন রাখালদাস। তার একটি বড় সমস্যা ছিল বিলাসী জীবনযাপন। খেতে ও খাওয়াতে খুবই ভালোবাসতেন তিনি। পর্তুগিজ এক বাবুর্চি নিয়োগ দিয়েছিলেন। বন্ধুদের পেছনে অনেক টাকা ওড়াতেন। দুটি ফেটন গাড়িও ছিল তার। চাকরি ছাড়ার পরও এই সবকিছু সামলাতে গিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই সব সঞ্চয় শেষ করে ফেলেন তিনি।
অবশ্য রাখালদাসের গুণগ্রাহীও কম ছিলেন না। তারা এগিয়ে এসেছিলেন তাকে রক্ষায়। ময়ূরভঞ্জের মহারাজা তাকে নিয়োগ দেন উড়িষ্যার ইতিহাস লিখতে। স্যার আশুতোষ মুখার্জি তাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নেয়ার। এদিকে শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ মদনমোহন মালব্য তাকে আমন্ত্রণ জানান নবপ্রতিষ্ঠিত বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের দায়িত্ব নিতে।
শেষ পর্যন্ত রাখালদাস বেছে নেন বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়কেই। ১৯২৮ সালে সেখানে যোগদান করেন তিনি। এর দুই বছর পর, মাত্র ৪৫ বছর বয়সে, ডায়াবেটিস-সংশ্লিষ্ট জটিলতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
রাখালদাসের মৃত্যু হয়েছিল কলকাতায়, ১৯৩০ সালের ২৩ মে। ওই বছরের শুরুতে, জানুয়ারি মাসে, তিনি একটি চিঠি পেয়েছিলেন এএসআই-এর তৎকালীন মহাপরিচালক এইচ হারগ্রিয়েভসের কাছ থেকে। সেই চিঠির সাথে ছিল ১৬৬ পাতার টাইপ করা একটি নথি—বছর চারেক আগে (১৯২৬ সালে) মহেঞ্জোদারো বিষয়ে মার্শালকে সর্বশেষ যে প্রতিবেদনটি তিনি পাঠিয়েছিলেন। চিঠিতে হারগ্রিয়েভস লিখেছিলেন,
“স্যার জন মনে করেন এটি আপনাকে না জানানো হবে একটি অমহানুভবতা যে আপনার তত্ত্বগুলোর মধ্যে বেশ কিছুই খুবই অসমর্থনযোগ্য, এবং আপনার বিবৃতিগুলোও ভুল।”
এছাড়াও হারগ্রিয়েভস ওই চিঠিতে রাখালদাসের প্রতি আহবান জানান মার্শালের বইটি প্রকাশিত হওয়ার আগেই যেন তিনি তার ‘প্রতিবেদন’ প্রিন্ট করিয়ে নেন, যাতে কোনো “ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ না থাকে”। এছাড়া তিনি আরো জানান যে তার দেয়া ছবিগুলো হারিয়ে গেছে।
১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয় ‘Mohenjodaro and the Indus Civilisation’ বইটি। সেটির ভূমিকায় ছোট করে রাখালদাসের নাম উল্লেখ করেছিলেন মার্শাল। তিনি লিখেছিলেন, রাখালদাসের নাম হলো এমন একটি জিনিস যেটি “নীরবে প্রস্থান করতে পারে না”। তিনি আরো লেখেন, “তারই (রাখালদাসের) কৃতিত্ব, মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের না হলেও, এর উচ্চ প্রাচীনত্ব উদ্ঘাটনের।”
এভাবেই মাত্র কয়েক লাইনে অতি সামান্য কৃতিত্ব প্রদানের ছলে মার্শাল গোপন করে গিয়েছিলেন মহেঞ্জোদারোর পেছনে রাখালদাসের বছরের পর বছর ধরে করে যাওয়া অক্লান্ত পরিশ্রমকে। তাই তো যে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের সুবাদে রাখালদাসের সর্বোচ্চ কৃতিত্ব ও সম্মাননা লাভ করার কথা, সেটির ছিটেফোঁটাও তিনি পান না। মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের পেছনে “অন্যতম অবদান রাখা ব্যক্তি”তেই সীমাবদ্ধ থাকেন তিনি।
