ধরুন, আপনি ইতিহাসকাঁপানো মোঙ্গল সেনাবাহিনীর একজন সদস্য। আপনি তেজি ঘোড়ায় চেপে শত শত কিলোমিটার পথ পাড়ি দেন অনায়াসে। আপনার হাতে থাকে মোঙ্গল সাম্রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী অস্ত্র তীর-ধনুক, যেগুলোর নাম শুনলেই প্রতিপক্ষের শিবিরে ত্রাস সৃষ্টি হয়। আপনি সেগুলো দিয়ে চরম দক্ষতার সাথে লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারেন। আপনি এমন এক সামরিক বাহিনীর সদস্য, যে সামরিক বাহিনী পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বকালের সবচেয়ে বিধ্বংসী সামরিক বাহিনীগুলোর তালিকায় সবসময় উপরের দিকেই থাকবে। আপনার অশ্বারোহী বাহিনী যেদিকে যায়, সেদিকেই তুলকালাম ঘটে যায়। অসংখ্য সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে আপনার সামরিক বাহিনীর হাতে। শত শত সমৃদ্ধ শহর মাটিতে মিশে গিয়েছে আপনার সামরিক বাহিনীর উন্মত্ত ধ্বংসলীলার শিকার হয়ে। কিন্তু এরপরও আপনি থামেন না। একদল দুধর্ষ অশ্বারোহী যোদ্ধা নিয়ে আপনি ছুটে যান অজানা শহরগুলোতে। বরাবরের মতো আরও একটি শহরের পতন হয়, আপনার জয়ের তালিকাও দীর্ঘ হয়।
কল্পনা এখনই থামানোর প্রয়োজন নেই। ধরুন, আপনি অন্য সবসময়ের মতো তেজি ঘোড়ায় চেপে সাথে পর্যাপ্ত তীর-ধনুক নিয়ে উত্তর চীনের সমতল ভূমির উপর দিয়ে প্রবল বেগে ছুটে চলেছেন। আপনার লক্ষ্য মিং রাজতন্ত্রের অধীনে শাসিত সম্পদে পরিপূর্ণ যে শহরগুলো রয়েছে, সেগুলোতে তীব্র আক্রমণ পরিচালনা করা, এবং লুটতরাজ চালানো। আপনি এবারও জানেন, আপনাকে মিং সৈন্যরা বাধা দিতে আসলেও আপনার সামরিক বাহিনীর মুহুর্মুহু তীর নিক্ষেপের সামনে তারা কয়েক মিনিটও টিকতে পারবে না। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। আপনি যে পথ দিয়ে যাবেন, সেই পথে এমন এক দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে, যা ঘোড়াসমেত টপকানো সম্ভব নয় কোনোমতেই। দেয়ালের ওপাশে যেতে হলে আপনাকে ঘোড়া তো বটেই, অন্য সব অস্ত্রশস্ত্র রেখে খালি হাতে দেয়াল বেয়ে উঠতে হবে। কিন্তু তাতেও বিপত্তি ঘটার সম্ভাবনা আছে। কারণ দেয়ালের ওপাশে মিং রাজবংশের অনুগত সৈন্যরা অস্ত্রসহ টহল দিচ্ছে। আপনার উপস্থিতি টের পেলেই তারা দ্রুত একত্রিত হয়ে আপনার উপর আক্রমণ চালাবে, এবং নিরস্ত্র অবস্থায় আপনি বিজয় তো দূরের কথা, কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারবেন না।
বর্তমানে চীন একটি স্বাধীন দেশ। দেশটিতে বিশাল প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আধুনিক মারণাস্ত্রের সমাহার তো রয়েছেই। বর্তমানে কোনো প্রতিবেশী দেশই চীনে সামরিক হামলা চালানোর সাহস করবে না। কিন্তু একসময় মধ্য এশিয়ার দুধর্ষ যে যাযাবর গোষ্ঠীগুলো ছিল, তারা নিয়মিত চীনে আক্রমণ পরিচালনা করত। বিশেষ করে চীনের উত্তরাঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর উপর এই যাযাবর জনগোষ্ঠীগুলোর অত্যাচার চরমে পৌঁছালে তৎকালীন রাজবংশের কর্ণধাররা চিন্তায় পড়ে যান। তারা আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য হন্ন হয়ে উপায় খুঁজতে লাগলেন। অনেকে পরামর্শ দিল- সেনাবাহিনীর দ্বারা প্রতিরোধ করা হোক। কিন্তু তৎকালীন মোঙ্গল কিংবা জিয়ংনু জনগোষ্ঠীর যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে চীনা সামরিক বাহিনী ছিল চরম অসহায়। এজন্য শেষপর্যন্ত একমাত্র উপায় হিসেবে হাজার হাজার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের প্রাচীর নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
কোনো কিছুর সফলতা পরিমাপ করতে গেলে ঠিক কোন উদ্দেশ্যে জিনিসটি তৈরি করা হয়েছে, সেই সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। চীনের বিখ্যাত মহাপ্রাচীর নির্মাণের পেছনে প্রধান কারণ ছিল সীমান্তরক্ষা। দেশটির উত্তরাঞ্চলে নিয়মিত যাযাবর অশ্বারোহী বাহিনী হানা দেয়ায় জানমালের যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছিল, সেটা কোনো অংশেই কম ছিল না। তাই এমন এক প্রাচীর নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, যেটি অশ্বারোহী বাহিনীর গতিরোধ করতে সমর্থ হবে। এছাড়া প্রাচীরের প্রস্থ এমনভাবে রাখা হয়েছিল, যাতে করে প্রাচীরের উপর দিয়ে সীমান্তরক্ষীরা অনায়াসে হেঁটে যেতে পারে। শুধু তা-ই নয়, চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সীমান্তের মাধ্যমে যেসব বিদেশি ব্যবসায়ী চীনে ব্যবসা করতে আসত, তাদের পণ্যের উপর কর আরোপ করার পরিপ্রেক্ষিতে যেন রাজ্যের কোষাগারে যাতে কিছু অর্থ জমা হয়, এবং নজরদারির মাধ্যমে অবৈধ চোরাচালানের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়, সেটি নিশ্চিত করাও ছিল এই দেয়াল নির্মাণের অন্যতম লক্ষ্য। তাছাড়া যখন হানদের উপর আক্রমণ চালানো হতো, তখন এই মহাপ্রাচীরকে নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
যদি প্রশ্ন করা হয়, যে উদ্দেশ্যে (বাইরের শত্রুর হাত থেকে চীনকে রক্ষা করা) এই সুদীর্ঘ মহাপ্রাচীর স্থাপন করা হয়েছিল, সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে এই মহাপ্রাচীর কতটুকু সফল হয়েছিল? তাহলে বলতে হবে, এই মহাপ্রাচীর এদিক থেকে শতভাগ সফল ছিল। চীনের উত্তরাঞ্চল দিয়ে যখনই যাযাবর অশ্বারোহী বাহিনীগুলো বিভিন্ন চীনা শহরে তান্ডবলীলা চালাতে অগ্রসর হয়েছিল, তখনই মূল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই প্রাচীর। তবে এই মহাপ্রাচীরের বাধা টপকিয়ে কখনোই যে তারা চীনের ক্ষতিসাধন করতে পারেনি, এমনটা কিন্তু নয়। এই মহাপ্রাচীর না থাকলে তাদের আক্রমণে চীনের উত্তরাঞ্চলের মানুষ ও সম্পদের ক্ষতিসাধন তো হতোই, এর পাশাপাশি চীনের স্বাধীনতাও হুমকিতে পড়ত। প্রায় দুই হাজার বছরের ব্যাপ্তিতে একমাত্র সেনানায়ক হিসেবে কুখ্যাত মঙ্গোলীয় বিজেতা চেঙ্গিস খান এই মহাপ্রাচীরের বাধা উপেক্ষা করে চীনে আক্রমণ ও ধ্বংসলীলা চালাতে সক্ষম হন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আরও কিছু ছোটখাট ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোতে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সৈন্যরা এই প্রাচীরের বাধা উপেক্ষা করে চীনে আক্রমণ চালিয়েছিল। অনেক ইতিহাসবিদ বলে থাকেন, যদি চীনের তৎকালীন রাজারা মহাপ্রাচীর তৈরির উদ্যোগ না নিত, তাহলে আজকে চীনের অন্য এক ইতিহাস পড়তাম আমরা।
বর্তমানে আমরা যে চীনা মহাপ্রাচীর দেখি, সেটি মিং রাজবংশের আমলে সংস্কার করা মহাপ্রাচীর। এখন এটি পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা হলেও একসময় এই প্রাচীর ছিল চীনের রক্ষাকবচ। মূলত বাইরের শত্রুদের আক্রমণ রুখে দিতে দক্ষ চীনা তীরন্দাজরা সশস্ত্র টহল দিত এই প্রাচীরের উপর দিয়ে। পুরো মহাপ্রাচীরের সম্মিলিত দৈর্ঘ্য প্রায় ২১,১৯৬ কিলোমিটার, যার মধ্যে প্রায় ২৫,০০০ ওয়াচ-টাওয়ার রয়েছে। এই ওয়াচ টাওয়ারগুলোতে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত সৈন্যরা সবসময় শত্রুর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকত। সাধারণত, ওয়াচ-টাওয়ারগুলো স্থাপন করা হতো পাহাড়ের উপরে, যাতে অনেক দূরের শত্রুর অবস্থানও দেখা যায়। যদি দিনের বেলায় শত্রুরা আক্রমণ করত, তাহলে ওয়াচ-টাওয়ারে অবস্থান করা বিশেষ সৈন্যরা আগুন জ্বালিয়ে বাকি ওয়াচ টাওয়ারের সৈন্যদের উদ্দেশ্যে প্রস্তুতি গ্রহণের বার্তা প্রেরণ করত। রাতে শত্রুপক্ষ আক্রমণ করলে লণ্ঠন জ্বালিয়ে বার্তা দেয়া হতো।
“মহাপ্রাচীর নির্মাণ প্রকল্প’ ছিল পুরোটাই চীনা রাজতন্ত্রের খামখেয়ালিপূর্ণ একটি প্রকল্প। বিশ্বকে নিজেদের অর্থের ঝনঝনানি এবং প্রকৌশলগত উৎকর্ষ দেখানোর জন্য এই দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছিল”- এমন অভিযোগ করেন অনেকে। এটা সত্যি যে এই মহাপ্রাচীর নির্মাণে বিশাল অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। কিন্তু সেটি না করলে চীনের স্বাধীনতা বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। যদি বাইরের শত্রুর হাত থেকে চীনকে রক্ষারর দিক থেকে এই প্রাচীরের সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব করা হয়, তাহলে দেখা যাবে এই মহাপ্রাচীর সফল একটি প্রকল্প ছিল। আগেই বলা হয়েছে, এই প্রাচীর সবসময় যে বাইরের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেছে, এমনটা নয়। কিন্তু তারপরও যে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা ও শত্রুদের গতিরোধ করতে সফল হয়েছে, এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিরোধ করতেও সক্ষম হয়েছে, সেই কথা বলাই বাহুল্য।