আরো পরিতাপের বিষয় হলো, রাখালদাসের অন্যান্য কৃতিত্ব সম্পর্কেও কিন্তু খুব কম মানুষই জ্ঞাত। অনেকে জানেই না, বাংলা ঐতিহাসিক উপন্যাসের অন্যতম শরিক তিনি। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু উপন্যাস লিখে গেছেন; যার মধ্যে রয়েছে: কুষাণ সাম্রাজ্য নিয়ে ‘পাষাণের কথা’, গুপ্ত সাম্রাজ্য নিয়ে ‘শশাঙ্ক’, ‘ধ্রুব’, ‘করুণা’, পাল সাম্রাজ্য নিয়ে ‘ধর্মপাল’, শাহজাহানের আমলে বাংলায় পর্তুগিজদের রমরমা অবস্থা নিয়ে ‘ময়ুখ’ ইত্যাদি। মহেঞ্জাদারো আবিষ্কার পরবর্তী ব্যস্ত সময়ের মাঝেও তিনি উপন্যাস রচনা অব্যাহত রেখেছিলেন। তাছাড়া ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের বাইরে গিয়ে ভিন্নধর্মী কিছু উপন্যাসও তিনি লিখেছিলেন ‘পক্ষান্তর’, ‘ব্যতিক্রম’ এবং ‘অনুক্রম’ নামে।
প্রাচীন হস্তলিপি বিদ্যা ও লিপি উৎকীর্ণ বিদ্যায় রাখালদাসের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। ‘The Origin of the Bengali Scripts’ নামে বিখ্যাত একটি বই লিখেছিলেন তিনি। ভারতীয় মুদ্রা গবেষণার ক্ষেত্রেও তার ছিল বিশেষ অবদান। তার ১৯১৪ সালে প্রকাশিত ‘প্রাচীন মুদ্রা, প্রথম পর্ব’ নামক বইটি ছিল ভারতীয় কোনো ভাষায় মুদ্রাতত্ত্বের উপর লিখিত সর্বপ্রথম গ্রন্থ। এখানে প্রাচীন ও প্রাক-মধ্যযুগীয় ভারতের মুদ্রাসমূহের বিজ্ঞানসম্মত বর্ণনা ও সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিক পরীক্ষার পাঠ্যক্রম অনুযায়ী দুটি পাঠ্যপুস্তকও তিনি রচনা করেন। বই দুটি হলো ‘History of India’ এবং ‘A Junior History of India’.
এসবের বাইরেও প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাস সম্পর্কিত নাট্যকলা, স্থাপত্য ও মূর্তিতত্ত্বের গবেষণায় অনবদ্য অবদান রাখেন রাখালদাস। পাহারপুড়, মুর্শিদাবাদ ও ঢাকার ঐতিহাসিক নিদর্শন নিয়েও তিনি গবেষণা করেছিলেন, যা এই অঞ্চলগুলোর প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল।
পরিশেষে একটি কথাই বলার থাকে, ব্রিটিশরা নিজেদের স্বার্থে হয়তো রাখালদাসের কৃতিত্ব চুরি করেছে, কিন্তু তাই বলে আমরা বাঙালিরা রাখালদাসের মতো একজন অসামান্য প্রতিভাধর ব্যক্তিকে ভুলে যেতে পারি না। তার সৃষ্টি ও গবেষণাকর্মগুলোর মাধ্যমে তাকে আরো ভালো করে জানা ও বোঝা আমাদের একান্ত কর্তব্য। কেবল তবেই ব্রিটিশদের কাছ থেকে যে বঞ্চনার শিকার তিনি হয়েছিলেন, সেটির ক্ষত কিছুটা হলেও সারানো সম্ভব।
ইতিহাসের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/
মহেঞ্জোদারো সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইটিঃ